০৭:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

অর্থ পাচারকারী সেই ২৮ জন কারা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:২২:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০
  • / ৪২৩২ বার দেখা হয়েছে

কানাডায় সহজ ও আকর্ষণীয় অভিবাসন নীতিমালার কারণে গেল কয়েক বছরে বহুসংখ্যক বাংলাদেশি কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন। বর্তমানে স্থায়ী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখের বেশি। এই অভিবাসীর মধ্যে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদরা রয়েছেন। তবে কয়েকদিন আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কানাডায় ২৮ জনের অভিজাত বাড়ি থাকার কথা জানালে তা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয় তারা কারা?

অন্যদিকে কানাডার সরকারি সংস্থা দ্য ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার ফর কানাডা (ফিনট্র্যাক) গত এক বছরে ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করেছে। এই রিপোর্টে কয়েকজন বাংলাদেশির নামও থাকতে পারে- এমন কানাঘুষা চলছে কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে। প্রবাসীদের একটি অংশ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ২৮ জনের কথা বলেছেন তাদের নাম ফিনট্র্যাকের প্রতিবেদনে আছে কিনা সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেছেন, তিনি যে তথ্য পেয়েছেন তা একেবারেই অনানুষ্ঠানিক সূত্র থেকে পাওয়া। এটি কোনো ধরনের অফিসিয়াল তথ্য নয়। তবে এ তালিকায় সাবেক সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের নাম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি তাকে অবাক করেছে। তিনি জানান, এ বিষয়টি তদন্ত করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়। তবে উপযুক্ত সংস্থা তদন্ত করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়ম অনুযায়ী সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।

বেগমপাড়ায় অর্থের জোগান যেভাবে: কানাডায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কয়েকজন সমকালকে জানান, কানাডায় দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ‘বেগমপাড়া’। তবে সুনির্দিষ্টভাবে বেগমপাড়া বলে সেখানে কিছু নেই। মূলত দেশের ধনী ব্যবসায়ী, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা অনেকেই বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন। এই বাংলাদেশি ‘বেগম’দের বেশিরভাগের বসবাস টরন্টোসহ অন্যান্য শহরে। এ ছাড়া মন্ট্রিয়ল, অটোয়া শহরের অভিজাত এলাকাতেও তারা আছেন। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু স্ত্রী এবং সন্তানরা থাকেন, সে কারণেই ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি এসেছে। এর আগে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বার ‘বেগমপুরা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। এর মূল কাহিনি নেওয়া হয় কানাডার মিসিসাগা শহরের সেই স্ত্রীদের নিয়ে, যাদের স্বামীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করেন। সিনেমাটিতে ধনী স্বামীদের নিঃসঙ্গ স্ত্রীদের জীবনযাপনের চিত্র উঠে এসেছে। বেগমপাড়া শব্দটি এখান থেকেই এসেছে বলে তারা জানান।

প্রবাসীরা জানান, গোলকধাঁধার বেগমপাড়ার অধিবাসীর বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রী। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক সচিব থেকে শুরু করে বর্তমানে কর্মরত আছেন এমন যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের সন্তানরা কানাডার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। এই সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের একাধিক বাড়িও আছে। প্রশ্ন উঠছে, বেগমপাড়ার অভিজাত বাংলাদেশি বাসিন্দাদের অর্থের জোগান হচ্ছে কীভাবে।

বাংলাদেশের ধনীদের কালো টাকা কীভাবে কানাডায় আসে- তার উদাহরণ দিয়ে একজন প্রবাসী জানান, প্রায় দেড় বছর আগে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব অবসর নেন। তার স্ত্রী-কন্যা কানাডায় থাকেন। দেখা যায়, সচিব থাকার সময়ে ওই মন্ত্রণালয়ের একাধিক বড় প্রকল্পে কাজ করা একটি বিদেশি কোম্পানির এজেন্টরা টরন্টোতে সেই বেগমের কাছে নিয়মিত অর্থ সরবরাহ করছেন সুকৌশলে। আবার এই টাকার একটা অংশ কানাডায় আয় দেখিয়ে দেশে রেমিট্যান্স হিসেবেও পাঠানো হয়। সেই ‘বৈধ’ টাকা দিয়ে দেশে ওই সাবেক সচিব ঢাকায় দামি ফ্ল্যাটও কিনেছেন। এমন কৌশল ব্যবহার করা হয় যে, বিদেশে ঘুষের টাকা পরিশোধের কোনো প্রমাণই থাকে না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তিনি আরও জানান, একাধিক রাজনীতিবিদের কানাডায় বড় ব্যবসা ও বিলাসবহুল বাড়ি আছে। অনেকের একাধিক বাড়ি আছে। এই রাজনীতিবিদদের টাকা নিয়ে আসার কৌশল ভিন্ন। প্রথমে দেশ থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নেওয়া হয়। পরে সেই টাকা মধ্যপ্রাচ্যে আয় দেখিয়ে কানাডার কোনো ব্যাংক হিসাবে নিয়ে আসা হয়। কুয়েতে অর্থ ও মানব পাচারের দায়ে এমপি পাপুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ কৌশলকে ‘পাপুল স্টাইল’ হিসেবেও বলা হচ্ছে। পাপুলের বিরুদ্ধেও কুয়েত কর্তৃপক্ষ তার নিজস্ব মুদ্রা বিনিময় কোম্পানির মাধ্যমে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ করেছে।

সূত্র জানায়, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের তত্ত্বাবধানে মধ্যপ্রাচ্যে এমপি পাপুলের মতো একাধিক এজেন্ট আছেন। যাদের কাজ হচ্ছে দেশ থেকে হুন্ডি করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে টাকা পাঠানো। সেই টাকা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয় দেখিয়ে কানাডায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া। এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশের অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ী আছেন, যারা মূলত পারমিট নিয়ে সেসব দেশে ব্যবসা করছেন। তাদের মাধ্যমেও ‘এমপি পাপুল’ স্টাইলে প্রথমে হুন্ডি এবং পরে আয় দেখিয়ে কানাডার ব্যাংক হিসাবে পাঠানোর বিষয়টি প্রবাসীদের মধ্যে ‘ওপেন সিক্রেট’।

প্রবাসী এক কর্মকর্তা জানান, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ি কেনার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনে সরকারের একজন সিনিয়র সচিব তদবির করে পদাবনতি নিয়ে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একটি পদে পোস্টিং নেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল নিউইয়র্ক শহরেই তার তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ী হন। তার এই অর্থের উৎস কী তা জানা যায়নি। এই কর্মকর্তা আরও জানান, অতি সম্প্রতি একজন কর্মকর্তার কথাও শোনা যাচ্ছে। যিনি সারাজীবন নাকি সৎ ছিলেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার আগে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অবসরে যাবেন, এরপর কানাডায় পাড়ি দেবেন। তার স্ত্রী-সন্তান আরও আগেই অভিবাসী হয়েছেন কানাডায়।

বিনিয়োগের মাধ্যমে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ কমেছে: ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কানাডায় দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এটা ছিল অভিবাসী হওয়া এবং কানাডায় দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। তারা দেশে কর পরিশোধ, জমি বিক্রি, ব্যবসায়িক মুনাফার ভুয়া কাগজ-পত্র সরবরাহ করতেন এমন বিষয়ও ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু ২০১৪ সালে কানাডা সরকার এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। কারণ, এই বিনিয়োগকারীরা এককালীন বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগের জন্য কানাডায় নিয়ে গেলেও পরে আর নিয়মিত কর দিতেন না। তাদের বিনিয়োগের সঙ্গে কর পরিশোধে বড় ধরনের অসংগতির কারণে কানাডা সরকার এই সুযোগ ২০১৪ সালে বন্ধ করে দেয়। এ কারণে ২০১৪ সালের পর থেকে কানাডায় বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী ‘অভিবাসী’ কমে গেছে। বর্তমানেও কয়েকটি প্রদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানা যায়।

কানাডায় প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ: কানাডায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ‘রুখো লুটেরা, বাঁচাও স্বদেশ’ স্লোগানে প্রবাসীদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করেছে। তারা বাংলা, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে টরন্টো ও মন্ট্রিয়লে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন। সমাবেশে অংশ নেওয়া প্রবাসী বাংলাদেশি লিটন মাসুদ বলেন, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা অর্থ পাচারকারীদের কোনো দল নেই, তারা দেশ ও জাতির শত্রু। তিনি কানাডায় বসবাসরত দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে অর্থ দেশে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

আরেকজন প্রবাসী খালেদ শামীম জানান, দেশে অর্থ পাচারকারীদের জন্য কানাডাকে অভয়ারণ্য হতে দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

শেয়ার করুন

x
English Version

অর্থ পাচারকারী সেই ২৮ জন কারা

আপডেট: ১১:২২:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর ২০২০

কানাডায় সহজ ও আকর্ষণীয় অভিবাসন নীতিমালার কারণে গেল কয়েক বছরে বহুসংখ্যক বাংলাদেশি কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন। বর্তমানে স্থায়ী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখের বেশি। এই অভিবাসীর মধ্যে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদরা রয়েছেন। তবে কয়েকদিন আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কানাডায় ২৮ জনের অভিজাত বাড়ি থাকার কথা জানালে তা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয় তারা কারা?

অন্যদিকে কানাডার সরকারি সংস্থা দ্য ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার ফর কানাডা (ফিনট্র্যাক) গত এক বছরে ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করেছে। এই রিপোর্টে কয়েকজন বাংলাদেশির নামও থাকতে পারে- এমন কানাঘুষা চলছে কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে। প্রবাসীদের একটি অংশ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ২৮ জনের কথা বলেছেন তাদের নাম ফিনট্র্যাকের প্রতিবেদনে আছে কিনা সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেছেন, তিনি যে তথ্য পেয়েছেন তা একেবারেই অনানুষ্ঠানিক সূত্র থেকে পাওয়া। এটি কোনো ধরনের অফিসিয়াল তথ্য নয়। তবে এ তালিকায় সাবেক সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের নাম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি তাকে অবাক করেছে। তিনি জানান, এ বিষয়টি তদন্ত করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়। তবে উপযুক্ত সংস্থা তদন্ত করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিয়ম অনুযায়ী সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।

বেগমপাড়ায় অর্থের জোগান যেভাবে: কানাডায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কয়েকজন সমকালকে জানান, কানাডায় দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ‘বেগমপাড়া’। তবে সুনির্দিষ্টভাবে বেগমপাড়া বলে সেখানে কিছু নেই। মূলত দেশের ধনী ব্যবসায়ী, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা অনেকেই বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন। এই বাংলাদেশি ‘বেগম’দের বেশিরভাগের বসবাস টরন্টোসহ অন্যান্য শহরে। এ ছাড়া মন্ট্রিয়ল, অটোয়া শহরের অভিজাত এলাকাতেও তারা আছেন। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু স্ত্রী এবং সন্তানরা থাকেন, সে কারণেই ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি এসেছে। এর আগে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বার ‘বেগমপুরা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। এর মূল কাহিনি নেওয়া হয় কানাডার মিসিসাগা শহরের সেই স্ত্রীদের নিয়ে, যাদের স্বামীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করেন। সিনেমাটিতে ধনী স্বামীদের নিঃসঙ্গ স্ত্রীদের জীবনযাপনের চিত্র উঠে এসেছে। বেগমপাড়া শব্দটি এখান থেকেই এসেছে বলে তারা জানান।

প্রবাসীরা জানান, গোলকধাঁধার বেগমপাড়ার অধিবাসীর বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রী। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক সচিব থেকে শুরু করে বর্তমানে কর্মরত আছেন এমন যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের সন্তানরা কানাডার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। এই সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের একাধিক বাড়িও আছে। প্রশ্ন উঠছে, বেগমপাড়ার অভিজাত বাংলাদেশি বাসিন্দাদের অর্থের জোগান হচ্ছে কীভাবে।

বাংলাদেশের ধনীদের কালো টাকা কীভাবে কানাডায় আসে- তার উদাহরণ দিয়ে একজন প্রবাসী জানান, প্রায় দেড় বছর আগে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব অবসর নেন। তার স্ত্রী-কন্যা কানাডায় থাকেন। দেখা যায়, সচিব থাকার সময়ে ওই মন্ত্রণালয়ের একাধিক বড় প্রকল্পে কাজ করা একটি বিদেশি কোম্পানির এজেন্টরা টরন্টোতে সেই বেগমের কাছে নিয়মিত অর্থ সরবরাহ করছেন সুকৌশলে। আবার এই টাকার একটা অংশ কানাডায় আয় দেখিয়ে দেশে রেমিট্যান্স হিসেবেও পাঠানো হয়। সেই ‘বৈধ’ টাকা দিয়ে দেশে ওই সাবেক সচিব ঢাকায় দামি ফ্ল্যাটও কিনেছেন। এমন কৌশল ব্যবহার করা হয় যে, বিদেশে ঘুষের টাকা পরিশোধের কোনো প্রমাণই থাকে না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তিনি আরও জানান, একাধিক রাজনীতিবিদের কানাডায় বড় ব্যবসা ও বিলাসবহুল বাড়ি আছে। অনেকের একাধিক বাড়ি আছে। এই রাজনীতিবিদদের টাকা নিয়ে আসার কৌশল ভিন্ন। প্রথমে দেশ থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নেওয়া হয়। পরে সেই টাকা মধ্যপ্রাচ্যে আয় দেখিয়ে কানাডার কোনো ব্যাংক হিসাবে নিয়ে আসা হয়। কুয়েতে অর্থ ও মানব পাচারের দায়ে এমপি পাপুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ কৌশলকে ‘পাপুল স্টাইল’ হিসেবেও বলা হচ্ছে। পাপুলের বিরুদ্ধেও কুয়েত কর্তৃপক্ষ তার নিজস্ব মুদ্রা বিনিময় কোম্পানির মাধ্যমে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ করেছে।

সূত্র জানায়, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের তত্ত্বাবধানে মধ্যপ্রাচ্যে এমপি পাপুলের মতো একাধিক এজেন্ট আছেন। যাদের কাজ হচ্ছে দেশ থেকে হুন্ডি করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে টাকা পাঠানো। সেই টাকা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয় দেখিয়ে কানাডায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া। এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশের অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ী আছেন, যারা মূলত পারমিট নিয়ে সেসব দেশে ব্যবসা করছেন। তাদের মাধ্যমেও ‘এমপি পাপুল’ স্টাইলে প্রথমে হুন্ডি এবং পরে আয় দেখিয়ে কানাডার ব্যাংক হিসাবে পাঠানোর বিষয়টি প্রবাসীদের মধ্যে ‘ওপেন সিক্রেট’।

প্রবাসী এক কর্মকর্তা জানান, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ি কেনার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনে সরকারের একজন সিনিয়র সচিব তদবির করে পদাবনতি নিয়ে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একটি পদে পোস্টিং নেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল নিউইয়র্ক শহরেই তার তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ী হন। তার এই অর্থের উৎস কী তা জানা যায়নি। এই কর্মকর্তা আরও জানান, অতি সম্প্রতি একজন কর্মকর্তার কথাও শোনা যাচ্ছে। যিনি সারাজীবন নাকি সৎ ছিলেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার আগে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অবসরে যাবেন, এরপর কানাডায় পাড়ি দেবেন। তার স্ত্রী-সন্তান আরও আগেই অভিবাসী হয়েছেন কানাডায়।

বিনিয়োগের মাধ্যমে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ কমেছে: ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কানাডায় দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এটা ছিল অভিবাসী হওয়া এবং কানাডায় দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। তারা দেশে কর পরিশোধ, জমি বিক্রি, ব্যবসায়িক মুনাফার ভুয়া কাগজ-পত্র সরবরাহ করতেন এমন বিষয়ও ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু ২০১৪ সালে কানাডা সরকার এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। কারণ, এই বিনিয়োগকারীরা এককালীন বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগের জন্য কানাডায় নিয়ে গেলেও পরে আর নিয়মিত কর দিতেন না। তাদের বিনিয়োগের সঙ্গে কর পরিশোধে বড় ধরনের অসংগতির কারণে কানাডা সরকার এই সুযোগ ২০১৪ সালে বন্ধ করে দেয়। এ কারণে ২০১৪ সালের পর থেকে কানাডায় বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী ‘অভিবাসী’ কমে গেছে। বর্তমানেও কয়েকটি প্রদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানা যায়।

কানাডায় প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ: কানাডায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ‘রুখো লুটেরা, বাঁচাও স্বদেশ’ স্লোগানে প্রবাসীদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করেছে। তারা বাংলা, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে টরন্টো ও মন্ট্রিয়লে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন। সমাবেশে অংশ নেওয়া প্রবাসী বাংলাদেশি লিটন মাসুদ বলেন, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা অর্থ পাচারকারীদের কোনো দল নেই, তারা দেশ ও জাতির শত্রু। তিনি কানাডায় বসবাসরত দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে অর্থ দেশে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

আরেকজন প্রবাসী খালেদ শামীম জানান, দেশে অর্থ পাচারকারীদের জন্য কানাডাকে অভয়ারণ্য হতে দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।