ঝালের আদ্যোপান্ত
- আপডেট: ০৩:০০:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২১
- / ৪১৯০ বার দেখা হয়েছে
চীন সস্তায় জিনিসপত্র বানিয়ে পুরো পৃথিবীকে মাত করে দিলেও আমাদের প্রাচীন বাংলা চীনকে মাত করে দিয়েছিল মরিচ দিয়ে। তেমনটাই শোনা যায়। এখন নাকি পৃথিবীর ৪৪ শতাংশ মরিচ চীন দেশে উৎপন্ন হয়! অবশ্য সবচেয়ে বেশি মরিচ উৎপাদনের কৃতিত্ব এখন ভারতের। যাহোক, চীনের একাংশের খাবারে মরিচ, তথা ঝালের যে ব্যাপক উপস্থিতি, তার জন্য দায়ী বাংলা অঞ্চল। এর মধ্যে আমাদের দেশও আছে বটে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, বেশ কয়েকটি পথে চীন দেশে মরিচ প্রবেশ করেছিল। এর মধ্যে জনপ্রিয় মত হলো, প্রাচীন বাংলা থেকে বার্মা, তথা মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ চীনে ঢুকেছে মরিচ। এ অঞ্চলে চীনের সিচুয়ান প্রদেশ। এই সিচুয়ান প্রদেশের খাবার চীনের জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত এবং এ খাবারের মূল বৈশিষ্ট্য ঝাল।
কিন্তু মরিচ ছাড়া কি আর কোনো উপাদান নেই, যেটা খাবারে ঝাল স্বাদ আনতে পারে? আছে না! যশোর-খুলনা এবং উত্তরবঙ্গে চুই ঝাল আছে। আছে গোলমরিচ। এই গোলমরিচ এমনই চরকি ঘোরান ঘুরিয়েছে পৃথিবীকে যে সেটাই এক ইতিহাস। মনে করুন, আজ থেকে চার শ বছর বা তারও আগে একমুঠো গোলমরিচ থাকলে আপনি তখনকার লন্ডন শহরে বা আমস্টারডামে কিনতে পারতেন একটা বিলাসবহুল বাড়ি! এমনও শোনা যায় যে ইউরোপের কোনো কোনো দেশের রাজা নাকি আধমুঠো গোলমরিচ হাতে ধরিয়ে দিয়ে জেনারেলদের বলত, এই দিলাম তোমাদের বেতন, এবার যাও! সোনার চেয়েও দামি ছিল এ বস্তু। এখন অবশ্য এসব ঘটনাকে সবাই গল্পই বলে।
গোলমরিচের ঝাল বেশ অদ্ভুত। জিবে অনুভূত হওয়ার চেয়ে এর ঝাল ঠোঁটেই অনুভূত হয় বেশি। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কাঁচা মরিচের মতো একেবারে ধাই করে আপনাকে অবাক করে দেবে না গোলমরিচের ঝাল। আবার নাগা মরিচের মতোও নয় তার ঝালের পরিমাণ। গোলমরিচ দেওয়া খাবারে খেলে তার ঝাল বোঝা যায় ধীরে ধীরে। প্রথমে খুব বোঝা যাবে না। কিছুক্ষণ পর খুব সন্তর্পণে তিনি জাদু দেখাতে শুরু করেন। তারপর বোঝা যায় যে তরকারিতে ঝাল হয়েছে। আমরা যতই হেলাফেলা করি না কেন, বলে রাখি, ব্ল্যাক পেপার, তথা গোলমরিচের গুঁড়া ইউরোপের খাবারে একধরনের আভিজাত্যের নাম এবং সেটা এখনো। কোনো কিছু খাওয়ার আগে তার ওপর ব্ল্যাক পেপারের গুঁড়া ছিটিয়ে দেওয়া একটা ঘটনাই সেখানে।
গোলমরিচের মতোই খুব মৃদু ঝালের মসলা লবঙ্গ। এটি নিয়েও ইতিহাসে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। সে যাক, খাবারে মৃদু ঝাল স্বাদ আনতে লবঙ্গ ব্যবহার করা যায়। এখনো লবঙ্গ ব্যবহার করা হয় ঝাল মসলা হিসেবে। লবঙ্গ চিবিয়ে এক ঢোক গরম পানি খেয়ে দেখবেন।
এবার বলি চুই ঝালের কথা। লতানো এ উদ্ভিদের হালকা ঝালে রাঁধা খাসি কিংবা গরু অথবা হাঁসের মাংসের স্বাদ সবাই জানেন। বিশেষ করে যশোর-খুলনা অঞ্চলের রেস্তোরাঁগুলোতে রান্না করা চুই ঝালের মাংসের কথা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। তবে যশোর-খুলনার মানুষ বলবেন, রেস্তোরাঁর চেয়ে বাড়িতে রান্না করা চুই ঝালের তরকারি, বিশেষ করে মাংসের স্বাদ অনেক বেশি।
উত্তরবঙ্গের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলেও চুই ঝাল আছে। তবে সেটা যশোর-খুলনার চুই ঝালের চাচাতো ভাই। চুই ঝাল নাকি শরীরের পক্ষে খুবই ভালো। উত্তরবঙ্গে চৈত্র-বৈশাখ মাসের গরমের দিনে খাওয়া হয় চুই ঝাল। স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষেরা বলে থাকেন, চৈত্র দিনে চুইয়ের ঝাল শরীরের ব্যথা দূর করে। এ সময়ে প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দূর করার জন্য চুই ঝাল জনপ্রিয় হোম রেমিডি—এখনো।
চুই ঝালও গোলমরিচের মতোই মৃদু থেকে শুরু হয়। তারপর জিবে অনুভূত হয়। তারও পর কপালে ঘাম তৈরি করে। মাংস কিংবা সবজিতে চুই ব্যবহার করা যায় মরিচের বিকল্প হিসেবে। মূলত কাঁচা মরিচ আসার আগে চুই, গোলমরিচ কিংবা লবঙ্গই ব্যবহার করা হতো ঝালের উৎস হিসেবে। পিপুল বলে আরও একটি উদ্ভিদের কাণ্ড এবং ফল ব্যবহার করা হতো মৃদু ঝালের জন্য। পিপুলের ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে।আয়ুর্বেদের উপকারী জড়িবুটির তালিকায় অবশ্য পিপুলের নাম এখনো পাওয়া যায়।
সেই বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানের কথা মনে আছে, ‘কানিছাত গাড়িছু আকাশি আকালি…’। মনে না থাকার কোনো কারণ নেই। ভাওয়াইয়া গান বাংলাদেশের রংপুর-দিনাজপুর আর ভারতের কোচবিহার, আসামের কিছু অংশের নিজস্ব গান। এ গানে আকাশি আকালির কথা বলা হয়েছে। ‘আকালি’ শব্দটির সঙ্গে মরিচ বা চিলি ইত্যাদি শব্দের মিল না থাকলেও অর্থগত দিকে একই। ওই অঞ্চল কোচ জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত। ‘আকালি’ শব্দটি অন্য কোথাও আর শোনা যায় না বলে এটিকে কোচ ভাষার শব্দ বলা যেতেই পারে। তাহলে কি বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তরবঙ্গে এবং আসামের কিছু অংশে ‘আকালি’ শব্দটি তাদের নিজস্ব ঝাল খাবারকে নির্দেশ করছে? নিশ্চিতভাবে কিছু বলা না গেলেও একটা অনুসন্ধানের জায়গা তৈরি আছে বটে।
আকাশি আকালি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, এখন আমরা যে কাঁচা মরিচ খাই, আকাশি আকালির আকৃতি সে রকম নয়। এটি ছোট আকারের মরিচ এবং এখন উত্তরবঙ্গে প্রায় বিলুপ্ত। হঠাৎ হঠাৎ কোথাও দেখা পাওয়া যায় আকাশি আকালির। এর রং কিছুটা ফ্যাকাশে সবুজ। ধারণা করি, সে কারণেই এর নাম আকাশি আকালি। ঝাল খুব বেশি বা কম নয়, মধ্যম। অনেকেই মনে করেন, অতিক্ষুদ্র ধানি মরিচ (আক্ষরিক অর্থে ধানের সমান না হলেও ধানের চেয়ে একটু বড়) আসলে আকাশি আকালি। সেটা বিতর্কের বিষয় অবশ্য।
সে যাহোক, কানিছাত আকাশি আকালি হলফল করে বেড়ে উঠুক আর রান্নাঘরে বেড়ে উঠুক আকালি, তথা মরিচের ঝাঁজালো স্বাদ। কারণ, মরিচের আছে অনেক গুণ। সে গুণে তরতাজা থাক আমাদের স্বাস্থ্য।
সূত্র:
১. মরিচের বিশ্বভ্রমণ, ড. তাইফুর রহমান, কৃষ্টিকথা ডট কম
২. তেল, মসলা আর লবণের গল্প, মোবারক হোসেন, প্রথম আলো