০৩:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

নিত্য পন্যের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে!

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৬:৪৫:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ মে ২০১৮
  • / ৪৫৬৯ বার দেখা হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রোজায় দেশে যেসব পণ্যের বাড়তি চাহিদা থাকে, সেগুলোর আন্তর্জাতিক বাজার দর কমেছে। কিন্তু দেশের মানুষ এর সুফল পায়নি; বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম উল্টো বেড়েছে।

পবিত্র রমজান মাসে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেনাবেচার চাপ তৈরি হওয়ার পরই চিনির দর কেজিপ্রতি ৫ টাকা, পেঁয়াজ ১০-১৫ টাকা, রসুন ২০ টাকা ও আদার দর ২০ টাকা বেড়েছে। সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক বাজার দর কমে যাওয়ায় খুচরা বিক্রেতাদের মূল্যছাড় দিয়েছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। কিন্তু ক্রেতাদের তাতে কোনো লাভ হয়নি। একই ঘটনা ঘটেছে লবণের ক্ষেত্রেও। ছোলার দর গত বছরের চেয়ে কম। কিন্তু পণ্যটির যে দর হওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে দাবি পাইকারি ব্যবসায়ীদের।

সব মিলিয়ে রোজার বাজারে ক্রেতাদের স্বস্তি পাওয়ার কথা, কিন্তু বাজারে অস্বস্তি বেড়েছে। অবশ্য গত বছর রমজান মাস ও সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ দর বিবেচনায় নিলে এখনকার দর সে তুলনায় কম।

নতুন মৌসুমের চাল বাজারে আসতে শুরু করায় মিনিকেট ও বিআর-২৮ জাতের চালের দর কেজিতে ৩-৪ টাকা কমেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, বর্তমানে চিনি, ছোলা, মসুর ডাল, রসুন, গরুর মাংস, লবণ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য গত বছরের তুলনায় কম রয়েছে। তেলের মূল্যও স্বাভাবিক। গত রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও গত বছরের তুলনায় এসব পণ্যের মূল্য কম রয়েছে। সংগত কারণে এ মুহূর্তে এগুলোর মূল্য বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই।

চিনির উল্টোযাত্রা


বিশ্বব্যাংক ২ মে আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে জানানো হয়, বিশ্ববাজারে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকে চিনির গড় দাম ছিল টনপ্রতি ৩২০ ডলার, যা মার্চ মাসে ২৮০ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিল মাসে চিনির দর আরও কমে প্রতি টন ২৭০ ডলারে নেমেছে।

দেশের বাজারে গত কয়েক মাস প্রতি কেজি চিনির দর ৫৪-৫৫ টাকা ছিল। চলতি মাসের শুরুতে পাইকারি বাজারে সরবরাহে কিছুটা টান পড়ায় দাম কেজিতে প্রায় ৫ টাকা বেড়ে যায়। এখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৫৮-৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআই) প্রায় ১ লাখ টন চিনি আমদানি করেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি চিনির খুচরা দর নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। ফলে বাজারে প্রভাব পড়ছে না।

চিনি আমদানিও হয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে দেশে চিনি আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ১৯ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে পণ্যটির বার্ষিক চাহিদা ১৬ লাখ টন।

দেশে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম

বিভিন্ন কাঁচাবাজারে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া পণ্যের যৌক্তিক দামের একটি তালিকা টানিয়ে রাখে ঢাকা সিটি করপোরেশন। পাইকারি দরের সঙ্গে মুনাফা যোগ করে খুচরা বাজারে যৌক্তিক দর কত হওয়া উচিত, তা উল্লেখ থাকে ওই তালিকায়। গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, তালিকায় লেখা ভারতীয় পেঁয়াজের যৌক্তিক খুচরা মূল্য কেজিপ্রতি ২২-২৪ টাকা। কিন্তু ওই বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

ভারতের বাজারে গত মাসের মাঝামাঝি পেঁয়াজের দর মৌসুমের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। তখন প্রতি কেজির দর ছিল মাত্র ৬ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ টাকার কম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দামে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের সঙ্গে ভারতীয় পেঁয়াজের দরও বেড়েছে।
রোজার বাজারে কেনাবেচা শুরু হওয়ার আগে দেশি পেঁয়াজের দর ছিল কেজিপ্রতি ৩০ টাকা। আর ভারতীয় পেঁয়াজ ছিল ২৫-৩০ টাকা। এখন বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৪৫-৫০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। পেঁয়াজের আমদানি ও সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। দেশে ১৮-২০ লাখ টন উৎপাদিত হয়। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে দেশে ৬ লাখ ৮৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এখন দেশেও ভরা মৌসুম চলছে। এ সময়ই হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল।

রসুন ও আদার দাম বাড়তি
ঢাকার বাজারে রসুন ও আদার দর কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকানে প্রতি কেজি চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে, যা কিছুদিন আগেও ১০০ টাকা ছিল। অন্যদিকে ৬০ টাকার দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা দরে।

পেঁয়াজের মতো রসুনেরও এখন ভরা মৌসুম। অন্যদিকে চীনের বাজারে রসুনের দর কমেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এক টন রসুনের দর ৭১৮ মার্কিন ডলার, যা এক মাস আগের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ কম। ৭ মে ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, মধ্যপ্রদেশে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ ওঠার পর কেজিপ্রতি দর নেমেছে ১-৫ রুপিতে। এতে কৃষকেরা হতাশ।

বাজারে আদার দাম কেজিতে প্রায় ২০ টাকা। কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মামুন হোসেন প্রতি কেজি চীনা আদা ১২০ ও দেশি আদা ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোজার কেনাবেচা শুরুর আগে আদার দর কেজিপ্রতি ১০০-১২০ টাকা ছিল। এরপর দাম বেড়েছে।

ভোজ্যতেল ও লবণে দোকানদারদের পোয়াবারো
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৭১ ডলার, যা এপ্রিল মাসে ৮৩০ ডলারে নেমেছে। পড়তির বাজারে দেশে নিজেদের বিক্রি বাড়াতে কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের বাড়তি ছাড় দিচ্ছে। দুটি শীর্ষ কোম্পানির পরিবেশক সূত্রে জানা গেছে, প্রতি ২০ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনলে সঙ্গে ২ লিটার বিনা মূল্যে দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।

এতে একটি কোম্পানির তেলের পাঁচ লিটারের বোতলের দর পড়ছে ৪৮৩ টাকা, যার মোড়কে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ৫৪০ টাকা। আরেকটি কোম্পানির তেলের এমআরপি ৫৫০ টাকা, যা খুচরা বিক্রেতারা কিনতে পারেন ৫০৭ টাকায়। এতে পাঁচ লিটারের একটি বোতলে ৪৩ থেকে ৫৭ টাকা মুনাফার সুযোগ পাচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা।

লবণ কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, তারা এখন প্রতি কেজি লবণ কোম্পানিভেদে ২৬-২৭ টাকা দরে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। যদিও লবণের এমআরপি ৩৬-৩৮ টাকা। ফলে লবণে খুচরা বিক্রেতারা কেজি প্রতি ১০ টাকা মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু কোনো কোম্পানি ভোক্তার জন্য মূল্য কমাচ্ছে না।

ছোলার নানা দাম
বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি পর্যায়ে এ বছর প্রতি কেজি মাঝারি মানের ছোলা ৪৭ থেকে ৫১ টাকা ও ভালোমানের ছোলা সর্বোচ্চ ৫৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।

ঢাকার ৯টি বাজারের তথ্য সংগ্রহ করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানায়, ছোলার কেজি এখন ৭০-৮০ টাকা। কারওয়ান বাজারে সব দোকান ভালোমানের ছোলা ৮০ টাকা কেজি চাইছেন বিক্রেতারা। হাজি মিজান স্টোরে একই ছোলা ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। জানতে চাইলে দোকানটির বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতি কেজি ৬৬ টাকায় কিনে ৭০ টাকায় বিক্রি করছি।’ উল্লেখ্য, দোকানটি প্রতিবেদকের পূর্বপরিচিত।

খুচরা বাজারে ছোলার এত দাম হওয়া উচিত কি না, জানতে চাইলে আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘আপনি যে দরটি বলছেন, সেটি আমার কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত এক মাসে ছোলার দাম ১১ শতাংশ কমে টনপ্রতি ৫৬৭ ডলারে নেমেছে।

দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার সুযোগ আছে

এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকার ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। দুই-তিন বছর আগেও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কাঙ্ক্ষিত খুচরা মূল্য কত হওয়া উচিত, তা হিসাব করত। এখন আর তা করা হয় না। এমনকি ভোজ্যতেল ও চিনির দর নিয়েও কোনো বিশ্লেষণ করে না মনিটরিং সেল।

জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজায় ক্রেতারা বাড়তি পণ্য কেনেন। বাড়তি চাহিদার সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশে সেটার প্রভাব পড়তে অনেক দেরি হয়। এ বছর রোজায় খুচরা বাজারে দাম বেশি বাড়বে না, এটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কমার সুফল হয়তো মিলবে না।

শেয়ার করুন

x
English Version

নিত্য পন্যের দাম না কমে উল্টো বেড়েছে!

আপডেট: ০৬:৪৫:০৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ মে ২০১৮

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রোজায় দেশে যেসব পণ্যের বাড়তি চাহিদা থাকে, সেগুলোর আন্তর্জাতিক বাজার দর কমেছে। কিন্তু দেশের মানুষ এর সুফল পায়নি; বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম উল্টো বেড়েছে।

পবিত্র রমজান মাসে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেনাবেচার চাপ তৈরি হওয়ার পরই চিনির দর কেজিপ্রতি ৫ টাকা, পেঁয়াজ ১০-১৫ টাকা, রসুন ২০ টাকা ও আদার দর ২০ টাকা বেড়েছে। সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক বাজার দর কমে যাওয়ায় খুচরা বিক্রেতাদের মূল্যছাড় দিয়েছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। কিন্তু ক্রেতাদের তাতে কোনো লাভ হয়নি। একই ঘটনা ঘটেছে লবণের ক্ষেত্রেও। ছোলার দর গত বছরের চেয়ে কম। কিন্তু পণ্যটির যে দর হওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে দাবি পাইকারি ব্যবসায়ীদের।

সব মিলিয়ে রোজার বাজারে ক্রেতাদের স্বস্তি পাওয়ার কথা, কিন্তু বাজারে অস্বস্তি বেড়েছে। অবশ্য গত বছর রমজান মাস ও সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ দর বিবেচনায় নিলে এখনকার দর সে তুলনায় কম।

নতুন মৌসুমের চাল বাজারে আসতে শুরু করায় মিনিকেট ও বিআর-২৮ জাতের চালের দর কেজিতে ৩-৪ টাকা কমেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, বর্তমানে চিনি, ছোলা, মসুর ডাল, রসুন, গরুর মাংস, লবণ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য গত বছরের তুলনায় কম রয়েছে। তেলের মূল্যও স্বাভাবিক। গত রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও গত বছরের তুলনায় এসব পণ্যের মূল্য কম রয়েছে। সংগত কারণে এ মুহূর্তে এগুলোর মূল্য বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই।

চিনির উল্টোযাত্রা


বিশ্বব্যাংক ২ মে আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে জানানো হয়, বিশ্ববাজারে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর প্রান্তিকে চিনির গড় দাম ছিল টনপ্রতি ৩২০ ডলার, যা মার্চ মাসে ২৮০ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিল মাসে চিনির দর আরও কমে প্রতি টন ২৭০ ডলারে নেমেছে।

দেশের বাজারে গত কয়েক মাস প্রতি কেজি চিনির দর ৫৪-৫৫ টাকা ছিল। চলতি মাসের শুরুতে পাইকারি বাজারে সরবরাহে কিছুটা টান পড়ায় দাম কেজিতে প্রায় ৫ টাকা বেড়ে যায়। এখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৫৮-৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআই) প্রায় ১ লাখ টন চিনি আমদানি করেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি চিনির খুচরা দর নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। ফলে বাজারে প্রভাব পড়ছে না।

চিনি আমদানিও হয়েছে চাহিদার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে দেশে চিনি আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ১৯ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে পণ্যটির বার্ষিক চাহিদা ১৬ লাখ টন।

দেশে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম

বিভিন্ন কাঁচাবাজারে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া পণ্যের যৌক্তিক দামের একটি তালিকা টানিয়ে রাখে ঢাকা সিটি করপোরেশন। পাইকারি দরের সঙ্গে মুনাফা যোগ করে খুচরা বাজারে যৌক্তিক দর কত হওয়া উচিত, তা উল্লেখ থাকে ওই তালিকায়। গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, তালিকায় লেখা ভারতীয় পেঁয়াজের যৌক্তিক খুচরা মূল্য কেজিপ্রতি ২২-২৪ টাকা। কিন্তু ওই বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

ভারতের বাজারে গত মাসের মাঝামাঝি পেঁয়াজের দর মৌসুমের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। তখন প্রতি কেজির দর ছিল মাত্র ৬ রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ টাকার কম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দামে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের সঙ্গে ভারতীয় পেঁয়াজের দরও বেড়েছে।
রোজার বাজারে কেনাবেচা শুরু হওয়ার আগে দেশি পেঁয়াজের দর ছিল কেজিপ্রতি ৩০ টাকা। আর ভারতীয় পেঁয়াজ ছিল ২৫-৩০ টাকা। এখন বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৪৫-৫০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। পেঁয়াজের আমদানি ও সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। দেশে ১৮-২০ লাখ টন উৎপাদিত হয়। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে দেশে ৬ লাখ ৮৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এখন দেশেও ভরা মৌসুম চলছে। এ সময়ই হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল।

রসুন ও আদার দাম বাড়তি
ঢাকার বাজারে রসুন ও আদার দর কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকানে প্রতি কেজি চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে, যা কিছুদিন আগেও ১০০ টাকা ছিল। অন্যদিকে ৬০ টাকার দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা দরে।

পেঁয়াজের মতো রসুনেরও এখন ভরা মৌসুম। অন্যদিকে চীনের বাজারে রসুনের দর কমেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এক টন রসুনের দর ৭১৮ মার্কিন ডলার, যা এক মাস আগের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ কম। ৭ মে ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, মধ্যপ্রদেশে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ ওঠার পর কেজিপ্রতি দর নেমেছে ১-৫ রুপিতে। এতে কৃষকেরা হতাশ।

বাজারে আদার দাম কেজিতে প্রায় ২০ টাকা। কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মামুন হোসেন প্রতি কেজি চীনা আদা ১২০ ও দেশি আদা ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোজার কেনাবেচা শুরুর আগে আদার দর কেজিপ্রতি ১০০-১২০ টাকা ছিল। এরপর দাম বেড়েছে।

ভোজ্যতেল ও লবণে দোকানদারদের পোয়াবারো
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৭১ ডলার, যা এপ্রিল মাসে ৮৩০ ডলারে নেমেছে। পড়তির বাজারে দেশে নিজেদের বিক্রি বাড়াতে কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের বাড়তি ছাড় দিচ্ছে। দুটি শীর্ষ কোম্পানির পরিবেশক সূত্রে জানা গেছে, প্রতি ২০ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনলে সঙ্গে ২ লিটার বিনা মূল্যে দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।

এতে একটি কোম্পানির তেলের পাঁচ লিটারের বোতলের দর পড়ছে ৪৮৩ টাকা, যার মোড়কে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ৫৪০ টাকা। আরেকটি কোম্পানির তেলের এমআরপি ৫৫০ টাকা, যা খুচরা বিক্রেতারা কিনতে পারেন ৫০৭ টাকায়। এতে পাঁচ লিটারের একটি বোতলে ৪৩ থেকে ৫৭ টাকা মুনাফার সুযোগ পাচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা।

লবণ কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, তারা এখন প্রতি কেজি লবণ কোম্পানিভেদে ২৬-২৭ টাকা দরে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। যদিও লবণের এমআরপি ৩৬-৩৮ টাকা। ফলে লবণে খুচরা বিক্রেতারা কেজি প্রতি ১০ টাকা মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু কোনো কোম্পানি ভোক্তার জন্য মূল্য কমাচ্ছে না।

ছোলার নানা দাম
বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি পর্যায়ে এ বছর প্রতি কেজি মাঝারি মানের ছোলা ৪৭ থেকে ৫১ টাকা ও ভালোমানের ছোলা সর্বোচ্চ ৫৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।

ঢাকার ৯টি বাজারের তথ্য সংগ্রহ করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানায়, ছোলার কেজি এখন ৭০-৮০ টাকা। কারওয়ান বাজারে সব দোকান ভালোমানের ছোলা ৮০ টাকা কেজি চাইছেন বিক্রেতারা। হাজি মিজান স্টোরে একই ছোলা ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। জানতে চাইলে দোকানটির বিক্রেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতি কেজি ৬৬ টাকায় কিনে ৭০ টাকায় বিক্রি করছি।’ উল্লেখ্য, দোকানটি প্রতিবেদকের পূর্বপরিচিত।

খুচরা বাজারে ছোলার এত দাম হওয়া উচিত কি না, জানতে চাইলে আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘আপনি যে দরটি বলছেন, সেটি আমার কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত এক মাসে ছোলার দাম ১১ শতাংশ কমে টনপ্রতি ৫৬৭ ডলারে নেমেছে।

দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার সুযোগ আছে

এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকার ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। দুই-তিন বছর আগেও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কাঙ্ক্ষিত খুচরা মূল্য কত হওয়া উচিত, তা হিসাব করত। এখন আর তা করা হয় না। এমনকি ভোজ্যতেল ও চিনির দর নিয়েও কোনো বিশ্লেষণ করে না মনিটরিং সেল।

জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজায় ক্রেতারা বাড়তি পণ্য কেনেন। বাড়তি চাহিদার সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশে সেটার প্রভাব পড়তে অনেক দেরি হয়। এ বছর রোজায় খুচরা বাজারে দাম বেশি বাড়বে না, এটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কমার সুফল হয়তো মিলবে না।