০৯:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রচলিত বিনিয়োগের পাশাপাশি অপ্রচলিত বিনিয়োগেও বেকায়দায় ব্যাংক

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১০:৩৫:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২১
  • / ৪২৬৯ বার দেখা হয়েছে

মহামারি করোনার থাবায় ব্যাংকগুলোর প্রচলিত বিনিয়োগ মেয়াদি ঋণের পাশাপাশি অপ্রচলিত বিনিয়োগ কার্যক্রমও থমকে গেছে। করোনার প্রভাবে মেয়াদি ঋণের পাশাপাশি অপ্রচলিত বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকগুলোর আদায় কার্যক্রম থমকে গেছে। বিশেষ করে রিটেইল বিনিয়োগ থেকে আদায়ের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ আদায় কার্যক্রম কমে যাওয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের ওপর। প্রকৃত আদায় না হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর যাবত কাঠামোগত বিনিয়োগের ধীরগতিতে ব্যাংকগুলো অপ্রচলিত বিনিয়োগের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে। বিভিন্ন ভোক্তা ঋণের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয় ব্যাংক। আবার এসব ঋণ থেকে আদায়ের হারও অন্যসব ঋণ থেকে বেশি ছিল। কারণ, এসব ঋণের বড় একটি অংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদেরকেই এসব ঋণ বেশি দেয়া হতো। মাস শেষে বেতন থেকে তা পরিশোধ করতেন গ্রাহক। কিন্তু গত বছরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বেসরকারি খাতের। ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে লোকবল ছাঁটাই হয়। চাকরিচ্যুত হয়ে অনেকেই রাজধানীতে টিকতে না পেরে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। অনেকেই আবার বাসা ভাড়া কম এমন এলাকায় স্থানান্তর হয়েছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের দেয়া অপ্রচলিত ঋণ আদায়ের ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের জুলাই-অক্টোবরে গ্রামীণ শিল্প থেকে আদায়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ধনাত্মক, সেখানে এবার তা হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ১৩ শতাংশ। শিল্প ঋণেও আদায় কমে গেছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। এর সাথে প্রচলিত ঋণ থেকেও আদায়ের হার দারুণভাবে নেমে গেছে।

ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের অবদান রাখে ব্যক্তি পর্যায়ের ভোক্তা ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ঋণসহ জামানতবিহীন ঋণ। জামানতবিহীন হওয়ায় এসব ঋণে ঝুঁকিও বেশি। আর ঝুঁকি বেশি হওয়ায় এসব ঋণ গ্রহীতার বাড়তি সুদ বা মুনাফা পরিশোধ করতে হয়। এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ক্রেডিট কার্ডের ঋণ সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ শতাংশের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ভোক্তা ঋণ বাদে সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয়েছে, ২০ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করা যাবে না ভোক্তা ঋণে।

ব্যাংকাররা জানান, এসব ঋণে তেমন কোনো জামানত নেয়া হয় না। যেমন, কেউ কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে তার বেতনের বিপরীতে এ ঋণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধু বেতনের তথ্যাদি জমা দিতে হতো। এর ওপর ভিত্তি করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় নেয়া হতো সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের। কিন্তু গত মার্চ থেকে করোনায় সব হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়। দীর্ঘ ৫ মাস যাবত করোনার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যারা নিয়মিত বেতনভাতা পেয়ে সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি অর্থ থেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতেন তারা পড়ে যান বিপাকে। বেতনভাতা না পেয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন না অনেকেই। আবার কেউ কেউ বাড়ি ভাড়া পরিশোধ না করে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। এর ফলে ইতোমধ্যে যেসব জামানতবিহীন ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ওইসব ঋণ ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। বেশির ভাগ জামানতবিহীন ঋণই এখন আদায় হচ্ছে না। এতে একদিকে ব্যাংকের আয় যেমন কমে গেছে, তেমনি খেলাপি হয়ে যাচ্ছে এসব ঋণ।

একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভোক্তা ঋণ এখন ব্যাংকের গলার কাঁটা। আগে যেসব ঋণ গ্রহীতা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, আয় কমে যাওয়ায় এখন তারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই ঠিকানা বদল করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতাকে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এমনি পরিস্থিতিতে সবচেয়ে লাভবান খাত ভোক্তা ঋণ দিতে অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ব্যাংকাররা। বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মাত্রা বাড়াতে চাচ্ছে না। একসময় ভোক্তা ঋণের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল ব্যাংকের। করোনার কারণে সব হিসাব পাল্টে গেছে। অনেকটা নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এ মুহূর্তে নিরাপদ বিনিয়োগ কোনো খাত, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যাংকের এমডি জানান, প্রণোদনা প্যাকেজ অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে না। কারণ, এই মুহূর্তে ঋণ নিয়ে কোনো প্রজেক্টই লাভবান হবে না। এ কারণে যারা ঋণ নেবেন তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। তাই ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এতে বছর শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই আয় কমে যাবে। তবে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আর মানুষের আয় বাড়লে আবারো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে উৎসাহী হবে ব্যাংকগুলো।

শেয়ার করুন

x
English Version

প্রচলিত বিনিয়োগের পাশাপাশি অপ্রচলিত বিনিয়োগেও বেকায়দায় ব্যাংক

আপডেট: ১০:৩৫:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২১

মহামারি করোনার থাবায় ব্যাংকগুলোর প্রচলিত বিনিয়োগ মেয়াদি ঋণের পাশাপাশি অপ্রচলিত বিনিয়োগ কার্যক্রমও থমকে গেছে। করোনার প্রভাবে মেয়াদি ঋণের পাশাপাশি অপ্রচলিত বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকগুলোর আদায় কার্যক্রম থমকে গেছে। বিশেষ করে রিটেইল বিনিয়োগ থেকে আদায়ের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ আদায় কার্যক্রম কমে যাওয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণের ওপর। প্রকৃত আদায় না হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর যাবত কাঠামোগত বিনিয়োগের ধীরগতিতে ব্যাংকগুলো অপ্রচলিত বিনিয়োগের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে। বিভিন্ন ভোক্তা ঋণের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয় ব্যাংক। আবার এসব ঋণ থেকে আদায়ের হারও অন্যসব ঋণ থেকে বেশি ছিল। কারণ, এসব ঋণের বড় একটি অংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদেরকেই এসব ঋণ বেশি দেয়া হতো। মাস শেষে বেতন থেকে তা পরিশোধ করতেন গ্রাহক। কিন্তু গত বছরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বেসরকারি খাতের। ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান থেকে লোকবল ছাঁটাই হয়। চাকরিচ্যুত হয়ে অনেকেই রাজধানীতে টিকতে না পেরে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। অনেকেই আবার বাসা ভাড়া কম এমন এলাকায় স্থানান্তর হয়েছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের দেয়া অপ্রচলিত ঋণ আদায়ের ওপর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের জুলাই-অক্টোবরে গ্রামীণ শিল্প থেকে আদায়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ধনাত্মক, সেখানে এবার তা হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ১৩ শতাংশ। শিল্প ঋণেও আদায় কমে গেছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। এর সাথে প্রচলিত ঋণ থেকেও আদায়ের হার দারুণভাবে নেমে গেছে।

ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের অবদান রাখে ব্যক্তি পর্যায়ের ভোক্তা ঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ঋণসহ জামানতবিহীন ঋণ। জামানতবিহীন হওয়ায় এসব ঋণে ঝুঁকিও বেশি। আর ঝুঁকি বেশি হওয়ায় এসব ঋণ গ্রহীতার বাড়তি সুদ বা মুনাফা পরিশোধ করতে হয়। এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ক্রেডিট কার্ডের ঋণ সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ শতাংশের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ভোক্তা ঋণ বাদে সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয়েছে, ২০ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করা যাবে না ভোক্তা ঋণে।

ব্যাংকাররা জানান, এসব ঋণে তেমন কোনো জামানত নেয়া হয় না। যেমন, কেউ কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে তার বেতনের বিপরীতে এ ঋণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধু বেতনের তথ্যাদি জমা দিতে হতো। এর ওপর ভিত্তি করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় নেয়া হতো সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের। কিন্তু গত মার্চ থেকে করোনায় সব হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়। দীর্ঘ ৫ মাস যাবত করোনার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যারা নিয়মিত বেতনভাতা পেয়ে সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি অর্থ থেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতেন তারা পড়ে যান বিপাকে। বেতনভাতা না পেয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন না অনেকেই। আবার কেউ কেউ বাড়ি ভাড়া পরিশোধ না করে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। এর ফলে ইতোমধ্যে যেসব জামানতবিহীন ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ওইসব ঋণ ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। বেশির ভাগ জামানতবিহীন ঋণই এখন আদায় হচ্ছে না। এতে একদিকে ব্যাংকের আয় যেমন কমে গেছে, তেমনি খেলাপি হয়ে যাচ্ছে এসব ঋণ।

একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভোক্তা ঋণ এখন ব্যাংকের গলার কাঁটা। আগে যেসব ঋণ গ্রহীতা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, আয় কমে যাওয়ায় এখন তারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই ঠিকানা বদল করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতাকে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এমনি পরিস্থিতিতে সবচেয়ে লাভবান খাত ভোক্তা ঋণ দিতে অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ব্যাংকাররা। বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মাত্রা বাড়াতে চাচ্ছে না। একসময় ভোক্তা ঋণের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল ব্যাংকের। করোনার কারণে সব হিসাব পাল্টে গেছে। অনেকটা নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এ মুহূর্তে নিরাপদ বিনিয়োগ কোনো খাত, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যাংকের এমডি জানান, প্রণোদনা প্যাকেজ অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে না। কারণ, এই মুহূর্তে ঋণ নিয়ে কোনো প্রজেক্টই লাভবান হবে না। এ কারণে যারা ঋণ নেবেন তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। তাই ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এতে বছর শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই আয় কমে যাবে। তবে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আর মানুষের আয় বাড়লে আবারো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে উৎসাহী হবে ব্যাংকগুলো।