০৩:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

বৈধতা পাচ্ছে অনলাইন পরীক্ষা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:১২:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল ২০২১
  • / ৪১৬৪ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল ডেস্কঃ করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা। বার্ষিক পরীক্ষাসহ গত বছরের অষ্টম শ্রেণির সমাপনী এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এইচএসসিতে অটো পাস ঘোষণা করায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এবার মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাননি।

চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ফলে দীর্ঘ সেশন জট সৃষ্টি হবে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে তা যাচাই-বাছাই করে রোড ম্যাপ তৈরি করতে উচ্চপর্যায়ের আলাদা দুটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

অনলাইনে পরীক্ষা নিতে গত ২৪ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে আয়োজনের জন্য সুপারিশ করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আরেকটি কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউজিসি’র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগমকে।

কমিটি দেশে-বিদেশে অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বর্তমান প্র্যাকটিসগুলো পর্যালোচনা করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোড ম্যাপ প্রণয়ন করে আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনলাইনে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা নেওয়া হলেও এটার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা রোড ম্যাপ নেই। পরীক্ষাগুলো একটি নীতিমালার আওতায় এনে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না, সেজন্য দুটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। তাদের মতামত পাওয়া পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৭ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা- ২০১৮’ এর আওতায় গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটির দ্বিতীয় সভায় অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং এটুআইকে যৌথভাবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৩ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও অর্থ) সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর/সংস্থা, এটুআই ও বুয়েটের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা সভা করে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য গত ২৪ মার্চ সভা ডাকা হয়।

মাধ্যমিক কমিটি

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে আয়োজনের জন্য সুপারিশ করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি সদস্যরা হলেন- বুয়েটের সিএসএই ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন), মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধি, এটুআই প্রতিনিধি, নটর ডেম ও সেন্ট জোসেফ কলেজের প্রতিনিধি। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া সম্ভব কি না— জানতে চাইলে কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এস এম আমিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে চলছে এভাবে আসলে চলতে পারে না। করোনা চলে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব না, আবার অসম্ভব বলে কিছু নেই। বিকল্প রাস্তা বের করার চেষ্টা করতে হবে।

‘বিশ্বের কোন কোন দেশ অনলাইনে কীভাবে পরীক্ষা নিচ্ছে তার খোঁজ নিচ্ছি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে রোড ম্যাপ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেব।’

বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি

বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউজিসি’র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগমকে। কমিটির সদস্য করা হয়েছে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, মাউশি ও এটুআই প্রোগ্রাম প্রতিনিধিকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে ইউজিসি’র পরিচালককে (আইএমসিটি)।

অনলাইন পরীক্ষায় কম্পিউটার, ব্যান্ডউইথ, সংযোগ, সফটওয়্যার, পরিবেশ, প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে 

উভয় কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি দেশে-বিদেশে অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বর্তমান প্র্যাকটিসগুলো পর্যালোচনা করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোড ম্যাপ প্রণয়ন করে আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে।

কমিটির সভাপতি ও ইউজিসি’র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে তার খোঁজ-খবর নিয়ে সামারি তৈরির কাজ করছি। লকডাউন হওয়ায় কমিটির সদস্যদের নিয়ে ২৪ তারিখ (এপ্রিল) সভা করব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া কঠিন। ইন্টারনেটের গতি অনেক স্লো। এটা (করোনা মহামারি) কত বছর চলবে কেউ বলতে পারছেন না। শিক্ষাব্যবস্থা তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।

কমিটির কার্যপরিধি

ওই কমিটির প্রতিবেদনে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের ঝুঁকি, সমস্যা ও পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপযোগী অনলাইন পরীক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, পরীক্ষা পদ্ধতি রিডিজাইনিং, মূল্যায়ন পদ্ধতি রিডিজাইনিং, অনলাইন প্রক্টরিং ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটি বেশকিছু সুপারিশও করেছে। সুগুলো হলো- অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ (কম্পিউটার, ব্যান্ডউইথ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও সরবরাহ, সফটওয়্যার ইত্যাদি নিশ্চিতকরণ), অনলাইন পরীক্ষা বিষয়ক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান, সকল শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করার আগে পাইলটিং প্রভৃতি।

প্রাথমিকভাবে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ উপযোগী ভৌত, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন ও বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি বা কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপকমিটি গঠন করে তাদের সময়াবদ্ধ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে লাগবে অনেক সময়

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার (উন্নয়ন) সভাকে অবহিত করেন, কমিটির সদস্যরা অভিজ্ঞতা ও মতামতের আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

সভায় বুয়েটের সিএসএই ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, বুয়েটে আনডার গ্রাজুয়েট সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে কম্পিউটার, কম্পিউটারের গতি, ব্যান্ডউইথ, সংযোগ, সফটওয়্যার, পরীক্ষা উপযোগী পরিবেশ, প্রযুক্তিগত ও কারিগরি ইত্যাদির সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা তিন ঘণ্টা হয়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রশ্নের উত্তর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে আপলোড করার সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বুয়েটে যেভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেটি প্রকৃত পক্ষে অনলাইন পরীক্ষা নয়।

অন্যদিকে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিস্টেমের সঙ্গে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিস্টেমের মিল নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স শর্ট করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা তিন ঘণ্টা নেওয়া হয়। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে অনেক সময় লাগে। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ তৈরি করে অনেক সময় উত্তরপত্র শেয়ার করে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন পরিচালক বলেন, একটি স্কলারশিপের জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করে ১০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১০ হাজারের মধ্যে সাত হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে সেখান থেকে প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছিল।

মাউশি’র মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব না হলেও স্কুল-কলেজপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে।

মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে স্তরভিত্তিক পরীক্ষার চিন্তা করা যেতে পারে। স্বাভাবিক পরীক্ষার সময় যেমন শিক্ষক-অভিভাবক-সোসাইটি সম্পৃক্ত থাকেন তেমনি অনলাইন পরীক্ষার সময়ও তাদের সম্পৃক্ত করা গেলে ফল পাওয়া যেতে পারে।

সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট

শেয়ার করুন

x
English Version

বৈধতা পাচ্ছে অনলাইন পরীক্ষা

আপডেট: ১১:১২:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল ২০২১

বিজনেস জার্নাল ডেস্কঃ করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা। বার্ষিক পরীক্ষাসহ গত বছরের অষ্টম শ্রেণির সমাপনী এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এইচএসসিতে অটো পাস ঘোষণা করায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এবার মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাননি।

চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ফলে দীর্ঘ সেশন জট সৃষ্টি হবে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে তা যাচাই-বাছাই করে রোড ম্যাপ তৈরি করতে উচ্চপর্যায়ের আলাদা দুটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

অনলাইনে পরীক্ষা নিতে গত ২৪ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে আয়োজনের জন্য সুপারিশ করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আরেকটি কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউজিসি’র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগমকে।

কমিটি দেশে-বিদেশে অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বর্তমান প্র্যাকটিসগুলো পর্যালোচনা করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোড ম্যাপ প্রণয়ন করে আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনলাইনে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা নেওয়া হলেও এটার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা রোড ম্যাপ নেই। পরীক্ষাগুলো একটি নীতিমালার আওতায় এনে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না, সেজন্য দুটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। তাদের মতামত পাওয়া পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৭ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা- ২০১৮’ এর আওতায় গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটির দ্বিতীয় সভায় অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং এটুআইকে যৌথভাবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৩ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও অর্থ) সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর/সংস্থা, এটুআই ও বুয়েটের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা সভা করে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য গত ২৪ মার্চ সভা ডাকা হয়।

মাধ্যমিক কমিটি

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকপর্যায়ের শ্রেণি ও পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে আয়োজনের জন্য সুপারিশ করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি সদস্যরা হলেন- বুয়েটের সিএসএই ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন), মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধি, এটুআই প্রতিনিধি, নটর ডেম ও সেন্ট জোসেফ কলেজের প্রতিনিধি। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া সম্ভব কি না— জানতে চাইলে কমিটির সদস্য সচিব ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এস এম আমিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে চলছে এভাবে আসলে চলতে পারে না। করোনা চলে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব না, আবার অসম্ভব বলে কিছু নেই। বিকল্প রাস্তা বের করার চেষ্টা করতে হবে।

‘বিশ্বের কোন কোন দেশ অনলাইনে কীভাবে পরীক্ষা নিচ্ছে তার খোঁজ নিচ্ছি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে রোড ম্যাপ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেব।’

বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি

বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে বিভিন্ন পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ইউজিসি’র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগমকে। কমিটির সদস্য করা হয়েছে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, মাউশি ও এটুআই প্রোগ্রাম প্রতিনিধিকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে ইউজিসি’র পরিচালককে (আইএমসিটি)।

অনলাইন পরীক্ষায় কম্পিউটার, ব্যান্ডউইথ, সংযোগ, সফটওয়্যার, পরিবেশ, প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে 

উভয় কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি দেশে-বিদেশে অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বর্তমান প্র্যাকটিসগুলো পর্যালোচনা করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোড ম্যাপ প্রণয়ন করে আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপট করতে পারবে।

কমিটির সভাপতি ও ইউজিসি’র সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে তার খোঁজ-খবর নিয়ে সামারি তৈরির কাজ করছি। লকডাউন হওয়ায় কমিটির সদস্যদের নিয়ে ২৪ তারিখ (এপ্রিল) সভা করব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া কঠিন। ইন্টারনেটের গতি অনেক স্লো। এটা (করোনা মহামারি) কত বছর চলবে কেউ বলতে পারছেন না। শিক্ষাব্যবস্থা তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।

কমিটির কার্যপরিধি

ওই কমিটির প্রতিবেদনে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের ঝুঁকি, সমস্যা ও পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপযোগী অনলাইন পরীক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, পরীক্ষা পদ্ধতি রিডিজাইনিং, মূল্যায়ন পদ্ধতি রিডিজাইনিং, অনলাইন প্রক্টরিং ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটি বেশকিছু সুপারিশও করেছে। সুগুলো হলো- অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ (কম্পিউটার, ব্যান্ডউইথ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও সরবরাহ, সফটওয়্যার ইত্যাদি নিশ্চিতকরণ), অনলাইন পরীক্ষা বিষয়ক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান, সকল শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করার আগে পাইলটিং প্রভৃতি।

প্রাথমিকভাবে ঐচ্ছিক বিষয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ উপযোগী ভৌত, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন ও বাস্তবায়নে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ, অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি বা কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপকমিটি গঠন করে তাদের সময়াবদ্ধ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে লাগবে অনেক সময়

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার (উন্নয়ন) সভাকে অবহিত করেন, কমিটির সদস্যরা অভিজ্ঞতা ও মতামতের আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

সভায় বুয়েটের সিএসএই ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, বুয়েটে আনডার গ্রাজুয়েট সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে কম্পিউটার, কম্পিউটারের গতি, ব্যান্ডউইথ, সংযোগ, সফটওয়্যার, পরীক্ষা উপযোগী পরিবেশ, প্রযুক্তিগত ও কারিগরি ইত্যাদির সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা তিন ঘণ্টা হয়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রশ্নের উত্তর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে আপলোড করার সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বুয়েটে যেভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেটি প্রকৃত পক্ষে অনলাইন পরীক্ষা নয়।

অন্যদিকে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিস্টেমের সঙ্গে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সিস্টেমের মিল নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স শর্ট করে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা তিন ঘণ্টা নেওয়া হয়। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিতে অনেক সময় লাগে। অনলাইন পরীক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে গ্রুপ তৈরি করে অনেক সময় উত্তরপত্র শেয়ার করে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন পরিচালক বলেন, একটি স্কলারশিপের জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করে ১০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা অনলাইনে গ্রহণের সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১০ হাজারের মধ্যে সাত হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করে সেখান থেকে প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছিল।

মাউশি’র মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, বর্তমানে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব না হলেও স্কুল-কলেজপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নেওয়ার চিন্তা করা যেতে পারে।

মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে স্তরভিত্তিক পরীক্ষার চিন্তা করা যেতে পারে। স্বাভাবিক পরীক্ষার সময় যেমন শিক্ষক-অভিভাবক-সোসাইটি সম্পৃক্ত থাকেন তেমনি অনলাইন পরীক্ষার সময়ও তাদের সম্পৃক্ত করা গেলে ফল পাওয়া যেতে পারে।

সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট