১২:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

স্বাভাবিক গতি ফিরছে অর্থনীতিতে, সব সূচক ঊর্ধ্বমুখী

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৯:৩৮:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • / ৪২০৮ বার দেখা হয়েছে

করোনা মহামারির ধাক্কায় বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সব খাতে গতি থেমে গিয়েছিল। দীর্ঘ ৬ মাস স্থবিরতা কাটিয়ে স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। গতি ফিরেছে কর্মচাঞ্চল্যেও। সচল হয়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য এমনটিই বলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শিল্প খাত তথা রফতানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে পণ্য-বাণিজ্য। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও আসছে রেকর্ড পরিমাণ। ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজারও। ব্যাংকের লেনদেন চলছে অনেকটা স্বাভাবিক সময়ের মতোই। এর ফলে সরকারের আয়ও বেড়ে গেছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো যে গতিশীল হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রতিবেদনে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের (২০১৯ সালের ) আগস্টে রাজস্ব আয়ের কোনও প্রবৃদ্ধিই ছিল না। উল্টো আগের বছরের (২০১৮ সালের) তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৫ শতাংশ। আর ২০১৮ সালের আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

এনবিআরের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে ১৫ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে এনবিআর—যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেকোনও আগস্ট মাসের চেয়ে বেশি।

অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের (২০১৯) আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, করোনাকালে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এরইমধ্যে উদ্যোক্তারা এই প্যাকেজের টাকা নেওয়া শুরু করেছেন। এই প্যাকেজের টাকা নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন গার্মেন্টস মালিকরা। পাশাপাশি করোনার মধ্যেও কারখানা চালু রাখার কারণে ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৈরি পোশাক খাত। গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা—সবই চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সব পক্ষের প্রচেষ্টার ফলে।’ এত অল্পদিনে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোকে বাঙালির ঐতিহ্যগত কারণ বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, যেকোনও সংকট অনেক সময় সুযোগ তৈরি করে। তিনি উল্লেখ করেন, যখন সবাই বিপদগ্রস্ত হয়, তখন সবাই একসঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করে। একজনকে দেখে আরেকজন সাহস পায়, উৎসাহ পায়। একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করে। এতে বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে চাওয়ার চেয়েও পাওয়া হয়ে যায় বেশি। এই করোনার মধ্যে সবাই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন,
শুধু করোনা নয়, এই সময়ে বন্যা ও বৃষ্টি আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। তবে এসব কিছুর মধ্যেও অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতি হয়েছে।’ ড. জায়েদ বখত বলেন,

আমাদের কনজুমার কনফিডেন্ট’ বাড়লেও আমরা রিকভারিতে এখনও যেতে পারিনি। ফলে ক্ষতি পোষাতে আরও সময় লাগবে। ’

অর্থনীতি যে সচল হয়েছে, তার উদাহরণ গত জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণে আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থনীতি সচল হওয়ার আরেকটি সূচক রফতানিতে আগস্ট মাসে আগের বছরের আগস্টের তুলনায় ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্ট মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেই গত মাসে ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের বছরের আগস্টে যা ছিল ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আর অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে জুলাইয়ে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। শুধু তা-ই নয়, করোনা মহামারির মধ্যেও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার আরেকটি উপাদান হলো জিডিপির প্রবৃদ্ধি। বিসিএসের হিসাবে করোনাভাইরাসের মধ্যেও গেলো ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জন হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয়ও দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে ২০৬৪ ডলারে উঠেছে। এই সূচকগুলো মূলত অর্থনীতি সচল হওয়ার নির্দেশক।

এছাড়া সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গতি পেয়েছে। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে এডিপি কার্যক্রমে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।

মানুষের কর্মচাঞ্চল্য যে ফিরে এসেছে তার প্রমাণ সড়কে আগের মতোই যানজট দেখা যাচ্ছে। আগের মতো চায়ের স্টল, কফি শপ, হোটেল-রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। ভিড় বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও। আমদানি করা নতুন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে বন্দরে। আবার অনেক জাহাজ রফতানি পণ্য নিয়ে বন্দর ছেড়েও যাচ্ছে বিদেশে। এছাড়া কৃষি খাতে করোনার কোনও প্রভাব পড়েনি। করোনাকালেও স্বাভাবিকভাবে চলেছে কৃষি খাতের কর্মকাণ্ড। প্রধান প্রধান ফসল, গবাদিপশু, মাছের উৎপাদন ও বিপণনে সমস্যা হয়নি। ফলে অর্থনীতি জেগে উঠছে।

অবশ্য শীতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির পূর্বাভাস ভাবিয়ে তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাকেই তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। কারণ, করোনাভাইরাস এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মানুষের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও আছে।

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, শীতে করোনা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, তা সত্যি হলে রাজস্ব আদায় আবারও শ্লথ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ, মার্চে করোনা মোকাবিলায় লকডাউন দেওয়ায় পুরো অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ে ভোগ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়ে। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত জুন মাসে আগের বছরের জুনের তুলায় রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর জুলাই মাসে আগের বছরের জুলাই মাসের তুলনায় সরকারের আয় কমে যায় ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

তবে সবকিছু খুলে দেওয়ার পর থেকে অর্থনীতি চাঙা হওয়া শুরু করে। এর ফলে আগস্ট মাসে সরকারের আয় বেড়ে যায়। এনবিআরের তথ্য বলছে, মাসওয়ারি ভিত্তিতে আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায়ের তিন খাত—আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও মাসওয়ারি লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। লক্ষ্যের তুলনায় কম আদায় করেছে ছয় হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

খাতভিত্তিক রাজস্ব আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত দুই মাসে আমদানি শুল্ক আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভ্যাট ও আয়কর তুলনামূলক কম আদায় হয়েছে। কাস্টম হাউসের মধ্যে রাজস্ব আয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউসে। আগস্টে ঢাকা কাস্টমসে আদায় হয়েছে ৩৭৬ কোটি টাকার রাজস্ব, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৭০ কোটি টাকা। কমলাপুর আইসিডিতে আগস্টে আদায় হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা, গত বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ২১১ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আমদানি শুল্ক আদায়কারী চট্টগ্রাম কাস্টমস এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে আমদানি-রফতানি শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট এক লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা লাখ ধরা হয়।

যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব আয়ের এই লক্ষ্যকে যৌক্তিকীকরণ করতে বাজেটের আগেই অর্থ সচিবকে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের শুরুতে দুর্যোগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্থানীয় ও বৈদেশিক অর্থনীতির ওপর রেখে যাওয়া বিপুল প্রতিক্রিয়ায় আশানুরূপ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না।

শেয়ার করুন

x
English Version

স্বাভাবিক গতি ফিরছে অর্থনীতিতে, সব সূচক ঊর্ধ্বমুখী

আপডেট: ০৯:৩৮:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

করোনা মহামারির ধাক্কায় বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সব খাতে গতি থেমে গিয়েছিল। দীর্ঘ ৬ মাস স্থবিরতা কাটিয়ে স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। গতি ফিরেছে কর্মচাঞ্চল্যেও। সচল হয়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য এমনটিই বলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শিল্প খাত তথা রফতানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে পণ্য-বাণিজ্য। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও আসছে রেকর্ড পরিমাণ। ঘুরে দাঁড়িয়েছে শেয়ারবাজারও। ব্যাংকের লেনদেন চলছে অনেকটা স্বাভাবিক সময়ের মতোই। এর ফলে সরকারের আয়ও বেড়ে গেছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো যে গতিশীল হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রতিবেদনে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরের শুরুতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত দুই বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের (২০১৯ সালের ) আগস্টে রাজস্ব আয়ের কোনও প্রবৃদ্ধিই ছিল না। উল্টো আগের বছরের (২০১৮ সালের) তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৫ শতাংশ। আর ২০১৮ সালের আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

এনবিআরের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে ১৫ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে এনবিআর—যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেকোনও আগস্ট মাসের চেয়ে বেশি।

অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের (২০১৯) আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের আগস্টে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, করোনাকালে দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এরইমধ্যে উদ্যোক্তারা এই প্যাকেজের টাকা নেওয়া শুরু করেছেন। এই প্যাকেজের টাকা নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন গার্মেন্টস মালিকরা। পাশাপাশি করোনার মধ্যেও কারখানা চালু রাখার কারণে ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৈরি পোশাক খাত। গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা—সবই চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সব পক্ষের প্রচেষ্টার ফলে।’ এত অল্পদিনে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোকে বাঙালির ঐতিহ্যগত কারণ বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, যেকোনও সংকট অনেক সময় সুযোগ তৈরি করে। তিনি উল্লেখ করেন, যখন সবাই বিপদগ্রস্ত হয়, তখন সবাই একসঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করে। একজনকে দেখে আরেকজন সাহস পায়, উৎসাহ পায়। একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করে। এতে বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে চাওয়ার চেয়েও পাওয়া হয়ে যায় বেশি। এই করোনার মধ্যে সবাই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন,
শুধু করোনা নয়, এই সময়ে বন্যা ও বৃষ্টি আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। তবে এসব কিছুর মধ্যেও অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতি হয়েছে।’ ড. জায়েদ বখত বলেন,

আমাদের কনজুমার কনফিডেন্ট’ বাড়লেও আমরা রিকভারিতে এখনও যেতে পারিনি। ফলে ক্ষতি পোষাতে আরও সময় লাগবে। ’

অর্থনীতি যে সচল হয়েছে, তার উদাহরণ গত জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণে আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থনীতি সচল হওয়ার আরেকটি সূচক রফতানিতে আগস্ট মাসে আগের বছরের আগস্টের তুলনায় ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্ট মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেই গত মাসে ১৯৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগের বছরের আগস্টে যা ছিল ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আর অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে জুলাইয়ে ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। শুধু তা-ই নয়, করোনা মহামারির মধ্যেও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার আরেকটি উপাদান হলো জিডিপির প্রবৃদ্ধি। বিসিএসের হিসাবে করোনাভাইরাসের মধ্যেও গেলো ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জন হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয়ও দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে ২০৬৪ ডলারে উঠেছে। এই সূচকগুলো মূলত অর্থনীতি সচল হওয়ার নির্দেশক।

এছাড়া সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গতি পেয়েছে। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে এডিপি কার্যক্রমে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।

মানুষের কর্মচাঞ্চল্য যে ফিরে এসেছে তার প্রমাণ সড়কে আগের মতোই যানজট দেখা যাচ্ছে। আগের মতো চায়ের স্টল, কফি শপ, হোটেল-রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। ভিড় বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও। আমদানি করা নতুন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে বন্দরে। আবার অনেক জাহাজ রফতানি পণ্য নিয়ে বন্দর ছেড়েও যাচ্ছে বিদেশে। এছাড়া কৃষি খাতে করোনার কোনও প্রভাব পড়েনি। করোনাকালেও স্বাভাবিকভাবে চলেছে কৃষি খাতের কর্মকাণ্ড। প্রধান প্রধান ফসল, গবাদিপশু, মাছের উৎপাদন ও বিপণনে সমস্যা হয়নি। ফলে অর্থনীতি জেগে উঠছে।

অবশ্য শীতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির পূর্বাভাস ভাবিয়ে তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাকেই তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। কারণ, করোনাভাইরাস এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মানুষের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও আছে।

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, শীতে করোনা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, তা সত্যি হলে রাজস্ব আদায় আবারও শ্লথ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ, মার্চে করোনা মোকাবিলায় লকডাউন দেওয়ায় পুরো অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ে ভোগ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যার প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়ে। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত জুন মাসে আগের বছরের জুনের তুলায় রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর জুলাই মাসে আগের বছরের জুলাই মাসের তুলনায় সরকারের আয় কমে যায় ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

তবে সবকিছু খুলে দেওয়ার পর থেকে অর্থনীতি চাঙা হওয়া শুরু করে। এর ফলে আগস্ট মাসে সরকারের আয় বেড়ে যায়। এনবিআরের তথ্য বলছে, মাসওয়ারি ভিত্তিতে আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায়ের তিন খাত—আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও মাসওয়ারি লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। লক্ষ্যের তুলনায় কম আদায় করেছে ছয় হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

খাতভিত্তিক রাজস্ব আয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত দুই মাসে আমদানি শুল্ক আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভ্যাট ও আয়কর তুলনামূলক কম আদায় হয়েছে। কাস্টম হাউসের মধ্যে রাজস্ব আয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউসে। আগস্টে ঢাকা কাস্টমসে আদায় হয়েছে ৩৭৬ কোটি টাকার রাজস্ব, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৭০ কোটি টাকা। কমলাপুর আইসিডিতে আগস্টে আদায় হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা, গত বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ২১১ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আমদানি শুল্ক আদায়কারী চট্টগ্রাম কাস্টমস এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে আমদানি-রফতানি শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট এক লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা লাখ ধরা হয়।

যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব আয়ের এই লক্ষ্যকে যৌক্তিকীকরণ করতে বাজেটের আগেই অর্থ সচিবকে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের শুরুতে দুর্যোগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্থানীয় ও বৈদেশিক অর্থনীতির ওপর রেখে যাওয়া বিপুল প্রতিক্রিয়ায় আশানুরূপ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হবে না।