উচ্চ সুদহারে পুঁজিবাজার ছেড়ে ব্যাংকে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা: মমিনুল ইসলাম

- আপডেট: ১২:০৬:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১০৫৮৫ বার দেখা হয়েছে
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বর্তমান চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম, যিনি ২০১২ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসিতে যোগ দেন। গত বছরের (২০২৪) জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট বা আইবিএ থেকে স্নাতক পাস করেন। সবশেষে ২০১৭ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ভাইস চ্যান্সেলর স্বর্ণপদকসহ স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে মমিনুল ইসলাম সিলিংক অ্যাডভাইজরি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি কৌশলগত আর্থিক উপদেশ, বিনিয়োগ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং কৌশলগত রূপান্তরে কাজ করে। সম্প্রতি মমিনুল ইসলাম অর্থনীতি বিষয়ক দেশের জনপ্রিয় নিউজপোর্টাল বিজনেস জার্নালকে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে লেনদেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার মূল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
মমিনুল ইসলাম: অনেক দিনের অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে মার্কেট সংকোচিত হয়ে পড়েছিল। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা চলে গিয়েছিল, একটা আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। সেই আতঙ্ক থেকে বাজার বের হয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু মার্কেটের কিছু ফান্ডামেন্টাল ব্যাপার থাকে, সেগুলো যদি ঠিক না হয়, ভালো শেয়ার যদি বাজারে না আসে, বিনিযোগকারীরা যদি না আসে, আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমি (সামষ্টিক অর্থনীতি) যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো যদি ঠিক না হয় তবে পুঁজিবাজার ভালো হবে না। আমরা বাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। ভালো মানের শেয়ার আনতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা খুব আশাবাদি দীর্ঘমেয়াদে মার্কেট শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে মানি মার্কেটে ট্রেজারি বিল, বন্ডে ইন্টারেস্ট রেট অনেক হাই। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় একটি অংশ মানি মার্কেটের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তার সাথে সাথে অতিতে যে অনিয়মগুলো হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান কমিশন শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে যেসব বিনিয়োগকারী এসব অনিয়মের সাথে জড়িত ছিলেন, তারাও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এসব কারণে পুঁজিবাজারে বর্তমানে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে ম্যাক্রা ইকোনোমিতে আমরা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করছি। আমাদের অর্থনীতির সাথে পুঁজিবাজারের টার্নওভার সামঞ্জন্যপূর্ণ না। তবে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে এবং বাজারের টার্নওভারেও প্রত্যাশিত উন্নয়ন হবে বলে আমি আশাবাদি।
বিজনেস জার্নাল: শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক মন্দার পেছনে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কোন ফ্যাক্টরগুলো বেশি দায়ী?
মমিনুল ইসলাম: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। অফিশিয়াল এবং আনঅফিশিয়াল রেটের মধ্যে যখন একটা পার্থক্য দেখা দেয়, তখন তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না। ইনফ্লেশনের (মুদ্রাস্ফীতি) কারণে অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে বিমুখ হচ্ছেন। এফডিআর, ট্রেজারি বিল, বন্ডে ইন্টারেস্ট রেট অনেক বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে মানি মার্কেটে বিনিয়োগ করছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ডলার রেট বা টাকার মানটা একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে যাচ্ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টেও অনেক বেড়েছে। পুঁজিবাজার আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাচ্ছে।
বিজনেস জার্নাল: গুজব এবং বাজার ম্যানিপুলেশনরোধসহ বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জগুলো কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
মমিনুল ইসলাম: বর্তমানে গুজব বা বাজার ম্যানিপুলেশনের ব্যাপারে ডিএসই অনেক সজাগ। বর্তমানে ডিএসই গুজব বা ম্যানিপুলেশন দেখার সাথে সাথে জড়িতদের সতর্ক করছে। শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। সেই সাথে বিএসইসিকে জানানো হচ্ছে। এসব ব্যাপারে আগামীতে বিনিয়োগকারীদের সচেতন ও প্রশিক্ষিত করা হবে। যেন কোনো গুজবে কান দিয়ে বিনিয়োগ তারা না করে।
তিনি বলেন, গুজবে কান দিয়ে ইনভেস্ট (বিনিয়োগ) করার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। মার্কেটে আমরা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের সক্রিয় করার চেষ্টা করছি। যেসব কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) অথবা কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারে (কিউআইও) আসবে, সেসব কোম্পানির ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট (অর্থনৈতিক প্রতিবেদন) সম্পর্কে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মাধ্যমে যেনো সঠিক তথ্য পায় বিনিয়োগকারীরা। বিভিন্ন সিএফএ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্টরা যখন কোম্পানির ব্যাপারে সঠিক তথ্য দেবেন, তখন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হবেন। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।
আরও পড়ুন: বিদ্যমান সুদহার বাজার স্থিতিশীলতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা: সাইফুল ইসলাম
বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা এবং সহযোগিতার মাত্রা কী?
ব্যাংকিং খাত সরকারের কাছে যতোটা মূল্যায়িত হয়, পুঁজিবাজার তেমন মূল্যায়িত হয় না, অবহেলিত হয়। পুঁজিবাজারের আকারের কারণে এমনটি হয়। কিন্তু এটার যে পটেনশিয়াল বা নেসেসিটি রয়েছে, সেটা চিন্তা করে হলেও ব্যাংকিং খাতের চেয়ে বেশি না হলেও সমানভাবে পুঁজিবাজারকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমরা খুশি যে, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা পুঁজিবাজার নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও আমাদের সহযোগিতা করছে। সরকার পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা নতুন কমিশনের ভূমিকা কতোটা কার্যকর? অর্থাৎ ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
মমিনুল ইসলাম: কোনো বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে যেমন ঝুঁকিও থাকবে, তেমনি বড় ধরনের রিটার্ন পাওয়ারও সুযোগ থাকবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ মার্কেট ফ্রেন্ডলি কিছু রেগুলেশন তৈরি করা। যাতে সবাই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসতে হবে। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। কেউ যাতে এই মার্কেটে ম্যানিপুলেশন বা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ে জড়িয়ে না পড়েন, সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দেখ-ভাল করতে হবে। আর্টিফিশিয়ালি (কৃত্রিমভাবে) বিনিয়োগকারীদের প্রটেকশন দিলেই মার্কেট তার গতিধারা হারাবে। মার্কেটের যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিও আমরা হারিয়ে ফেলবো।
আমরা অতিতে দেখেছি, ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছে, রোড শো করেছে। এগুলো রেগুলেটরের কাজ না। রেগুলেটরের কাজ হচ্ছে মার্কেট ফ্রেন্ডলি ইফিশিয়েন্সি তৈরি করা। যারা রেগুলেশনের ভায়োলেট করবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা। এতে করে মার্কেটের স্টেকহোল্ডাররা নিজেদের কাজ সঠিকভাবে করতে আগ্রহী হবে। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
বর্তমান কমিশন যেসব কাজ করা উচিত নয়, সেসব কাজ করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। অতিতে যেসব ম্যানিপুলেশন হয়েছে, সেসব ব্যাপারে শাস্তি প্রদান করেছে। পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। ভালো শেয়ার যাতে মার্কেটে আসে সে ব্যাপারে কমিশন চেষ্টা করছে। আমি আশাবাদি নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান কমিশনের পদক্ষেপগুলো দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজার সুফল পাবে।
বিজনেস জার্নাল: বর্তমান সময়ে বিএসইসি এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মধ্যে সমন্বয় কতোটা কার্যকর?
মমিনুল ইসলাম: অনেক বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। ৫ আগস্টের আগে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর কার্যক্রম ধীরে ধীরে বিএসইসি নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ নেই। বরং খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কমিশন স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে সঠিকভাবে করতে বলছে। স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বর্তমান কমিশন কাজ করছে।
বিজনেস জার্নাল: ডিএসইর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আপনার প্রস্তাবিত কোনো নতুন নীতি রয়েছে কী?
মমিনুল ইসলাম: কোম্পানিগুলো যে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে, সেগুলোর প্রতি আমরা নির্ভরশীল হতে পারি না। এজন্য একটা উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছি আমরা। যদিও এই উদ্যোগ এখনও আলাপ-আলোচনার মধ্যেই রয়েছে। যখন কোনো কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, তখন লাইভ ব্রডকাস্টের মাধ্যমে সেই কোম্পানিকে প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন করবে বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডাররা। এতে করে ওই কোম্পানির সচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। যখন কোনো কোম্পানি আইপিও বা কিউআইতে আসবে তখনও তাদের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে পাবলিকলি প্রশ্ন করা যায় কি-না, সে বিষয়টিও আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।
বিজনেস জার্নাল: ডিএসইর বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য লুকানো, সার্ভিল্যান্সের দায়িত্বপ্রাপ্তদের খামখেয়ালিপনা ও ইনসাইডার ট্রেডিংসহ সফটওয়্যারের ত্রুটির কারণে বারংবার লেনদেনের বিঘ্ন ঘটা অন্যতম। আপনার নেতৃত্বাধীন ডিএসই কি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের এসব অভিযোগের সূরাহা করতে পারবে?
মমিনুল ইসলাম: বর্তমানে ইনসাইডার ট্রেডিং করে ডিএসইতে এখন কেউ পার পাবে না। আমাদের বোর্ড থেকে ম্যানেজমেন্ট টিমকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি আমাদর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। আমাদের সফটওয়্যারের যেসব ত্রুটি রয়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য বাহিরের একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ-আলোচনা করছি। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, রিসোর্স ক্যাপাসিটি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরিতে আমরা কাজ করছি। ডিএসইর নেতৃত্ব স্থানীয় পজিশনগুলোতে যে শুণ্যতা রয়েছে, সেগুলো আমরা দূর করে ফেলবো। এরপর আমাদের রিফর্ম কার্যক্রমটা আরও বেশি গতিশীলতা আসবে। বোর্ড সুশাসন নিশ্চিত করবে, গাইডেন্স দেবে। কিন্তু রিফর্মের মূল কাজটা করবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
তিনি বলেন, ডিএসইতে বর্তমানে পেশাদার চার্টার্ড একাউন্টেন্ট নেই। রেগুলেটরি সুপারভিশন, লিস্টিং অ্যাফেয়ার্স, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রক পেশাদার না। এসব ঘাটতি নিয়ে আমরা বেশি দূর এগোতে পারবো না। এগুলো খুব দ্রুতই ঠিক করতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারে প্রযুক্তির ব্যবহার কতোটা আধুনিক হয়েছে? বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও উন্নত ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম সরবরাহে কী পরিকল্পনা রয়েছে? এছাড়া লেনদেন প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা আনতে কী ধরনের প্রযুক্তি বা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে?
মমিনুল ইসলাম: পুঁজিবাজারের প্রযুক্তির ব্যবহার অবশ্যই আধুনিক হয়েছে। কিন্তু এর সুফলটা মার্কেট পাচ্ছে কিনা, সেটি হচ্ছে বড় প্রশ্ন। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সফেসটিক্যাটেড ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছি আমরা। আমাদের সার্ভিলেন্স সলিউশন, অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সলিউশন স্ট্যান্ডার্ড পর্যায়ে রয়েছে। আমরা এখনও মার্কেট ইকোসিস্টেম বেস্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারিনি। ফলে প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের যে সচ্ছতা আসতে পারতো, সেটির সুযোগ নিতে পারিনি। এখনো অনেকে স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করেন না। অনেক ব্যাংক এই ধরনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। অনেক ব্রোকারেজ হাউজের রিয়েল টাইমে ট্রানজেকশন করার সক্ষমতা তৈরি হয়নি। আমরা এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আমরা স্টেপ বাই স্টেপ এগোচ্ছি। এছাড়াও আমাদের সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ (সিসিবিএল) যদি কার্যক্রম শুরু করে, তবে মার্কেটের একটা বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বিজনেস জার্নাল: আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমানোর জন্য ডিএসইর নতুন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কী?
মমিনুল ইসলাম: আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি তখনই তৈরি, যখন কোনো কোম্পানি মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিগুলোর মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে আসার প্রবণতা যতদিন না বন্ধ হবে, ততদিন পর্যন্ত এই ঝুঁকি থাকবে। আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছি, কোনো কোম্পানি আইপিও অথবা কিউআইওতে যখন আসবে তখন ডিএসই একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, যেখানে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্টেক হোল্ডাররা কোম্পানিগুলোকে তাদের সক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করবে, কোম্পানিগুলো যদি সন্তোষজনক উত্তর দেয় এবং ডিএসই যদি মনে করে কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা রয়েছে পুঁজিবাজারে আসার, তবেই ডিএসই তাদেরকে তালিকাভুক্তির অনুমতি দেবে, অন্যথায় নয়।
আরও পড়ুন: ব্যাংক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যাংকিং আইনের সংস্কার প্রয়োজন: আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া
বিজনেস জার্নাল: স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বড় কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানোর জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
মমিনুল ইসলাম: অতিতে আমরা দেখেছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট সাবমিট করে তালিকাভুক্তির বিনিময়ে বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতে করে বাজারের কাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা সরকারি-বেসরকারি ভালো মানের কোম্পানির সাথে আলোচনা করছি পুঁজিবাজারে আনার জন্য। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির দীর্ঘসূত্রিতা দূর করতে, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ট্যাক্সের পার্থক্য বাড়াতে কাজ করছি। এসব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে, আশা করছি অনেক ভালো মানের কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে পারবো।
বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে স্টক এক্সচেঞ্জ কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে?
মমিনুল ইসলাম: আমাদের মার্কেটে পলিসি কনসিস্ট্যান্সির বড়ই অভাব ছিল। বিদেশিরা ফ্লোর প্রাইসের উপর ভীষণ বিরক্ত ছিলো। ডলার রেট স্ট্যাবল ছিল না। যে কারণে তারা বাজারে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত ছিল। তবে অতিতের সমস্ত অনিয়ম দূর করে, পলিসির কনসিস্ট্যান্সি আনতে আমরা কাজ করছি। ডলারের রেটটাও মোটামুটি বর্তমানে স্ট্যাবল অবস্থায় রয়েছে। ভালো মানের আইপিও আনতে আমরা কাজ করছি। যারা নন রেসিডেন্স বাংলাদেশি (এনআরবি) রয়েছেন, তারা কিভাবে বাজারে সহজেই বিনিয়োগ করতে পারবেন, সেসব নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি খুব শিগগিরই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন এবং বাজারে প্রচুর বিনিয়োগ করবেন।
বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
মমিনুল ইসলাম: প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমাদের মার্কেটে যতোগুলো ভালো মানের শেয়ার থাকা দরকার ততগুলো নেই, পাশাপাশি অধিকাংশ কোম্পানির ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট ঠিক না। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মিউচুয়াল ফান্ডগুলো একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ছোট ছোট ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে করে তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ডের উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে গঠিত টাস্কফোর্স টিম আমাদের যে পর্যবেক্ষণ দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ করতে পারলে, আশা করি বাজারে বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীদের চ্যালেঞ্জ অনেকাংশে দূর হবে।
আরও পড়ুন: মোট রফতানির ৫০ শতাংশই ক্রাউন সিমেন্টের দখলে: মাসুদ খান
বিজনেস জার্নাল: জাঙ্ক শেয়ারগুলো কিভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং এগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে কী উদ্যোগ নেওয়া হযেছে?
মমিনুল ইসলাম: আমরা কমবেশি সকলেই জানি কোন শেয়ারগুলো জাঙ্ক শেয়ার। যেসব কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করে না, আর্থিকভাবে দুর্বল, ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে, সেগুলোকে আমরা জাঙ্ক শেয়ার বলে থাকি। এসব জাঙ্ক শেয়ারগুলোকে ডি-লিস্টিং (তালিকাচ্যুত) করলে বাজারের জন্য ভালো হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীর জন্যও ভালো হবে। সেসব শেয়ারগুলোকে আমরা ডি-লিস্টিং করতে কাজ করে যাচ্ছি। পাশের দেশ ভারতের ডি-লিস্টিং পদ্ধতিটি আমরা অনুসরণ করছি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে এসব শেয়ারগুলোকে চিহ্নিত করে ডি-লিস্টিং করা হবে।
বিজনেস জার্নাল: বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশি পুঁজিবাজার কী ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন?
মমিনুল ইসলাম: বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের সাথে আমাদের কোনো প্রতিযোগিতা নেই। কারণ তাদের তুলনায় আমাদের পুঁজি খুবই ছোট। যেসব দেশে রিটার্ন ভালো পাবে, সেফটি অনুভব করবে, সেসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশে যদি ইকোনোমি গ্রো করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। ল এন্ড অর্ডার, বিচার ব্যবস্থা যদি সন্তোষজনক হয়, তবে বৈশ্বিক পুঁজি এদেশে আসবেই। যখন পুঁজি আসবে, তখন ফাইন্যান্সিয়ালসহ সব সেক্টরেই বিনিয়োগ আসবে।
বিজনেস জার্নাল: দেশের মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার পুঁজিবাজারে কিভাবে প্রভাব ফেলছে?
মমিনুল ইসলাম: কিছুদিন আগেও দেশের মুদ্রাস্ফীতি যথেষ্ট বেশি ছিল। কিন্তু এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ট্রেজারি বিল, বন্ডে ইন্টারেস্ট রেটটা বেশি থাকার কারণে ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে বিনিয়োগ মানি মার্কেটে চলে যাচ্ছে। আমরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করছি।
বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকি কমানোর পরামর্শ কী
মমিনুল ইসলাম: মুক্তবাজার অর্থনীতির সুন্দরতম সৃষ্টি পুঁজিবাজার। যেসব কোম্পানির সুশাসন নেই, অর্থনেতিক কার্যক্রম দুর্বল, সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। যেসব কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে দক্ষ লোক রয়েছে, সুশাসন রয়েছে, যারা দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে কাজ করছে, সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাবো।
বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মমিনুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ঢাকা/টিএ