খাদের কিনারায় লোকসানি কোম্পানি বিবিএস’র ব্যবসা!

- আপডেট: ০৯:৫৭:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১১০২০ বার দেখা হয়েছে
দীর্ঘদিন ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস পিএলসি (বিবিএস) বর্তমানে ব্যবসায়িকভাবে খাদের কিনারে এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে লোকসানে থাকা কোম্পানিটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তা যদি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকে, তবে আগামীতে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব খুঁজে পেতে টর্চ লাইট ব্যবহার করতে হবে বিনিয়োগকারীদের, এমনটাই মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি ব্যবসায়িকভাবে ভালো করছে না। এর মূল কারণ, কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক ও ম্যানেজমেন্টের লুটপাট। প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা নিজেদের স্বার্থে অন্য কোথাও ব্যবহার করেছে বা ব্যবহার করছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।
তারা আরও বলেন, বিবিএস’র মতো পুঁজিবাজারে বেশ কিছু কোম্পানি রয়েছে, যারা বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাকে রুগ্ন করেছে। তারা প্রতিষ্ঠানের প্রফিট বিদেশে পাচার করে ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে ভোগবিলাস করে বেড়াচ্ছে। আর অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করে কপাল পড়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।
বিজনেস জার্নালের সাথে এ বিষয়ে আলাপকালে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, বিবিএস কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীরা ডিভিডেন্ড পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু কোম্পানিটি সদ্য বিদায়ী বছরে (৩০ জুন ২০২৪) বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দেয়নি। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানির এ ধরনের কর্মকান্ড অবশ্যই বাজারের উপর নেগেটিভ প্রভাব ফেলছে। এছাড়া এসব কোম্পানির কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত কোম্পানিটিকে তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বিজনেস জার্নালকে বলেন, বিবিএস এক সময় যথেষ্ট ভালো কোম্পানি ছিল। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে কোম্পানিটি ব্যবসায়িকভাবে রুগ্ন হয়ে গিয়েছে। কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ঠিকভাবে ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা ব্যবসার টাকা ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করেনি। নিজেদের স্বার্থে টাকা তছরুপ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজমেন্টেরও যথেষ্ট ভুল রয়েছে। যে কারণে কোম্পানিটির আজ বেহাল দশা। উদ্যোক্তা পরিচালক ও ম্যানেজমেন্টের অসততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীরা।
তিনি বলেন, আমরা ডিলিস্টিং ব্যবস্থার রিফর্ম করছি। এই ধরনের কোম্পানিগুলোকে তালিকাচ্যুত করে কিভাবে কঠোর শাস্তি প্রদান করা যায়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে যেসব বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কিভাবে সর্বোচ্চ বেনিফিটেড করা যায়, সে বিষয়টিও আমরা দেখভাল করছি।
আরও পড়ুন: বিএসইসি চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদকে লিগ্যাল নোটিশ
বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস পিএলসির কোম্পানি সচিব মো. সোহেল বিজনেস জার্নালকে বলেন, করোনা মহামারির সময় থেকেই আমাদের ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো না। আমরা রিকভারি করার চেষ্টা করছি। আশা করছি আগামীতে ব্যবসা রিকভার করতে পারবো।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সদ্য বিদায়ী বছরের জন্য অনুমোদিত ডিভিডেন্ড নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিতরণ না করায় কোম্পানিটিকে ‘বি’ থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। বিএসইসির নির্দেশনা অনুসারে, মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে বিবিএসের শেয়ার ক্রয়ের জন্য স্টক ব্রোকার এবং মার্চেন্ট ব্যাংকারদের থেকে ঋণ সুবিধা প্রদান বন্ধ থাকবে।
ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকীতে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান করেছে ০.৪৪ টাকা। এর আগের বছরের একই সময়ে লোকসান হয়েছিল ০.৪০ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান বেড়েছে ০.০৪ টাকা।
‘জে’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করা কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০২৩ হিসাব বছরে শেয়ার প্রতি লোকসান করেছিল ১.০১ টাকা। সে বছরেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো প্রকার ডিভিডেন্ড প্রদান করেনি।
আর সদ্য বিদায়ী বছরে শেয়ার প্রতি ০.০৭ টাকা মুনাফা করে ০.৫০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। কিন্তু সেটিও পরবর্তীতে দেয়নি কোম্পানিটি। আর ২০২১ ও ২০২২ অর্থবছরে নামমাত্র যথাক্রমে ২ ও সাড়ে ৩ শতাংশ ডিভিডেন্ড প্রদান করেছে বিবিএস।
তথ্য বিশ্লেষনে আরও জানা গেছে, গত এক বছরে বিবিএসের শেয়ার দর অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বছরের (২০২৪) ৫ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৮ টাকা। আর মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) তা এসে দাঁড়িয়েছে ১০.৫০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে শেয়ার দর কমেছে ৭.৫ টাকা। অর্থাৎ ৪২ শতাংশ শেয়ার দর কমেছে।
কোম্পানিটির গত কয়েক বছরের মুনাফা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে লোকসান করেছে ৩ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ২০২২ সালে প্রফিট করেছে ২৬ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে কোম্পানিটি আবারও লোকসান করে, যার পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর সদ্য বিদায়ী বছরে নামমাত্র ১ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রফিট করেছে।
উল্লেখ্য, বিবিএসের অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ১৬ কোটি ২৯ লাখ ২৯ হাজার ৭৩২টি; যার মধ্যে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ অনুযায়ী উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে শেয়ার রয়েছে ৩০.০১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২২.৪১ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ০.০৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৭.৫৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ঢাকা/টিএ