জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমেছে ও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে নির্ধারণ

- আপডেট: ০১:৪৪:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ১০৩১৬ বার দেখা হয়েছে
সাম্প্রতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আর্থিক সংকট, ব্যবসায়িক স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে যা হাসিনা সরকার এ হার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
এদিকে অক্টোবর থেকে মূল্যস্ফীতি ২ অঙ্কে অবস্থান করছে। আশা করা হচ্ছে, অর্থবছরের শেষে এটি কিছুটা কমে ৯ শতাংশে নামবে। তবে চলতি অর্থবছরের জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তৈরি করা বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
গতকাল (২ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের এক সভায় এসব তথ্য উপস্থাপন করেন। সভায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বাদ দিয়ে বাজেট ৩০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সাত লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায় প্রাক্কলন করা হয়েছে। একইসঙ্গে আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক বাজেট আট লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ কম হলেও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।
সভার সূত্রমতে, এটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বাজেট বৃদ্ধির উদাহরণ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সভায় শুধু বাজেট সংশোধনের বিষয়ে নয়, ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার দিকেও বেশ গুরুত্ব আলোচনা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়গুলোকে আরও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও স্বীকার করেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাস্তবসম্মত হবে না।
গত ১ জুলাই শুরু হওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণীত হয়েছিল। এরপর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকারের পতনের পর অর্থবছরের ১ মাস ৮ দিনের মাথায় ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। স্থানীয় ঠিকাদারেরা কাজ বন্ধ করে দেন এবং বিদেশি অনেক ঠিকাদার দেশ ছেড়ে চলে যান। সেপ্টেম্বরে কিছু প্রকল্প পুনরায় শুরু হলেও অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এডিপি থেকে আরও সাশ্রয় করা সম্ভব হলেও ঋণের সুদ পরিশোধ, বিক্ষোভে হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা এবং অবকাঠামো মেরামতের জন্য বাড়তি ব্যয় দরকার হবে।
২০২৪–২৫ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি বন্ডে উচ্চ সুদের হার (১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত) এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি এর প্রধান কারণ। চলতি অর্থবছরে বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে দেশীয় ঋণের জন্য ৯৩ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের জন্য ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাখা হয়।
ওই কর্মকর্তা জানান, সরকার উন্নয়ন ব্যয় খুব বেশি কমাবে না। কারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলে তা অত্যন্ত ‘আশাবাদী’ হবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতির দিকে রয়েছে, তবুও গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও তার সুফল বাংলাদেশ পায় না।
আরও পড়ুন: ১৫ বছরে দেড় লাখ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে জনগণকে: টিআইবি
তিনি আরও বলেন, গত দুবছরে জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, লৌহজাত পণ্যের দাম অনেক কমলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এর কারণ আমাদের বিনিময় হার হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
‘এক-দেড় মাস ধরে বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে, মুদ্রানীতিও মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক। কিন্তু আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনের কারণ বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ও সরবরাহ ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতিতে বড় কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
৫ দশমিক ২৫ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আরও বেশি আশাবাদী বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হওয়ার পক্ষে মাত্র দুটি ইতিবাচক লক্ষণ আছে- রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং রপ্তানির ভালো অবস্থা। জুলাই–নভেম্বর পর্যন্ত রেমিটেন্স ১৪ শতাংশ বেড়েছে এবং অক্টোবরে রপ্তানি শক্তিশালী ছিল। তবে রাজস্ব আহরণ স্থবির, বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা শিল্পখাতকে স্থবির করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও ইতিবাচক ফলাফল বলে বিবেচিত হবে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের দ্বিতীয় সভা আগামী বছরের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং ২০২৫–২৬ অর্থবছরের নতুন বাজেট চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হবে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। অভ্যন্তরীণভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে এবং সরকারের ব্যয়েও কৃচ্ছ্রতা দেখা যাবে।
পাশাপাশি চীন ও ভারতসহ বড় আমদানি বাজারে মূল্যস্ফীতি কমলে আমদানি পণ্যের দাম কমবে বলেও প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে মোট আমদানি কমবে না, ফলে সরবরাহ বাড়বে।
এদিকে, রেমিট্যান্স প্রবাহে ১০–১২ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফ-এর (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যে রাখা সম্ভব হবে।
চলতি অর্থবছরে সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে চার বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করছে, যার মধ্যে দুই বিলিয়ন ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকার ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরের উৎস, যেমন সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারি বিলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
ঢাকা/এসএইচ