পুঁজিবাজারে কারসাজির নতুন ফাঁদ ভুয়া কেনাবেচার আদেশ
- আপডেট: ১১:৩৭:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১
- / ৭৫০৭ বার দেখা হয়েছে
পুঁজিবাজারে তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লেনদেন শুরু হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। লেনদেনের প্রথম দিন ১১ টাকা থেকে ১৪ টাকা দরে তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ হাজার শেয়ার বিক্রির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সময় কোম্পানিটির শেয়ারের কোনো ক্রেতা ছিল না। সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট.কম
তারপরও হঠাৎ করে সর্বোচ্চ ১৫ টাকা দরে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫০৯টির শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে। ভুয়া কেনার আদেশের কারণে শেয়ারটি ক্রেতার অভাবে হল্টেড ছিল। অর্থাৎ যেখানে ১১ টাকা দরে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির শেয়ার কিনছে না, সেখানে দাম বাড়াতে ১৫ টাকায় বিক্রির আদেশ দিয়ে বিনিয়াগকারীদের বিভ্রান্ত করা হয়। ক্রেতাদের বেশি দামে শেয়ার কেনাতে প্রলুব্ধ করা হয়।
ঠিক তার পরদিন একই শেয়ার ২০ টাকা দরেও বিক্রির আদেশ দেয় চক্রটি। কিন্তু দর বেশি হওয়ায় কোনো বিনিয়োগকারী সেদিনও শেয়ার কেনার আদেশ দেয়নি। তারপরও দাম বাড়াতে নতুন করে ২২ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১ কোটি ৪ লাখ ২৪ হাজার ৯৩৮টি শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে। অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়াতে বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দরে শেয়ার বিক্রির আদেশ দেওয়া হয়। একই কায়দায় তৃতীয় দিন এ কোম্পানির শেয়ার ৩০ টাকা পর্যন্ত উঠানো হয়। বাজারে গুজব ছাড়নো হয়, এ শেয়ারটি ৫০ টাকায় পর্যন্ত যাবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারটি কিনতে শুরু করে। আর চক্রটি হাতে থাকা তাদের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করে।
এভাবেই দেশি কোম্পানি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে শুরু করে সর্বশেষ তালিকাভুক্ত হওয়া লাভেলো ব্রান্ডের তৌফিকা ফুডসের শেয়ারে কারসাজি করেছে চক্রটি। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের যোগসাজশে গড়া এ চক্রটি কারসাজির জন্য বেছে নিয়েছে নতুন করে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোকে। এ ফাঁদে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হাজার হাজার কোটি টাকার পুঁজি হারাচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের কেউ না বুঝেই, আবার কেউ কেউ অতিলোভে পড়ে বিনিয়োগ করছেন। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে এ তথ্য মিলেছে।
এ চক্র নতুন কোম্পানিতে দুটি কৌশলে কারসাজি করছে। এর মধ্যে একটি কৌশল হচ্ছে – আইপিওতে পাওয়া শেয়ার বেশি দামে বিক্রির জন্য কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রথম কয়েক দিন বেশি দরে শেয়ার কেনার জন্য ফেক (ভুয়া) বড় বড় আদেশ দিচ্ছে। কখনো ওই দরের কাছাকাছি আসার পর শেয়ার কেনার আদেশ বাতিল করছে।
আবার কখনো পরিকল্পনা অনুসারে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দরে শেয়ার কেনার জন্য আদেশ দিচ্ছে। অথচ তারা শেয়ারগুলো বিক্রি করবেন। বাজারের গুজব ছড়িয়ে দেয় এ শেয়ারে ৩-৫ গুণ লাভ হবে, ধরে রাখেন। প্রথম কয়দিন বিক্রেতার অভাবে হল্টেড হয় শেয়ারটি। বিক্রেতারা শেয়ার বিক্রি থেকে বিরত থাকেন। সাধারণ ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে শেয়ার কিনতে শুরু করেন। এ সুযোগে কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউজের চক্রটি তাদের পরিকল্পনা অনুসারে শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়।
তাদের দ্বিতীয় কৌশলটি হচ্ছে- কম দামে শেয়ার কেনা। প্রথমে কোন কোম্পানির শেয়ার কিনবে তা ঠিক করে তারা। তারপর কত দামে কিনবে তা ঠিক করেই চক্রটি নতুন কোম্পানির শেয়ার বাজার মূল্যের চেয়ে কম দরে কেনার জন্য কোটি কোটি ভুয়া কেনার আদেশ দেয়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে দেয় এই বলে যে শেয়ারের দাম কমে যাবে। তখন শেয়ার বিক্রিতে চাপ বাড়ে। এ সুযোগে তারা অল্প দামে শেয়ার কিনে নেয়। তাদের শেয়ার ৬০-৭০ শতাংশ কেনা হলেই আবার এসব শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। এবার শুরু হলো বিক্রেতার অভাবে হল্টেড।
বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার স্বার্থে নতুন এ কৌশলের মাধ্যমে কারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ফতুর করছে তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, বিষয়টি তারা সার্ভেইল্যান্স যন্ত্রের মাধ্যমে খতিয়ে দেখছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি কোম্পানি এবং ইস্যু ম্যানেজারদের কেউ জড়িত রয়েছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, শেয়ার কম কিংবা বেশি দরে কেনা-বেচার আদেশ দেওয়ার নিয়ম আছে। তারা তাদের ব্যবসার জন্য উপযুক্ত সময়ে কেনার আদেশ দেবেন, আবার বিক্রির সময় হলে বেচার আদেশ দেবেন। এটা করার রাইট আছে তাদের। বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবে, তারা বুঝে শুনে বিনিয়োগ করলেই পারে।
বাজারের এ ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোস্তাক আহমেদ সাদেক। তিনি বলেন, নতুন কোম্পানিগুলোতে ভুয়া অর্ডার দিয়ে কখনও শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আবার কখনও কমানো হচ্ছে। বাজারে এ কাজটা করছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। কমিশনের সার্ভেইল্যান্স যন্ত্রে কারা এ কাজ করছে তা তো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কমিশন কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদে সিদ্দিক এ তথ্য জেনে অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ ম্যানুপুলেশন। এটা অস্বাভাবিক ঘটনা। কমিশনের উচিৎ এদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে আইপিওর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে যাত্রা শুরু করে মীর আক্তার হোসেন কোম্পানি। যাত্রার দ্বিতীয় দিনে ৩ ফেব্রুয়ারি লেনদেনের শুরুতে হলটেড করতে সর্বোচ্চ ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে শেয়ার কেনার আদেশ দেয় আইডিএলসি সিকিউরিটিজের দুজন বিনিয়োগকারী। তাকে সহযোগিতা করেন আইডিএলসির একজন ট্রেডার। শুধু তাই নয় বাজারে গুজব ছড়ানো হয়, শেয়ারটি ২০০ টাকায় কেনা-বেচা হবে।
এ ঘটনা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরে আসার পর ওই দুই বিনিয়োগকারীর বিও (বেনিফিশারি ওনার্স) হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়। পাশাপাশি দুই জনকে সহযোগিতার করায় আইডিএলসির ট্রেডারের (অনুমোদিত প্রতিনিধি) অনুমোদন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে এ ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু চক্রটি থেমে নেই। তারা ৪ ফেব্রুয়ারি আবারও একই কাজ করে।
৪ ফেব্রুয়ারি মীর আক্তার হোসেনের শেয়ার যখন ৯৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঠিক তখন এ গ্রুপটি ১১০ টাকা ২০ পয়সা দরে ৫ হাজার ৬০৩টি শেয়ার কেনার আদেশ দেয়। আরেকজন ক্রেতা ১ হাজার শেয়ার কেনার আদেশ দিয়েছেন ১০৫ টাকা দরে। অর্থাৎ বাজার দরের চেয়ে ১৩ টাকা বেশি দর হাঁকিয়ে কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ানো চেষ্টা করা হয়। এভাবেই নতুন দুই কোম্পানিতে চক্রটি শেয়ারের দাম বাড়াতে কারসাজি করেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফ উদ্দিন বলেন, মূল লেনদেনের আগেই আমাদের দুজন গ্রাহক এ শেয়ার কেনার আদেশ দিয়েছিলেন। আমরা সেই শেয়ার কেনার আদেশ সাবমিট করেছি। আমাদের কাজই হলে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ দেওয়া।
বাজার মূলধনের দিক থেকে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেড। কোম্পানিটি ২৪ ডিসেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেদিন থেকে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের কোম্পানির শেয়ারের দাম টানা ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বেড়ে ৭০ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এ সময়ে প্রায় দিনই লাখ লাখ ভুয়া শেয়ার কেনার আদেশ বসানো হতো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার এ আদেশগুলো উধাও হয়ে যেত। বাজারে গুজব ছাড়নো হত জানুয়ারি মাসেই রবির শেয়ার ২০০ টাকায় লেনদেন হবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অতিলোভে বেশি দামে শেয়ার কিনেছেন। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের হাতে থাকা ১ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
আবার এ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই কম দামে শেয়ার কেনার জন্য ২১ জানুয়ারি থেকে বাজার দরের চেয়ে কম দামে লাখ লাখ শেয়ার কেনার জন্য আদেশ দেয়, যাতে বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে কম দামে শেয়ার বিক্রি করে। এ দিন হঠাৎ করে একটি বিও অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৮টি শেয়ার বিক্রির আদেশ দেওয়া হয় ৫৮ টাকা ১০ পয়সায়। অথচ ওইদিন রবির শেয়ারের বাজার দর ছিল ৬৩ টাকার অর্থাৎ লেনদেন হচ্ছিল ৬৩ টাকায়।
এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই শেয়ার বিক্রির আদেশটি বাতিল করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে ক্রেতা শূন্য হয়ে পড়ে রবির শেয়ার। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শুরু হয় কানাঘুষা, হাউজে হাউজে শুরু হয় গুজব রবির শেয়ার বিক্রি হবে ৫০ টাকায়। আর তাতে কোম্পানির শেয়ারের দাম কমতে থাকে।
একইভাবে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, ওয়ালটন, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, ডমিনেজ স্টিল, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স এবং এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির শেয়ারে দাম বাড়ানো ও কমানোর কারসাজিতে অংশ নেয় চক্রটি।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের যোগসাজশে একটি চক্র গড়ে উঠেছে বলে আমরা মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। আমরা এগুলো যাচাই-বাছাই করছি। এখন থেকে সব কোম্পানির শেয়ারের লেনদেনে কারসাজি হচ্ছে কিনা তা নজরদারিতে রাখছি।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে আইডিএলসি সিকিউরিটিজের দুজন বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব জব্দ করেছি। এ দুই বিনিয়োগকারী মীর আক্তার হোসেনের শেয়ার কারসাজির লক্ষ্যে লেনদেন শুরু আগেই সর্বোচ্চ দামে কেনার আদেশ দেয়। বিষয়টি বিএসইসির সার্ভেইল্যান্স বা তদারকি যন্ত্রে ধরা পড়ে। প্রাথমিকভাবে দুই বিনিয়োগকারীর হিসাব জব্দ করেছি। আইডিএলসির বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রতিবেদন পেলে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনার্জিপ্যাক, রবির শেয়ারে এসব ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন:
- দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের আইপিও আবেদন শেষ আজ
- কপারটেকের ক্রেডিট রেটিং সম্পন্ন
- ৭ অথবা ১১ তারিখে পোর্টফলিওতে শেয়ার থাকলেই পতেঙ্গায় বিডিং করতে পারবে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা
- বিএটিবিসি ১৯২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে
- বিডি ফাইন্যান্সের লভ্যাংশ ঘোষণা
- IDLC’s dividend announcement
- IPDC dividend declaration
- The government fixed the price of soybean oil
- ‘All the Prime Minister’s Men’ removed from online
- Lub-Ref’s IPO lottery on February 23
- Arrest warrants against Khaleda and Gayeshwar
- Institutions are withdrawing more investment from Robi
- Even if the school is closed, the primary students will get rice and pulses
- Central bank’s inquiry committee into allegations of bribery scandal
- ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত কমিটি