প্রসপেক্টাসে অসঙ্গতি ও অতিরঞ্জিত তথ্য নিয়েই পুঁজিবাজারে আসছে দুয়ার সার্ভিসেস- পর্ব: ১

- আপডেট: ১০:৪৭:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫
- / ১০৭১৭ বার দেখা হয়েছে
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর প্রসপেক্টাসে অনিয়ম, অতিরঞ্জিত তথ্য কিংবা গোঁজামিল দিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থা ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখানো কোন নতুন ঘটনা নয়। গত ১৫ বছরে যেসব কোম্পানি মূল মার্কেটে কিংবা এসএমই মার্কেটে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার অধিকাংশই এখন বাজার এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য বোঁঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে দেশে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, তারপর হয়তো এমন দিন আর দেখতে হবে- তা মোটেও ভাবেননি বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
তবে অকল্পনীয় হলেও সত্য যে, আবারও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এমন কিছুই ঘটতে যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এসএমই মার্কেটে কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে দুয়ার সার্ভিসেস পিএলসিকে ৫ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিবারই আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোর অনিয়ম গণমাধ্যমে আসার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলে থাকে তারা ডিসক্লোজার ভিত্তিক আইপিও অনুমোদন দিয়ে থাকে। তাই কোম্পানি বাস্তবিক অর্থে কোন মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত তথ্য প্রসপেক্টাসে প্রদর্শন করলে তা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে ইস্যু ম্যানেজার বলে তারা অডিটরস রিপোর্ট বেইজড কাজ করে, তাই এর দায় তাদের না। আর অডিটরসের খোড়া যুক্তি তারা ইস্যুয়ার কোম্পানি প্রদত্ত তথ্য স্যাম্পল বেইজড যাচাই করে, তাই তাদেরও পুরোপুরি দায় দেয়া যায় না।
তবে দায়টা কার- এ নিয়ে গত ১৫ বছরে প্রশ্ন কম ওঠে নি, কিন্তু কোন উত্তর মেলেনি। এরই ধারাবাহিকতায় এসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে বিজনেস জার্নাল দুয়ার সার্ভিসেস পিএলসির প্রসপেক্টাস বা ডিসক্লোজারভিত্তিক তথ্য নিয়ে যাচাই-বাছাই বা অনুসন্ধান শুরু করে। দু:খের বিষয় এই ডিসক্লোজার ভিত্তিক তথ্য উপাত্তে খালি চোখে যেসব অতিরঞ্জিত তথ্য এবং অসঙ্গতি বিজনেস জার্নালের অনুসন্ধানী দলের সামনে এসেছে, তা কেন অডিটর, ইস্যু ম্যানেজার, স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখে পড়লো না-তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আরও পড়ুন: বিনিয়োগকারীদের ঝুঁলিতে লোকসান: কর্মীদের আয় বেড়েছে ২০৯ শতাংশ
দুয়ার সার্ভিসের প্রসপেক্টাস বিশ্লেষনে যেসব অসঙ্গতি সামনে এসেছে বা কোম্পানির যেসব এক্টিভিটিজের বোঝা ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের টেনে নিতে হবে, সেগুলো নিয়ে করা পাঁচ পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো।
ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মুনাফা দেখানো দুয়ার সার্ভিসেসের প্রসপেক্টাসে নানা আর্থিক অসঙ্গতিপূর্ণ ও অতিরঞ্জিত তথ্য প্রদর্শন করা হয়েছে। কোম্পানিটি বছরের ব্যবধানে পরিশোধিত মূলধন ও ব্যয় বহুগুনে বাড়িয়ে দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়, আর্থিক প্রয়োজনে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাইলেও কোম্পানিটি বিভিন্ন কোম্পানি ও অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাতে করে রেখেছে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ। এছাড়াও কোম্পানি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগভিত্তিক জ্ঞান বা পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার অযোগ্যতার কারণেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তা বিনিয়োগকারীদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়াবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কোম্পানির নেট ইনকাম গ্রোথ তিন বছরের ব্যবধানে ১৩২ শতাংশ থেকে -২.৮৮ শতাংশ (ঋণাত্মক) নেমে আসলেও কোম্পানি তার পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়িয়েছে ১০৭ শতাংশেরও বেশি। দুয়ার সার্ভিসেসের প্রসপেক্টাসের ২৮ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ৩০ জুন ২০২২ শেষে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিলো ২৭১ জন, যা ২৬ জন কমে ৩০ জুন ২০২৩ এ ২৪৫ এ নেমে এসেছে। ২০২২ সালে তাদের বেতন ২ কোটি ৮৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৩৪ টাকা হলেও ২০২৩ সালে তা ৪ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ৭৭৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সে হিসেবে লোকবল ২৬ জন কমলেও এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৫ টাকা। যা এ খাতে মোট ব্যয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালে লোকবল ২৪৫ জন এবং ব্যয় ৪ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ৭৭৯ টাকা হলেও ৩০ জুন ২০২৪ সালে লোকবল ২৫৫ জন এবং তাদের ব্যয় ৬ কোটি ৮০ লাখ ২২ হাজার ৮৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সে হিসেবে লোকবল বেড়েছে মাত্র ১০ জন। অথচ এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৭১ টাকা। যা এ খাতে মোট ব্যয়ের ৪৭.৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশে কিংবা বিশ্বের কোন দেশের কোন প্রতিষ্ঠানেই এভাবে বেতন বাড়ানোর নজির নেই।
তালিকাভুক্তির আগের বছরগুলোতেই ঠিক কি কারণে বা কোন যুক্তিতে অস্বাভাবিকভাবে বেতন বাড়ানো হলো- তা জানতে বিজনেস জার্নালের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছিল কোম্পানির দায়িত্বরত একাধিক ব্যক্তির কাছে। কিন্তু কোন সদুত্তর মেলেনি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার কোম্পানির নির্বাহী র্পরিচালক সৈয়দ আহমেদ রসুলকে ফোন করে বিজনেস জার্নাল টিম, কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে তার হোয়াটসঅ্যাপে প্রসপেক্টাসে উল্লেখিত ১২টি অসঙ্গতির বিষয়ে মতামত জানতে চাইলেও তিনি রিপ্লাই করেননি।
এছাড়া বিজনেস জার্নালের পক্ষ থেকে কোম্পানির অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জিয়াউল হকের কাছে ওই একই বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে তিনি ফরমালি কোম্পানিটির ইস্যু ম্যানেজার আলফা ক্যাপিটালের কাছে প্রশ্ন পাঠানোর কথা বলেন।
ইস্যু ম্যানেজার নয়- ইস্যুয়ার কোম্পানি হিসেবে এসব অসঙ্গতি নিয়ে তাদেরই মতামত প্রয়োজন উল্লেখ করে ফিরতি মেসেজ দেয়া হলেও তিনি আর কোন জবাব দেননি।
দুয়ার সার্ভিসেসের সামগ্রিক অসঙ্গতি নিয়ে ঢাকা ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বিজনেস জার্নালকে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ছিলো অনিয়ম, বৈষম্য, অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে। এখনও যদি সেই অনিয়ম চলতে থাকে তাহলেতো হবে না। এগুলোর জন্যতো হাজার হাজার ছাত্র জনতা জীবন দেয়নি বা এখনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে নাই।
তিনি বলেন, এসএমই মার্কেট গঠন হওয়ার পর একটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি, যারা ভালো করেছে। আসলে বর্তমান সময়ে যেভাবে এসএমই মার্কেট চলছে, এতে বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা বা কোম্পানির পকেট ভরা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য আছে বলে আমার মনে হয় না। কাজেই যতোক্ষন পর্যন্ত এসএমই মার্কেট রুলস পুরোপুরি রিভিউ বা রিফরমস না করা হবে, ততোক্ষন পর্যন্ত আর কোন কোম্পানিকে এ মার্কেটে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া উচিত হবে না বলে তিনি মনে করেন।
দুয়ার সার্ভিসেসের প্রসপেক্টাসের নানা অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিলো বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিমকে। জবাবে তিনি বলেন, ‘দুয়ার সার্ভিসেসের প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র ও নথি যথাযথ বিশ্লেষন করেই তাদেরকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।’ (চলবে…)
ঢাকা/এইচকেজে