শেয়ারবাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা
বিএসইসিতে শুদ্ধি অভিযান নাকি প্রশাসনিক দূর্বলতা!

- আপডেট: ০২:২৮:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫
- / ১০৬০৪ বার দেখা হয়েছে
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি এখন চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখার পরিবর্তে, এই সংস্থার ভেতরকার টানাপোড়েনই এখন সংবাদ শিরোনাম। কর্মকর্তাদের বিদ্রোহ, কমিশনের কঠোর অবস্থান, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ—এই সংকট কি শুদ্ধি অভিযানের ফল, নাকি এটি প্রশাসনিক সংকটের আরেকটি অধ্যায়?
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
সঙ্কটের সূচনা হয় ৪ মার্চ ২০২৫-এ, যখন বিএসইসির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। সাধারণত সরকারি সংস্থাগুলোতে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখানে বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। কমিশনের একাংশ এই সিদ্ধান্তকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখছে, আর অন্যপক্ষ বলছে এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের অংশ। সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরপরই সংস্থার অভ্যন্তরে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়, কর্মকর্তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং চার দফা দাবি উত্থাপন করেন।
কর্মকর্তাদের মূল দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—সাইফুর রহমানের বাধ্যতামূলক অবসর বাতিল, বিতর্কিত তদন্তের ভিত্তিতে জারি করা শোকজ প্রত্যাহার, ১২৭ জনের নিয়োগ সংক্রান্ত আপিল, এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি কমিশনের আচরণে পরিবর্তন আনা। এই দাবিগুলো যদি খতিয়ে দেখা হয়, তাহলে বোঝা যায় যে বিএসইসির অভ্যন্তরীণ সংকট দীর্ঘদিনের, এটি কেবল একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নয়।
অন্যদিকে, বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, এই আন্দোলন আসলে কমিশনের দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থানের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি ১২টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনিয়ম তদন্ত করেছে, যেখানে শেয়ারবাজারে কারসাজি এবং অবৈধ লেনদেনের নানা তথ্য উঠে এসেছে। এই তদন্তের ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে, কিছু কর্মকর্তা এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেদের বাঁচানোর জন্য বিদ্রোহে নেমেছে বলে তার দাবি।
আরও পড়ুন: বিএসইসি চেয়ারম্যান-কমিশনারদের পদত্যাগের দাবিতে কর্মবিরতি
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এই তদন্ত প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিবিরোধী হয়, তবে কেন এত প্রতিক্রিয়া? আর যদি কর্মকর্তাদের অভিযোগ সত্য হয়, তাহলে কি বিএসইসি আসলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, নাকি এর ভেতরেও রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়, তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—এই দ্বন্দ্বের ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই ভালো নয়।
ঘটনার ভয়াবহতা তখনই প্রকট হয়ে ওঠে, যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা কমিশনের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেন, সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন, এমনকি বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিএসইসির বোর্ড অবরুদ্ধ থাকে। নিরাপত্তা সংকট তৈরি হওয়ায় প্রথমে পুলিশ এবং পরে সেনাবাহিনী ভবন নিয়ন্ত্রণে নেয়। এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সংকট নয়; এটি প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে গভীর অসন্তোষ ও দুর্বলতার প্রতিফলন।
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে—বাধ্যতামূলক অবসর কি শুধুই প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ, নাকি এটি কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন স্তরে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ২০২৪ সালে ২২ জন জেলা প্রশাসককে একইভাবে অবসরে পাঠানো হয়েছিল, যা নিয়ে তখনও বিতর্ক তৈরি হয়। এটি কি কার্যকর শুদ্ধি অভিযান, নাকি প্রশাসনিক অস্থিরতার চিহ্ন? বিএসইসি’র এই সংকট সে প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে এসেছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন বিএসইসির সকল স্তরের কর্মকর্তা -কর্মচারীরা। অন্যদিকে, কার্যালয়ে আসেননি বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ও কমিশনাররা।
আরও পড়ুন: বিএসইসির কিছু উশৃঙ্খল কর্মকর্তা চেয়ারম্যান-কমিশনারদের অবরূদ্ধ করে
এই অস্থিরতার সরাসরি প্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে, বাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। শেয়ারবাজার মূলত আস্থার ওপর নির্ভরশীল, এবং যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাতেই এ ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তখন বাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসবেই। ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বাজার থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা আরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই সংকটের সমাধান কী? প্রথমত, একটি স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি, যা নির্ধারণ করবে কে সঠিক এবং কে ভুল। যদি কমিশনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য হয়, তবে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আবার, যদি কর্মকর্তাদের বিদ্রোহ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, তবে সেটিও কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা। প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে অসন্তোষ থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়।
তৃতীয়ত, বিএসইসির কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সংকট থেকে শিক্ষা নেওয়া। একটি রাষ্ট্র যখন তার নীতি-নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানে এমন অস্থিরতা দেখায়, তখন তা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু তা যদি হয় পক্ষপাতদুষ্ট, তাহলে সেটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে আরও বড় সংকট তৈরি করবে।
আরও পড়ুন: মাকসুদ কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে বিনিয়োগকারীদেরও বিক্ষোভ
এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিএসইসি’র এই সংকট দ্রুত সমাধান করতে না পারলে, এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা থাকবে না—এটি গোটা অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এখন সময় এসেছে দ্রুত, কার্যকর এবং ন্যায়সঙ্গত সমাধানের মাধ্যমে এই অনিশ্চয়তা দূর করার। অন্যথায়, পুঁজিবাজারের সংকট আরও গভীর হবে, যার মূল্য দিতে হবে গোটা দেশকে।
✍ লেখক: সম্পাদক, বিজনেস জার্নাল
সম্পাদনা: সম্পাদকীয় বিভাগ, বিজনেসজার্নাল২৪.কম