১০:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বিদ্যমান সুদহার বাজার স্থিতিশীলতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা: সাইফুল ইসলাম

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৫:৩৮:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ১০৭২৩ বার দেখা হয়েছে

সাইফুল ইসলাম, যিনি ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক। তিনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।  অতি সম্প্রতি তিনি বিজনেস জার্নালের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন, সুবিধা-অসুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।

বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কি কি?

সাইফুল ইসলাম: বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট আস্থার ঘাটতি আমরা লক্ষ্য করছি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক কমিশন ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার কারণে প্রায় দুই বছর এই মার্কেটে ঠিকভাবে ট্রেডিং হয়নি। এই ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার আগে মার্কেট ওভার ভ্যালুড ছিল এবং আর্টিফিসিয়ালি শেয়ারের প্রাইস বাড়ানো হয়েছিল। যখন কারেকশন শুরু হলো, তখন বিএসইসির সাবেক শিবলী কমিশন এই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিলো, যা ২০ মাস ধরে আরোপিত ছিল।

দীর্ঘ এই সময়ে অধিকাংশ শেয়ারে ট্রেডিং না হওয়ার কারণে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেইসঙ্গে চলমান রাজনৈতিক ও নানাবিধ অনিশ্চয়তায় বর্তমানে আস্থার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। পরিণতিতে বাজার ওভার কারেকশন হচ্ছে এবং বাজারে নেগেটিভ রিটার্ন তৈরি হচ্ছে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদহার ১২  শতাংশ। কিন্তু পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ১২ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। গত ১০ থেকে ১৫  বছরে আমাদের মূল্যস্ফীতির তুলনায় পুঁজিবাজার নেগেটিভ রিটার্ন দিয়েছে। বাজারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিনিয়োগ নাই বললেই চলে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিই ভালো অবস্থায় নেই। বাজারে গুণগত মানসম্পন্ন কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হবে। নতুন প্রাথমিক গণ প্রস্তাব (আইপিও) আনতে হবে। বড় কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিজনেস জার্নাল: বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?

সাইফুল ইসলাম: আন্ডার ভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি বলবো না। ১০ থেকে ২০ শতাংশ শেয়ার প্রাইস সঠিক রয়েছে। কিছু আন্ডারভ্যালু স্টক রয়েছে। তবে বেশিরভাগ শেয়ার বা স্টক প্রাইস ওভার ভ্যালুড অবস্থায় রয়েছে। যেমন অনেক ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকবে কি না- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অথচ সেসব ব্যাংকের শেয়ার ১০/১২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের শেয়ার ওভার ভ্যালুড অবস্থায় রয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কি?

সাইফুল ইসলাম: বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিলেকশন অব স্টক। বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি না কি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করবে, এটা নির্ধারণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাজারে প্রোডাক্ট ভ্যারাইটিজ অনেক কম। এই বাজারে স্টক সিলেক্ট করা খুবই ডিফিকাল্ট। এই বিষয়টি সহজ করার জন্য বাজারের পরিধি ও গভীরতা আরও বাড়াতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন বাজারের উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারছে কি। কোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?

সাইফুল ইসলাম: বিএসইসির বর্তমান কমিশনকে আমরা আরও একটু সময় দিতে চাই। এই কমিশন আনুমানিক সাড়ে তিন মাস হলো দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এই কমিশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এখনই তাদের কাজের মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। তবে বাজারে অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য আমরা ক্রমাগত সংশ্লিষ্টদের বলে যাচ্ছি।

এছাড়া আমাদের মার্জিন ট্রেডিং, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইপিও রুলস এবং স্টক প্রাইসিংয়ে নতুন রেগুলেশন আনতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

সাইফুল ইসলাম:  বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাদের মধ্যে যদি আস্থা না থাকে, তবে মার্কেট কখনোই ভালো হবে না। পুঁজিবাজার মানেই হচ্ছে আস্থা। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। যতো তারাতারি আমরা এই কাজটি করবো ততোই বাজারের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে। ডিএসই, সিএসই ও বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?

সাইফুল ইসলাম: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট যতটা কাজে আসা উচিত ছিল ততোটা আসেনি। এই আইনটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। বিগত সময়ে যেসব স্বতন্ত্র পরিচালককে এখানে আনা হয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনীতি কিংবা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিলো। ফলে উনারা সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি।

তবে এই আইনটি পরিবর্তন করা আমাদের প্রধান দাবি। এই আইনের মাধ্যমে বিএসইসির কাছে সব ক্ষমতা চলে গিয়েছে এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলো ফাংশনাল হয়নি। এখন আইন পরিবর্তন করে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে ফাংশনাল করতে হবে।

আরও পড়ুন: দুদকের জালে বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ

বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? ইদানিং শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করছে করছে। কি কারণে ছাটাই করা হচ্ছে?

সাইফুল ইসলাম: বাজারের চলমান মন্দায় সিকিউরিটিজ হাউজগুলো অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য যে খরচ হচ্ছে, সেটি উঠানো যাচ্ছে না। ঋণ করে খরচ চালাতে হচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে যদি এ রকম চলতে থাকে, তাহলে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো টিকে থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ইতিমধ্যে অপারেটিং কষ্ট উঠাতে না পারায় অনেক সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করেছে এবং এটাই স্বাভাবিক। মুলত ব্যয় অনুযায়ী আয় না আসায় এর প্রধান কারণ। দিনশেষে তাদেরতো টিকে থাকতে হবে। তবে আমি এখনও পর্যন্ত আমার হাউজের কাউকে ছাটাই করিনি।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগগুলো কি কি?

সাইফুল ইসলাম: গত ১৫  বছরে আনুমানিক দেড়’শো আইপিও বাজারে এসেছে। এসব আইপিও’র ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই নিম্নমানের। কোনো বাজারে যদি পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকে, তবে সেই বাজার অস্থিতিশীল হবে।

বিএসইসি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অডিটরসহ যারা এসব আইপিও নিয়ে এসেছেন, তারা কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না। যেকোনো ইক্যুইটি বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকবে। ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোম্পানির তথ্য ভালোভাবে জেনে যদি প্রপারলি বিনিয়োগ করা যায়, তবে রিটার্ন আসার সম্ভাবনা থাকে।

বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষণীয়। এই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

সাইফুল ইসলাম: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আমাদের পুঁজিবাজার এখনও আকর্ষনীয় পর্যায়ে যেতে পারেনি। এখানে ভালো স্টকের পরিমাণ নেই বললেই চলে। এছাড়া এই বাজারের গভীরতা খুব কম। গভীরতা যদি বাড়বে, বাজার ততোই আকর্ষণীয় হবে। অবশ্যই বড় বড় ফান্ডামেন্টাল কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?

সাইফুল ইসলাম: মূল্যস্ফীতি যদি থাকে তবে যেকোনো বাজারে রিটার্ন জেনারেট করা খুব মুশকিল হবে। ১২ শতাংশ যদি সুদ হয় আর মূল্যস্ফীতি যদি ১৫ শতাংশ হয়, তবে পুঁজিবাজার থেকে রিটার্ন জেনারেট হবে না। রিটার্ন জেনারেট করতে গেলে মূল্যস্ফীতি একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখতে হবে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা সেটার সুফল নিতে পারছি না। আমাদের এখানে যতোটুকু আগানো উচিত ছিল, আমরা ততোটুকু আগাতে পারিনি। বৈশ্বিক অর্থনীতির সুফল নিতে হলে রপ্তানিতে ভ্যারিয়েশন আনতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাজার খুঁজতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। নতুন পণ্য তৈরি করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কি এবং তাদের কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

সাইফুল ইসলাম: কারো কথা শুনে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। নিজে বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করতে হবে। বুঝে বিনিয়োগ না করলে ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে যাবে। কোনো গুজবে কান না দিয়ে নিজে অ্যানালাইসিস করে বিনিয়োগ করা উচিত। সবসময় বিনিয়োগের উপযু্ক্ত সময় থাকে। শুধু ভালো অ্যানাইলিস করে ভালো স্টকে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বর্তমান বাজারে কী সম্ভাবনা রয়েছে? বিনিয়োগকারীরা কিভাবে একটি  স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?

সাইফুল ইসলাম: এই বাজার স্বল্পমেয়াদি ঠিকভাবে রিটার্ন দিতে পারে না। আমাদের বাজার দীর্ঘমেয়াদের জন্যই উপযুক্ত। দীর্ঘমেয়াদে অপটিমাল রিটার্ন পাওয়ার জন্য অনেকগুলো স্টক রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের আগে পোর্টফোলিও ম্যানেজার বা অ্যানালিস্টদের সাথে কথা বলতে হবে। নিজেদের  সঠিক পন্থায় চেষ্টা করতে হবে। বেসিক বিষয়গুলো না জেনে বিনিয়োগে আসা ঠিক হবে না। এজন্য বিভিন্ন অ্যকাডেমিক কোর্স রয়েছে। তারা সেগুলো সম্পন্ন করতে পারে।

বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

সাইফুল ইসলাম: বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মার্জিন ট্রেডিংটা এড়িয়ে চলতে হবে। বিনিয়োগযোগ্য টাকা কখনোই ৫০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। কারণ পুঁজিবাজার সব সময় ঝুঁকি থাকে। বিনিয়োগকারীদের এটা মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকৃত পুঁজিটা আপনার, তাই দিনশেষে এর নিরাপত্তার দায়িত্বও আপনার। লোভের বশবর্তী কিংবা গুজবে কান না দিয়ে, জেনে ও বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সাইফুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ঢাকা/টিএ

শেয়ার করুন

x

বিদ্যমান সুদহার বাজার স্থিতিশীলতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা: সাইফুল ইসলাম

আপডেট: ০৫:৩৮:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ জানুয়ারী ২০২৫

সাইফুল ইসলাম, যিনি ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক। তিনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।  অতি সম্প্রতি তিনি বিজনেস জার্নালের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উত্থান-পতন, সুবিধা-অসুবিধাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।

বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কি কি?

সাইফুল ইসলাম: বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট আস্থার ঘাটতি আমরা লক্ষ্য করছি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক কমিশন ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার কারণে প্রায় দুই বছর এই মার্কেটে ঠিকভাবে ট্রেডিং হয়নি। এই ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার আগে মার্কেট ওভার ভ্যালুড ছিল এবং আর্টিফিসিয়ালি শেয়ারের প্রাইস বাড়ানো হয়েছিল। যখন কারেকশন শুরু হলো, তখন বিএসইসির সাবেক শিবলী কমিশন এই ফ্লোর প্রাইস আরোপ করেছিলো, যা ২০ মাস ধরে আরোপিত ছিল।

দীর্ঘ এই সময়ে অধিকাংশ শেয়ারে ট্রেডিং না হওয়ার কারণে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেইসঙ্গে চলমান রাজনৈতিক ও নানাবিধ অনিশ্চয়তায় বর্তমানে আস্থার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। পরিণতিতে বাজার ওভার কারেকশন হচ্ছে এবং বাজারে নেগেটিভ রিটার্ন তৈরি হচ্ছে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদহার ১২  শতাংশ। কিন্তু পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ১২ শতাংশ রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। গত ১০ থেকে ১৫  বছরে আমাদের মূল্যস্ফীতির তুলনায় পুঁজিবাজার নেগেটিভ রিটার্ন দিয়েছে। বাজারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিনিয়োগ নাই বললেই চলে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানিই ভালো অবস্থায় নেই। বাজারে গুণগত মানসম্পন্ন কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হবে। নতুন প্রাথমিক গণ প্রস্তাব (আইপিও) আনতে হবে। বড় কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিজনেস জার্নাল: বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?

সাইফুল ইসলাম: আন্ডার ভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি বলবো না। ১০ থেকে ২০ শতাংশ শেয়ার প্রাইস সঠিক রয়েছে। কিছু আন্ডারভ্যালু স্টক রয়েছে। তবে বেশিরভাগ শেয়ার বা স্টক প্রাইস ওভার ভ্যালুড অবস্থায় রয়েছে। যেমন অনেক ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকবে কি না- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অথচ সেসব ব্যাংকের শেয়ার ১০/১২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের শেয়ার ওভার ভ্যালুড অবস্থায় রয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কি?

সাইফুল ইসলাম: বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সিলেকশন অব স্টক। বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি না কি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করবে, এটা নির্ধারণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাজারে প্রোডাক্ট ভ্যারাইটিজ অনেক কম। এই বাজারে স্টক সিলেক্ট করা খুবই ডিফিকাল্ট। এই বিষয়টি সহজ করার জন্য বাজারের পরিধি ও গভীরতা আরও বাড়াতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন বাজারের উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারছে কি। কোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?

সাইফুল ইসলাম: বিএসইসির বর্তমান কমিশনকে আমরা আরও একটু সময় দিতে চাই। এই কমিশন আনুমানিক সাড়ে তিন মাস হলো দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এই কমিশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এখনই তাদের কাজের মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। তবে বাজারে অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য আমরা ক্রমাগত সংশ্লিষ্টদের বলে যাচ্ছি।

এছাড়া আমাদের মার্জিন ট্রেডিং, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইপিও রুলস এবং স্টক প্রাইসিংয়ে নতুন রেগুলেশন আনতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

সাইফুল ইসলাম:  বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাদের মধ্যে যদি আস্থা না থাকে, তবে মার্কেট কখনোই ভালো হবে না। পুঁজিবাজার মানেই হচ্ছে আস্থা। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। যতো তারাতারি আমরা এই কাজটি করবো ততোই বাজারের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে। ডিএসই, সিএসই ও বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?

সাইফুল ইসলাম: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট যতটা কাজে আসা উচিত ছিল ততোটা আসেনি। এই আইনটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। বিগত সময়ে যেসব স্বতন্ত্র পরিচালককে এখানে আনা হয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনীতি কিংবা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিলো। ফলে উনারা সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি।

তবে এই আইনটি পরিবর্তন করা আমাদের প্রধান দাবি। এই আইনের মাধ্যমে বিএসইসির কাছে সব ক্ষমতা চলে গিয়েছে এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলো ফাংশনাল হয়নি। এখন আইন পরিবর্তন করে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে ফাংশনাল করতে হবে।

আরও পড়ুন: দুদকের জালে বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ

বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? ইদানিং শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করছে করছে। কি কারণে ছাটাই করা হচ্ছে?

সাইফুল ইসলাম: বাজারের চলমান মন্দায় সিকিউরিটিজ হাউজগুলো অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য যে খরচ হচ্ছে, সেটি উঠানো যাচ্ছে না। ঋণ করে খরচ চালাতে হচ্ছে। দীর্ঘসময় ধরে যদি এ রকম চলতে থাকে, তাহলে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো টিকে থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ইতিমধ্যে অপারেটিং কষ্ট উঠাতে না পারায় অনেক সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করেছে এবং এটাই স্বাভাবিক। মুলত ব্যয় অনুযায়ী আয় না আসায় এর প্রধান কারণ। দিনশেষে তাদেরতো টিকে থাকতে হবে। তবে আমি এখনও পর্যন্ত আমার হাউজের কাউকে ছাটাই করিনি।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগগুলো কি কি?

সাইফুল ইসলাম: গত ১৫  বছরে আনুমানিক দেড়’শো আইপিও বাজারে এসেছে। এসব আইপিও’র ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই নিম্নমানের। কোনো বাজারে যদি পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকে, তবে সেই বাজার অস্থিতিশীল হবে।

বিএসইসি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অডিটরসহ যারা এসব আইপিও নিয়ে এসেছেন, তারা কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না। যেকোনো ইক্যুইটি বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকবে। ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোম্পানির তথ্য ভালোভাবে জেনে যদি প্রপারলি বিনিয়োগ করা যায়, তবে রিটার্ন আসার সম্ভাবনা থাকে।

বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষণীয়। এই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

সাইফুল ইসলাম: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আমাদের পুঁজিবাজার এখনও আকর্ষনীয় পর্যায়ে যেতে পারেনি। এখানে ভালো স্টকের পরিমাণ নেই বললেই চলে। এছাড়া এই বাজারের গভীরতা খুব কম। গভীরতা যদি বাড়বে, বাজার ততোই আকর্ষণীয় হবে। অবশ্যই বড় বড় ফান্ডামেন্টাল কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?

সাইফুল ইসলাম: মূল্যস্ফীতি যদি থাকে তবে যেকোনো বাজারে রিটার্ন জেনারেট করা খুব মুশকিল হবে। ১২ শতাংশ যদি সুদ হয় আর মূল্যস্ফীতি যদি ১৫ শতাংশ হয়, তবে পুঁজিবাজার থেকে রিটার্ন জেনারেট হবে না। রিটার্ন জেনারেট করতে গেলে মূল্যস্ফীতি একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখতে হবে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা সেটার সুফল নিতে পারছি না। আমাদের এখানে যতোটুকু আগানো উচিত ছিল, আমরা ততোটুকু আগাতে পারিনি। বৈশ্বিক অর্থনীতির সুফল নিতে হলে রপ্তানিতে ভ্যারিয়েশন আনতে হবে। পাশাপাশি নতুন বাজার খুঁজতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। নতুন পণ্য তৈরি করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কি এবং তাদের কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

সাইফুল ইসলাম: কারো কথা শুনে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। নিজে বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করতে হবে। বুঝে বিনিয়োগ না করলে ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে যাবে। কোনো গুজবে কান না দিয়ে নিজে অ্যানালাইসিস করে বিনিয়োগ করা উচিত। সবসময় বিনিয়োগের উপযু্ক্ত সময় থাকে। শুধু ভালো অ্যানাইলিস করে ভালো স্টকে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বর্তমান বাজারে কী সম্ভাবনা রয়েছে? বিনিয়োগকারীরা কিভাবে একটি  স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?

সাইফুল ইসলাম: এই বাজার স্বল্পমেয়াদি ঠিকভাবে রিটার্ন দিতে পারে না। আমাদের বাজার দীর্ঘমেয়াদের জন্যই উপযুক্ত। দীর্ঘমেয়াদে অপটিমাল রিটার্ন পাওয়ার জন্য অনেকগুলো স্টক রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের আগে পোর্টফোলিও ম্যানেজার বা অ্যানালিস্টদের সাথে কথা বলতে হবে। নিজেদের  সঠিক পন্থায় চেষ্টা করতে হবে। বেসিক বিষয়গুলো না জেনে বিনিয়োগে আসা ঠিক হবে না। এজন্য বিভিন্ন অ্যকাডেমিক কোর্স রয়েছে। তারা সেগুলো সম্পন্ন করতে পারে।

বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

সাইফুল ইসলাম: বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মার্জিন ট্রেডিংটা এড়িয়ে চলতে হবে। বিনিয়োগযোগ্য টাকা কখনোই ৫০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। কারণ পুঁজিবাজার সব সময় ঝুঁকি থাকে। বিনিয়োগকারীদের এটা মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকৃত পুঁজিটা আপনার, তাই দিনশেষে এর নিরাপত্তার দায়িত্বও আপনার। লোভের বশবর্তী কিংবা গুজবে কান না দিয়ে, জেনে ও বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সাইফুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ঢাকা/টিএ