ব্যাংক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যাংকিং আইনের সংস্কার প্রয়োজন: আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া

- আপডেট: ১২:৫৭:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১১৬৬০ বার দেখা হয়েছে
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি) পিএলসি’র ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া। এর আগে তিনি ব্যাংকটিতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি স্যোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি এসআইবিএল ও ইসলামী ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং ডিভিশন, ডেভেলপমেন্ট উইং, রিটেইল ইনভেস্টমেন্ট উইং ও লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টে পেশাগত দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
১৯৮৯ সালে ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ইয়াহিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএল.বি (অনার্স) এবং এলএল.এম ডিগ্রী অর্জন করেন। সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ পথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে তিনি আমেরিকা, চীন, সিঙ্গাপুর, সৌদিআরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
গুণী এই ব্যক্তি সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের নানা বিষয় নিয়ে বিজনেস জার্নালের সাথে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
বিজনেস জার্নাল: বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সামগ্রিক অবস্থা কেমন?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এক সংকটকালীন সময় পার করছে। বিগত সরকারের সময়কালে দেশের ব্যাংকিং খাত নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত হয়েছে। এই অবস্থার উত্তরণের জন্য সময় প্রয়োজন। তবে আশার বিষয়, ব্যাংকিংখাতের দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। গ্রাহকের আতঙ্ক কেটেছে। আমানতও এখন ক্রমাগত বাড়ছে।
বিজনেস জার্নাল: সামগ্রিক বিবেচনায় আপনার ব্যাংকের অবস্থান কি?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে দেশব্যাপী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিগত পাঁচ মাসে ৫ লাখ ৭ হাজার নতুন অ্যাকাউন্টসহ ব্যাংকের বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ। ২০২৪ সালে এই ব্যাংকে ৯ লাখের অধিক নতুন হিসাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকের গ্রাহকের সেবার পরিধি ও মান উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ৫ মাসে ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা খেলাপি বিনিয়োগ আদায় হয়েছে এবং তা আদায়ে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহক চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমরা বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান ও অধিকহারে ব্যাংকিং ব্যবহারিক জ্ঞান বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের জন্যও আমরা গ্রাহকসেবা নির্ভর সকল পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। জনমানুষের কল্যাণমূখী নানা প্রোডাক্টস ও সেবা চালু করছি, বিভিন্ন সেবামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছি। আমাদের এসব কার্যক্রম সারা বছর জুড়েই অব্যাহত থাকবে।
বিজনেস জার্নাল: ব্যাংকিং খাতের দূর্নীতির কারণে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায় সাময়িক মন্থরতা থাকলেও আশার কথা হল, বর্তমানে আর্থিকখাতে অনিয়ম বন্ধ হয়েছে। আশাকরি, আর্থিকখাতে খুব শিগগিরই ইতিবাচক পরিবেশ ফিরে আসবে ।
বিজনেস জার্নাল: ব্যাংক খাতে দুর্নীতির প্রধান কারণগুলো কী?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: এক সময়ের দ্রুত অগ্রসরমান দেশের ব্যাংকখাত নানা দুর্নীতির কারণে বর্তমানে গভীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী। বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতের সমস্যার বা দুর্নীতির মূল কারণসমূহ হল- কর্পোরেট সুশাসনের অনুপস্থিতি, পুঁজির অভাব এবং তারল্য সংকট, অর্থনৈতিক চাপ এবং মূল্যস্ফীতি, নিরাপত্তার অভাব ও সাইবার ঝুঁকি, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নৈতিকতা ও পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি।
তাই ব্যাংকখাতে দুর্নীতি বন্ধ করতে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চত করা অতীব জরুরি। পাশাপাশি অর্থনীতির বিভিন্ন নিয়ামকগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: খেলাপি ঋণের কারণ ও প্রতিকার কী?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: বাংলাদেশে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির প্রবণতা বেশি। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ব্যাংক হতে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও বেশিরভাগ বিনিয়োগ মুষ্ঠিমেয় ব্যবসায়ীর কাছে গিয়েছে এবং উক্ত বিনিয়োগ যথাযথ নিয়মাচার মেনে বিতরণ করা হয়নি।
বর্তমানে ব্যাংকখাতে এসব মন্দ বিনিয়োগ আদায়ের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। জনগণের আমানত জনগণের কাছেই বিতরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুব শিগগিরই শক্তিশালী অবস্থানে ফিরে আসবে।
বিজনেস জার্নাল: খেলাপি ঋণের প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানে কেমন পড়ছে?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: খেলাপি বিনিয়োগের জন্য বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে সংকটাপন্ন অবস্থা বিরাজ করেছে। বিনিয়োগের মুনাফার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে, যার ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন খরচ। যার প্রভাব পরেছে অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমেও সাময়িক স্থবিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে, ক্রমান্বয়ে এ অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্য উন্নতি লাভ করছে।
বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দুর্নীতি কিভাবে বাধা সৃষ্টি করছে?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ হার আশাজনক নয়। পূর্বে একটি ব্যবসা স্থাপন করতে গেলে প্রতি পদক্ষেপে বাধা পেতে হতো। এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের হয়রানি, হুমকি, চাঁদাবাজির কারণে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়েছে। বর্তমানে এ দৌরাত্ম থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেছে দেশের আর্থিক খাত।
বিজনেস জার্নাল: ব্যাংকিং খাতে দূর্নীতি প্রতিরোধে কী ধরনের নীতিমালা প্রয়োজন?
আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া: ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ বেশি জরুরি। ব্যাংকিং আইনের সংস্কার প্রয়োজন। কনভেনশনাল ব্যাংক এবং ইসলামি ব্যাংকিং এর জন্য পৃথক আইন প্রয়োজন। শুধুমাত্র শেয়ারহোল্ডারদের থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য না এসে বিভিন্ন শ্রেণি থেকে পরিচালক আসতে হবে। কেন্দ্রিয় ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধায়নও লাগবে।
বিজনেস জার্নাল: মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে দুর্নীতি কমানোর সম্ভাবনা কতটা?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণকে আর্থিক অন্তর্ভূক্তি করানো সম্ভব। হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হলে দেশের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হয় না। তাই ডিজিটাল প্লাটফর্ম ও মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে লেনদেন হলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এ্যাপস ভিত্তিক ডিজিটাল ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংসেবা প্রদান করছে। আমাদের এফএসআইবি-ক্লাউড, ফার্স্ট ক্যাশ, কর্পোরেট ই-ব্যাংকিং, ডিক্লাউড, ফ্রিডম-বকণঈ এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন সেবাসমূহের মাধ্যমে সকল গ্রাহক সকল প্রকার ব্যাংকি সেবা, ইউটিলিটি বিল প্রদান, মোবাইল রিচার্জ, টিউশন ফি পেমেন্ট, মার্চেন্ট পেমেন্টসহ নানাবিধ সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন।
বিজনেস জার্নাল: আপনার ব্যাংকের কি বিশেষ প্রোডাক্ট গ্রাহকদের জন্য নিয়ে এসেছেন?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: শরী’য়াহ আলোকে জনসাধারনকে ব্যাংকিং সেবা দেয়ার পাশাপাশি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক দেশব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করে বিশেষ কিছু প্রোডাক্টস চালু করেছে। আমাদের রয়েছে ৪৪টি আমানত প্রোডাক্টস এবং ৩৫টিরও বেশি বিনিয়োগ প্রোডাক্টস ।
আমানত প্রোডাক্টসের মধ্যে- মুদারাবা বিশেষ মাসিক মুনাফা স্কিম (উৎসব-২৪), মুদারাবা স্মার্ট ডিপোজিট ডাবল স্কিম, মুদারাবা মেয়াদি ডিপোজিট একাউন্ট (এফএসআইবি সেঞ্চুরি), মুদারাবা এফএসআইবি স্মার্ট একাউন্ট, মুদারাবা মাসিক ডিপোজিট স্কিম (এফএসআইবি কেয়ার) অন্যতম।
“যে এলাকার আমানত সেখানেই বিনিয়োগ” এই প্রত্যয়ে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা সম্প্রসারণ, নারী উদ্যোক্তা তৈরি, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কৃষি বিনিয়োগ, শ্রম নির্ভর উৎপাদন খাত ও বৈদেশিক বাণিজ্যের খাতকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
বিজনেস জার্নাল: সুশাসনের উন্নয়নে ব্যাংকিং খাতে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া উচিত?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদ হতে কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়েও ব্যাংকিং জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সততা ও দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ প্রদান করতে হবে। ইচ্ছাকৃত বিনিয়োগ খেলাপিদের যাতে আইনের আওতায় আনা যায়, সে ব্যাপারে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
আরও পড়ুন: ‘মিউচ্যুয়াল ফান্ডে আগ্রহ বাড়াতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ’
বিজনেস জার্নাল: ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি কমানোর জন্য কর্মীদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন?
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: একটি দক্ষ মানব সম্পদ ব্যাবস্থাপনাই পারে ব্যাংকের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা লিডারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় ব্যাংকের জনশক্তিকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতনার জন্য শাখা পর্যায়ে নিয়মিত সভার আয়োজন করছি। এতে আমাদের ও সবস্তরের জনশক্তির ইসলামী ব্যাংকিং জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে।
বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু রেজা মোঃ ইয়াহিয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ঢাকা/টিএ