মার্চেন্ট ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী বিনিয়োগে লোকসান এড়ানো সম্ভব: মাজেদা খাতুন

- আপডেট: ১২:৫৩:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫
- / ১০৮৭৫ বার দেখা হয়েছে
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাজেদা খাতুন।এর আগে তিনি আইসিবির মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও বর্তমানে তিনি দেশের পুঁজিবাজারের সদস্যভুক্ত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি পুঁজিবাজারের নানা দিক নিয়ে বিজনেস জার্নাল-এর সাথে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাজেদা খাতুন: বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজার একটি পরিবর্তীত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ধারাবাহিক নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চিয়তা ও উদ্বেগ বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ১ হাজার ৪৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ১৮৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে এবং বাজার মূলধন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা কমে ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বাজারের এই নিম্নমুখী প্রবণতার পেছনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদহার এবং ফ্লোর প্রাইসসহ বিভিন্ন কারণ ভূমিকা রেখেছে।নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন কারসাজির অভিযোগে জরিমানা আরোপ এবং টাস্ক ফোর্সগঠন। তবে, বাজারে আস্থা ফেরাতে এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ যেমন- আর্থিক সিস্টেমের ভারসাম্যহীনতা নিরসন, কর নীতি বাস্তবমুখী করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া তরান্বিত করণ ইত্যাদি।এছাড়াও, বিনিয়োগের আগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বিজনেস জার্নাল: দুর্বলভিত্তির কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার দায় কার এবং তা ঠেকাতে ভবিষ্যতে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?
মাজেদা খাতুন: দেশের ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের মিসম্যাচ, মনিটরিং সিস্টেমের দূর্বলতা, ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ, সুশাসনের অভাব, আইপিও পরবর্তীতে শেয়ার প্রাইসিং এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি বিষয় সমূহ দুর্বলভিত্তির কোম্পানিতে পরিনত হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
কোম্পানি তালিকাভুক্ত করণের প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই এবং সিএসই), ইস্যুয়ার কোম্পানি, অডিট ফার্ম, ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি, এলিজেবল ইনভেস্টর, আন্ডার রাইটার এবং ইস্যু ম্যানেজার এই প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে। বিএসইসি কর্তৃক জারিকৃত আইপিও সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধি-বিধান ও নির্দেশনা অনুযায়ী মার্চেন্ট ব্যাংক কর্তৃক ইস্যু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জসমূহে কোম্পানি তালিকাভুক্তির নিমিত্ত কমিশনে আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে কমিশন কর্তৃক যাচাই-বাছাই করে আইপিও সংক্রান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন: প্রিমিয়ামসহ ইফাদ অটোসের আইপিও: ব্যর্থতা নাকি স্মার্টলি সাজানো প্রতারণা!
ভবিষ্যতে দুর্বলভিত্তির কোম্পানি ঠেকাতে করণীয়:
শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদী অর্থাৎ ওয়ার্কিং ক্যাপিটালে অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজার হতে অর্থায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ডিএসই ও সিএসই-কে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যাকগ্রাউন্ড ও আর্থিক অবস্থা আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী তালিকাভুক্তির নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন। স্বচ্ছ নিরীক্ষার জন্য নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে হবে।বাধ্যতামূলকভাবে বিনিয়োগ সংক্রান্ত ঝুঁকিসমূহ প্রকাশ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীগণ বুঝতে পারে বিনিয়োগের ঝুঁকি কতটুকু।
বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি এড়াতেও বাজারের আস্থা বাড়াতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো কীভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে?
মাজেদা খাতুন: দেখুন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নির্ধারিত রুলস রেগুলেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।ঘন ঘন রুলস রেগুলেশন পরিবর্তন না করে নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে বাজারের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। মার্চেন্ট ব্যাংক সমূহের নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিবেদন ও বাজার বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিনিয়োগ করলে অথবা মার্চেন্ট ব্যাংকসমূহের পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রোডাক্ট বা সেবায় বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীগণ সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে পারবেন।বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন সেমিনার, অনলাইন প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালায় অংশ গ্রহণ করলে সঠিক সময়ে সঠিক সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের বিষয়ে ধারণা গ্রহণ করতে পারবে।
বিজনেস জার্নাল: বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয় কতোটা কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?
মাজেদা খাতুন: বিএসইসি বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইন প্রনয়ন ও তদারকির দায়িত্ব পালন করে। স্টক এক্সচেঞ্জগুলো বাজার পরিচালনা ও লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কাজ করে, আর মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো অবলেখন ও ইস্যু ব্যবস্থাপনা, পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ করে।বাজারের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে মার্চেন্ট ব্যাংক এসোসিয়েশনের বিভিন্ন সুপারিশসমূহ আমলে নেয়া প্রয়োজন।যাতে করে মার্কেটের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়।
বিজনেস জার্নাল: বিগত সময়ে অধিকাংশ আইপিও বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে-এর পেছনে কারণ কী?
মাজেদা খাতুন: পুঁজিবাজারে ব্যবসা একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। সঠিক সময়ে সঠিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ এবং সঠিক সময়ে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন মহল কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে। পরবর্তীতে তারা শেয়ার বিক্রয় করে ফেললে শেয়ারের দাম দ্রুত কমে যায়, ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বিজনেস জার্নাল: নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সময় মার্চেন্ট ব্যাংক কীভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে?
মাজেদা খাতুন: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংক মূলত ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে এবং বিএসইসির নির্ধারিত রুলসের আওতায় আইএম (ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম) প্রস্তুত করে বিনিয়োগকারীদের নিকট কোম্পানির পরিচিতি তুলে ধরে।
বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মার্চেন্ট ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মাজেদা খাতুন: পুঁজিবাজার হচ্ছে একটি নলেজ বেইজড মার্কেট।এখানে সিকিউরিটিজ পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার মূলনীতি সমূহ যেমন- ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিস, টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস, ট্রেড অ্যানালাইসিস, পোর্টফোলিও ডাইভারসিফিকেশন, যথা সময়ে যথাযথ মূল্যে সিকিউরিটিজ ক্রয় ও বিক্রয় (আন্ডার ভ্যালুড শেয়ার ক্রয় ও ওভার ভ্যালুড শেয়ার বিক্রয়), উচ্চ ডিভিডেন্ড ইল্ড সম্পন্ন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় সমূহকে বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করা উচিত। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীগণের উচিত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা। এ লক্ষ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকসমূহ বিভিন্ন টার্গেট গ্রুপকে কেন্দ্র করে পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রোডাক্ট বা সেবা বাজারে আনছে।
বিজনেস জার্নাল: আইপিও প্রক্রিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
মাজেদা খাতুন: দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষেত্রসমূহে স্বচ্ছতা আনয়ন, বিনিয়োগ বান্ধব নীতিমালা ও কর সুবিধা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রযুক্তির ব্যবহার, আন্তর্জাতিক ইতিবাচক প্রচারনা, আইন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর উন্নয়ন। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশি আইপিও বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়বে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং বাজার উন্নয়নে কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মাজেদা খাতুন: পুঁজিবাজারের চলমান সংকট ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং বাজারের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আইন ও নীতিমালার সংস্কারের মাধ্যমে মৌল ভিত্তি সম্পন্ন সিকিউরিটিজ আনয়ন, মনিটরিং সিস্টেমের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃ্দ্ধি, বিনিয়োগকারীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন, বাজারে তারল্য বৃদ্ধি, প্রযু্ক্তি ও ডিজিটালাইজেশন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পুঁজিবাজারের সংকট কাটিয়ে উঠতে এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা প্রয়োজন।বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে পেতে এবং বাজারের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
ঢাকা/টিএ