১০:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শুধুমাত্র ইক্যুইটি নির্ভর পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়: শাহেদ ইমরান

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৫:৪২:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ১০৪৩৪ বার দেখা হয়েছে

মোহাম্মদ শাহেদ ইমরান। এনএলআই সিকিউরিটিজে ১০ বছর ধর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অতিসম্প্রতি একান্ত আলাপচারিতায় বিজনেস জার্নালের সঙ্গে দেশের পুঁজিবাজারের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন তার প্রতিষ্ঠান এনএলআই সিকিউরিটিজ এবং বিনিয়োগকারীদের করনীয় ও বর্জনীয় নিয়েও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তাঁর সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কি কি?

শাহেদ ইমরান: আমাদের পুঁজিবাজার শুধুমাত্র ইক্যুইটি নির্ভর। বাজারে এখনো আমরা ইক্যুইটির বাহিরে অন্য কোন প্রোডাক্ট আনতে পারিনি। শুধুমাত্র ইক্যুইটি দিয়ে পুঁজিবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মার্কেট এখনো অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের বাজারের বয়স ৭০ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে বাজারটা ম্যাচিউরড হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। বাজারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে দু:খজনক হলেও সত্য, পুঁজিবাজার এখনও তলানিতে রয়েছে।

অর্থনীতি শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এছাড়া বাজারের দরপতন থামানোর সুনির্দিষ্ট কৌশল এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি। যার কারণে যেসব স্টকগুলো ইনডেক্স বা সূচকে আঘাত করে, সেগুলোর দাম যদি হু হু করে কমে যায়, তখন ইনডেক্স পড়ে যায়। তখন বিনিয়োগকারীদের মনে একটা নেগেটিভ সেন্স চলে আসে। তখন সবাই ফোর্সড সেল করে বাজার থেকে বের হয়ে যায়। এসব কারণে বাজারের পতন হয়।

এই পতন ঠেকাতে আমাদের মার্কেট মেকারটা খুব জরুরি ছিল। আনুমানিক ৭ থেকে ৮ বছর আগে ‘মার্কেট মেকার রুলস’ তৈরি করা হয়েছে। একটা অর্গানাইজেশন চালু না হওয়ার কারণে আমরা মার্কেট মেকার চালু করতে পারছি না। বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারছি না।

২০১৯ সালে সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) গঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সিসিবিএল চালু করতে পারিনি। এই সিসিবিএল চালু না হওয়ার কারণে মার্কেট মেকিংটা হচ্ছে না। মার্কেট মেকার যদি থাকতো আজকে আমরা ভালো স্টকগুলোকে সাপোর্ট দিতে পারতাম। তাহলে বাজারের এমন পতন হতো না।

বিজনেস জার্নাল: বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?

শাহেদ ইমরান: এটা গবেষণার বিষয়। বর্তমানে বাজারের মূল্যায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। কোম্পানিগুলোতে একাউন্টসে ইথিকসটা এখনো পুরোপুরি মেইনটেইন হয় না। এটা পুরোপুরি মেইনটেইন হলে আমরা কোম্পানিগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতাম। আমি বলবো বাজার অনেক ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ স্টক বা সিকিউরিটিজ আন্ডারভ্যালু অবস্থায় রয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কি?

শাহেদ ইমরান: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুরদর্শিতা। তাদের যথেষ্ট দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। তারা অন্যের কথায় শেয়ার কেনা-বেচা করেন। এতে করে তারা অনেক সময় লোকসানে পড়ে যান। তাদের উচিত কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে দেখে ও বুঝে বিনিয়োগ করা উচিত। কারো কথায় বিনিয়োগ করা উচিত হবে না।

কমিশন যখন একটা কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসে, তখন হয়তো সেটি মুনাফায় ছিল অথবা তার আগের কিছু বছর হয়তো মুনাফা বা প্রফিট করেছে। কিন্তু একটা কোম্পানিতো সবসময় মুনাফা করে না, অথবা করবে না। সুতরাং সেই কোম্পানির ব্যবসার ভবিষ্যৎ কি আছে, কোম্পানিটির ম্যানেজমেন্টে কারা আছে, সেগুলো দেখেই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা  উচিত।

আরও পড়ুন: প্রসপেক্টাসে অসঙ্গতি ও অতিরঞ্জিত তথ্য নিয়েই পুঁজিবাজারে আসছে দুয়ার সার্ভিসেস- পর্ব: ১
বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন বাজারের উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারছে কি। কোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?

শাহেদ ইমরান: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন কমিশনকে নিয়ে মূল্যায়ন করার এখনো সময় আসেনি। একটি সংগ্রাম বা বিপ্লবের পরে এই কমিশন এসেছে। এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর যে সময়টা গেছে সেটি  পর্যাপ্ত মনে করি না। বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে একাধিক কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটিগুলোর এখনো রিপোর্ট আসেনি, বাস্তবায়ন হয়নি। তাদেরকে সময় দিতে হবে। আমরা বর্তমান কমিশনকে নিয়ে আশাবাদী। তারা ভালো কিছুই করবে।

মোটকথা, বাজারকে পরিপূর্ণ করতে হবে। পরিপূর্ণ করার জন্য সিসিবিএল দরকার। গঠিত সিসিবিএল দিয়ে যদি কাজ না হয় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব নতুন সিসিবিএল গঠন করে চালু করতে  হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ১০ বছর আগে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরে বাজারের উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

১৯৯৬ ও ২০১০ সালে বাজারের পতনের পর ডিএসইর যে মোডিফিকেশনগুলো বা কাজগুলো হয়েছে, সেগুলো খুবই দ্রুত হয়েছে, ভালোভাবে হয়েছে। যে কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু গত ১০ বছরে আমরা এই ধরনের উন্নতি আর পাইনি। বরং প্রচুর ডিএসইর কার্যকলাপে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গত ৮ থেকে ১০ বছর আমরা ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) স্ট্যাবল ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিওও পাইনি। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে রান করার জন্য স্ট্যবল ব্যবস্থাপনা পরিচালক অবশ্যই দরকার। বাজার  পরিচালনার জন্য প্রফেশনাল লোক দরকার। স্টক এক্সচেঞ্জে যারা স্বতন্ত্র পরিচালক রয়েছেন তারা স্ব স্ব জায়গায় সমাদৃত, প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পুঁজিবাজার সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার কারণে তারা বাজারের উন্নয়নে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পলিসিগুলো সঠিকভাবে মেইনটেইন করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

শাহেদ ইমরান: আস্থাহীনতার প্রধান কারণ হচ্ছে কেউ যখন কোনো ব্যবসা করে এবং সেই ব্যবসায় প্রতিনিয়ত লোকসান করে তখন সে আস্থাহীনতায় পড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরে লোকসান করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্টকে বিনিয়োগ করে লোকসান করেছেন। এমনটি অনেক ভালো স্টক বা সিকিউরিটিজে বিনিযোগ করেও লোকসান করেছেন। যে কারণে তাদের মধ্যে বাজার নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এজন্য দ্রুত বাজারের পলিসিগুলোর উন্নয়ন দরকার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।

সারা বিশ্বে পুঁজিবাজার এখন মডিউল। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজার হচ্ছে একমাত্র উপায়। সারা বিশ্বে জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজারের ভূমিকা অনেক বেশি। সেদিক থেকে আমাদের পুঁজিবাজার অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ আসবে। পুঁজিবাজারে আনুমানিক ৩৬০টির মতো কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। আর ট্রেক হোল্ডার রয়েছে ৪৫০টি। এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ঘোড়া আগে না গাড়ি আগে, সে রকম ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারকে ভাইব্রেন্ট করতে হলে বাজারে নতুন ভালো মানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বেশি বেশি নিয়ে আসতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে। ডিএসই, সিএসই ও বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?

শাহেদ ইমরান: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট এখন পর্যন্ত খুব একটা কাজ আসেনি। এটার পুনর্মূলায়নের অবশ্যই সুযোগ রয়েছে। ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন সিস্টেমটা খুব ভালো। এটা নিয়ে আমি কোনো সমালোচনা করবো না। কিন্তু এখানে মার্কেট সংশ্লিষ্ট লোক দরকার। বাজারের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকদেরকে এখানে নিয়ে আসতে হবে।

এই আইনটি অবশ্যই রিভিউ করতে হবে। কেন মার্কেট আগাতে পারলো না। কেন মার্কেটে স্টার্ক আপ হয়ে গেলো। অনেকেই অনেককে দোষ দেবেন। গত ১৫ বছরে ডিএসই, সিএসই বাজারের উন্নয়নে তেমন কাজ করেনি। তারা গড্ডালিকায় গা ভাষিয়েছে। এখান থেকে স্টকএক্সচেঞ্জগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। গত ৭০ বছর ধরে আমরা শুধু ইক্যুইটি বিক্রি করছি। অন্য আইটেম আমরা আনতে পারিনি।

বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? ইদানিং শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করছে। কি কারণে ছাটাই করা হচ্ছে?

শাহেদ ইমরান: সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসা খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। আমরা যারা শীর্ষ ৫০ বা ১০০ এর মধ্যে রয়েছি তারা কোনো রকমে চলে যাচ্ছি।  এর বাহির যারা আছে তাদের অনেকেই বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসে হাউজ চালাচ্ছেন। অনেকেই বেতন দিতে না পেরে কর্মী ছাটাই করছে। আমরা শুধু ইক্যুইটি ট্রেড করছি। আমাদের অন্য কোনো প্রোডাক্ট বা পণ্য নেই। এখন গড়ে ৪০০ কোটি টাকা ট্রেড হচ্ছে। বাজারে ৪৫০টি ট্রেক হোল্ডার রয়েছে। গড়ে হাউজগুলোতে এক কোটি টাকারও কম ট্রেড হয়। এখান থেকে আমরা কতুটুকুই বা কমিশন পাই। এই কমিশন দিয়ে হাউজ চালানো খুবই দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগগুলো কি কি?

শাহেদ ইমরান: গত দুই-চার বছরে ভালোমানের কোনো আইপিও আসেনি। যার কারণে বাজারের আজ এই করুণ দশা। এই সময়ে যেসব কোম্পানি বুক বিল্ডিংয়ে প্রিমিয়াম নিয়ে তালিকাভু্ক্ত হয়েছে, সেগুলো অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে এসেছে। ২০০০ সালের দিকে বাজারে প্রচুর আইপিও এসেছে। তখন ব্যাংক সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এখন সেই সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আইপিও বেশি বেশি করে আসতে হবে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর খেয়াল রাখতে হবে তাদের মাধ্যমে যেন কোনো মানহীন আইপিও না আসে।

আমাদের দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অনেক হয়েছে। সামনে বাংলাদেশ আরও বেশি আগাবে। বাংলাদেশে অন্তত ৩০টি গ্রীণ গার্মেন্টস রয়েছে। এরমধ্যে থেকে যদি আমরা ২৫ শতাংশ গার্মেন্টসকেও বাজারে তালিকাভুক্ত করতে পারি, তবে বাজারের জন্য অনেক ভালো কিছু হবে। বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এদেরকে নিয়ে আসতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষণীয়। এই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

শাহেদ ইমরান: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এক সময় আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু এখন আর সেটি নেই। তাছাড়া মাঝখানে বাজারে প্রায় দুই বছর ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার কারণে এবং ডলারের অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিযোগকারীরা সময়মতো বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যেতে পারেননি। যার কারণে তাদের মধ্যে বাজার নিয়ে এক ধরনের নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন পলিসিগত পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স বা লিজিং কোম্পানি বাজারকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে পারবে না।

বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?

শাহেদ ইমরান: বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি রয়েছে এবং এর প্রভাব সব দেশেই পড়ে। এখনকার ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিতে ইনফ্লেশন হবেই। আমাদের দেশে ট্রেজারি বন্ডে সাড়ে ১২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। যার ফলে ইনফ্লেশন বা মূল্যস্ফীতিতো হবেই। তবে ইনফ্লেশনের সাথে সাথে আমাদের আয়কেও বাড়াতে হবে। অনেকেই পুঁজিবাজারে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করে এই ইনফ্লেশনকে এডজাস্ট করার চেষ্টা করছেন বা করবেন। এটাই স্বাভাবিক।

বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কখন এবং তাদের কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

শাহেদ ইমরান: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজারে বিনিয়োগ এখনই মোক্ষম সময়। কিছু কিছু শেয়ার যথেষ্ট ভালো। কিন্তু তাদের দর এখন ফেসভ্যালুতে বা ফেসভ্যালুর নিচে। তাদের মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ৫, ৪ অথবা ৩। এসব কোম্পানিতে এখনই বিনিয়োগের মোক্ষম সময় এবং যাচাই বাছাই করে বিনিয়োগ করলে রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে অবশ্যই দেখে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বর্তমান বাজারে কী সম্ভাবনা রয়েছে? বিনিয়োগকারীরা কিভাবে একটি স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?

শাহেদ ইমরান: বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। প্রত্যেকটা বিনিয়োগের একটা ফান্ডামেন্টাল কৌশল আছে। মোট বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে। যেসব শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোতে।বাকি টাকা নিজের কাছে ক্যাশ রাখতে হবে। ১০০ শতাংশ বিনিয়োগ এক জায়গায় করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। আর সংসার চালানোর টাকা দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না।

বিজনেস জার্নাল: এনএলআই সিকিউরিটিজ সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

আরও পড়ুন: বিদ্যমান সুদহার বাজার স্থিতিশীলতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা: সাইফুল ইসলাম

শাহেদ ইমরান: আমাদের সিকিউরিটিজ হাউজের যাত্রা শুরু ২০১৪ সাল থেকে। লাভজনক ভাবেই আমরা ব্যবসা পরিচালনা করছি। আমরা বড় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ছায়াতলে আছে। এটি একটি বিশাল অর্গানাইজেশন। যার লাইফ ফান্ডেই ৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এই বিশাল মহীরুহের ছায়াতলে থাকার ফলে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমরা সবসময় আইন-কানুন মেনে চলার চেষ্টা করি। রুলসগুলো মেনে চলার কারণে আমাদের এখানকার বিনিযোগকারীরা সাধারণত পুঁজি হারান না। আর আমাদের বিনিয়োগকারীদের বলবো, ক্যাশে বিনিয়োগ করেন। মার্জিন লোন নিয়ে বিনিযোগ করবেন না। আমাদের সিকিউরিটিজ হাউজে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। আমাদের রিসার্চ টিম রয়েছে। বিনিযোগকারীরা চাইলে তাদের সাথে পরামর্শ করে আমাদের এখানে বিনিযোগ করতে পারেন।

বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহেদ ইমরান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ঢাকা/টিএ

শেয়ার করুন

x

শুধুমাত্র ইক্যুইটি নির্ভর পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়: শাহেদ ইমরান

আপডেট: ০৫:৪২:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

মোহাম্মদ শাহেদ ইমরান। এনএলআই সিকিউরিটিজে ১০ বছর ধর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অতিসম্প্রতি একান্ত আলাপচারিতায় বিজনেস জার্নালের সঙ্গে দেশের পুঁজিবাজারের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন তার প্রতিষ্ঠান এনএলআই সিকিউরিটিজ এবং বিনিয়োগকারীদের করনীয় ও বর্জনীয় নিয়েও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তাঁর সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

বিজনেস জার্নাল: পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কি কি?

শাহেদ ইমরান: আমাদের পুঁজিবাজার শুধুমাত্র ইক্যুইটি নির্ভর। বাজারে এখনো আমরা ইক্যুইটির বাহিরে অন্য কোন প্রোডাক্ট আনতে পারিনি। শুধুমাত্র ইক্যুইটি দিয়ে পুঁজিবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মার্কেট এখনো অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের বাজারের বয়স ৭০ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে বাজারটা ম্যাচিউরড হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। বাজারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে দু:খজনক হলেও সত্য, পুঁজিবাজার এখনও তলানিতে রয়েছে।

অর্থনীতি শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এছাড়া বাজারের দরপতন থামানোর সুনির্দিষ্ট কৌশল এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি। যার কারণে যেসব স্টকগুলো ইনডেক্স বা সূচকে আঘাত করে, সেগুলোর দাম যদি হু হু করে কমে যায়, তখন ইনডেক্স পড়ে যায়। তখন বিনিয়োগকারীদের মনে একটা নেগেটিভ সেন্স চলে আসে। তখন সবাই ফোর্সড সেল করে বাজার থেকে বের হয়ে যায়। এসব কারণে বাজারের পতন হয়।

এই পতন ঠেকাতে আমাদের মার্কেট মেকারটা খুব জরুরি ছিল। আনুমানিক ৭ থেকে ৮ বছর আগে ‘মার্কেট মেকার রুলস’ তৈরি করা হয়েছে। একটা অর্গানাইজেশন চালু না হওয়ার কারণে আমরা মার্কেট মেকার চালু করতে পারছি না। বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারছি না।

২০১৯ সালে সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল) গঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সিসিবিএল চালু করতে পারিনি। এই সিসিবিএল চালু না হওয়ার কারণে মার্কেট মেকিংটা হচ্ছে না। মার্কেট মেকার যদি থাকতো আজকে আমরা ভালো স্টকগুলোকে সাপোর্ট দিতে পারতাম। তাহলে বাজারের এমন পতন হতো না।

বিজনেস জার্নাল: বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?

শাহেদ ইমরান: এটা গবেষণার বিষয়। বর্তমানে বাজারের মূল্যায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। কোম্পানিগুলোতে একাউন্টসে ইথিকসটা এখনো পুরোপুরি মেইনটেইন হয় না। এটা পুরোপুরি মেইনটেইন হলে আমরা কোম্পানিগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতাম। আমি বলবো বাজার অনেক ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ বেশিরভাগ স্টক বা সিকিউরিটিজ আন্ডারভ্যালু অবস্থায় রয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কি?

শাহেদ ইমরান: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুরদর্শিতা। তাদের যথেষ্ট দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। তারা অন্যের কথায় শেয়ার কেনা-বেচা করেন। এতে করে তারা অনেক সময় লোকসানে পড়ে যান। তাদের উচিত কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে দেখে ও বুঝে বিনিয়োগ করা উচিত। কারো কথায় বিনিয়োগ করা উচিত হবে না।

কমিশন যখন একটা কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসে, তখন হয়তো সেটি মুনাফায় ছিল অথবা তার আগের কিছু বছর হয়তো মুনাফা বা প্রফিট করেছে। কিন্তু একটা কোম্পানিতো সবসময় মুনাফা করে না, অথবা করবে না। সুতরাং সেই কোম্পানির ব্যবসার ভবিষ্যৎ কি আছে, কোম্পানিটির ম্যানেজমেন্টে কারা আছে, সেগুলো দেখেই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা  উচিত।

আরও পড়ুন: প্রসপেক্টাসে অসঙ্গতি ও অতিরঞ্জিত তথ্য নিয়েই পুঁজিবাজারে আসছে দুয়ার সার্ভিসেস- পর্ব: ১
বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন বাজারের উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারছে কি। কোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?

শাহেদ ইমরান: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন কমিশনকে নিয়ে মূল্যায়ন করার এখনো সময় আসেনি। একটি সংগ্রাম বা বিপ্লবের পরে এই কমিশন এসেছে। এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর যে সময়টা গেছে সেটি  পর্যাপ্ত মনে করি না। বর্তমান কমিশন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে একাধিক কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটিগুলোর এখনো রিপোর্ট আসেনি, বাস্তবায়ন হয়নি। তাদেরকে সময় দিতে হবে। আমরা বর্তমান কমিশনকে নিয়ে আশাবাদী। তারা ভালো কিছুই করবে।

মোটকথা, বাজারকে পরিপূর্ণ করতে হবে। পরিপূর্ণ করার জন্য সিসিবিএল দরকার। গঠিত সিসিবিএল দিয়ে যদি কাজ না হয় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব নতুন সিসিবিএল গঠন করে চালু করতে  হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ১০ বছর আগে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরে বাজারের উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

১৯৯৬ ও ২০১০ সালে বাজারের পতনের পর ডিএসইর যে মোডিফিকেশনগুলো বা কাজগুলো হয়েছে, সেগুলো খুবই দ্রুত হয়েছে, ভালোভাবে হয়েছে। যে কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু গত ১০ বছরে আমরা এই ধরনের উন্নতি আর পাইনি। বরং প্রচুর ডিএসইর কার্যকলাপে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গত ৮ থেকে ১০ বছর আমরা ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) স্ট্যাবল ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিওও পাইনি। এই অর্গানাইজেশনগুলোকে রান করার জন্য স্ট্যবল ব্যবস্থাপনা পরিচালক অবশ্যই দরকার। বাজার  পরিচালনার জন্য প্রফেশনাল লোক দরকার। স্টক এক্সচেঞ্জে যারা স্বতন্ত্র পরিচালক রয়েছেন তারা স্ব স্ব জায়গায় সমাদৃত, প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পুঁজিবাজার সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার কারণে তারা বাজারের উন্নয়নে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পলিসিগুলো সঠিকভাবে মেইনটেইন করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

শাহেদ ইমরান: আস্থাহীনতার প্রধান কারণ হচ্ছে কেউ যখন কোনো ব্যবসা করে এবং সেই ব্যবসায় প্রতিনিয়ত লোকসান করে তখন সে আস্থাহীনতায় পড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরে লোকসান করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্টকে বিনিয়োগ করে লোকসান করেছেন। এমনটি অনেক ভালো স্টক বা সিকিউরিটিজে বিনিযোগ করেও লোকসান করেছেন। যে কারণে তাদের মধ্যে বাজার নিয়ে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এজন্য দ্রুত বাজারের পলিসিগুলোর উন্নয়ন দরকার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।

সারা বিশ্বে পুঁজিবাজার এখন মডিউল। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজার হচ্ছে একমাত্র উপায়। সারা বিশ্বে জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজারের ভূমিকা অনেক বেশি। সেদিক থেকে আমাদের পুঁজিবাজার অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ আসবে। পুঁজিবাজারে আনুমানিক ৩৬০টির মতো কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। আর ট্রেক হোল্ডার রয়েছে ৪৫০টি। এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ঘোড়া আগে না গাড়ি আগে, সে রকম ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারকে ভাইব্রেন্ট করতে হলে বাজারে নতুন ভালো মানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বেশি বেশি নিয়ে আসতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে। ডিএসই, সিএসই ও বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?

শাহেদ ইমরান: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট এখন পর্যন্ত খুব একটা কাজ আসেনি। এটার পুনর্মূলায়নের অবশ্যই সুযোগ রয়েছে। ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন সিস্টেমটা খুব ভালো। এটা নিয়ে আমি কোনো সমালোচনা করবো না। কিন্তু এখানে মার্কেট সংশ্লিষ্ট লোক দরকার। বাজারের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকদেরকে এখানে নিয়ে আসতে হবে।

এই আইনটি অবশ্যই রিভিউ করতে হবে। কেন মার্কেট আগাতে পারলো না। কেন মার্কেটে স্টার্ক আপ হয়ে গেলো। অনেকেই অনেককে দোষ দেবেন। গত ১৫ বছরে ডিএসই, সিএসই বাজারের উন্নয়নে তেমন কাজ করেনি। তারা গড্ডালিকায় গা ভাষিয়েছে। এখান থেকে স্টকএক্সচেঞ্জগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। গত ৭০ বছর ধরে আমরা শুধু ইক্যুইটি বিক্রি করছি। অন্য আইটেম আমরা আনতে পারিনি।

বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? ইদানিং শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করছে। কি কারণে ছাটাই করা হচ্ছে?

শাহেদ ইমরান: সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসা খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। আমরা যারা শীর্ষ ৫০ বা ১০০ এর মধ্যে রয়েছি তারা কোনো রকমে চলে যাচ্ছি।  এর বাহির যারা আছে তাদের অনেকেই বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসে হাউজ চালাচ্ছেন। অনেকেই বেতন দিতে না পেরে কর্মী ছাটাই করছে। আমরা শুধু ইক্যুইটি ট্রেড করছি। আমাদের অন্য কোনো প্রোডাক্ট বা পণ্য নেই। এখন গড়ে ৪০০ কোটি টাকা ট্রেড হচ্ছে। বাজারে ৪৫০টি ট্রেক হোল্ডার রয়েছে। গড়ে হাউজগুলোতে এক কোটি টাকারও কম ট্রেড হয়। এখান থেকে আমরা কতুটুকুই বা কমিশন পাই। এই কমিশন দিয়ে হাউজ চালানো খুবই দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগগুলো কি কি?

শাহেদ ইমরান: গত দুই-চার বছরে ভালোমানের কোনো আইপিও আসেনি। যার কারণে বাজারের আজ এই করুণ দশা। এই সময়ে যেসব কোম্পানি বুক বিল্ডিংয়ে প্রিমিয়াম নিয়ে তালিকাভু্ক্ত হয়েছে, সেগুলো অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে এসেছে। ২০০০ সালের দিকে বাজারে প্রচুর আইপিও এসেছে। তখন ব্যাংক সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু এখন সেই সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আইপিও বেশি বেশি করে আসতে হবে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর খেয়াল রাখতে হবে তাদের মাধ্যমে যেন কোনো মানহীন আইপিও না আসে।

আমাদের দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অনেক হয়েছে। সামনে বাংলাদেশ আরও বেশি আগাবে। বাংলাদেশে অন্তত ৩০টি গ্রীণ গার্মেন্টস রয়েছে। এরমধ্যে থেকে যদি আমরা ২৫ শতাংশ গার্মেন্টসকেও বাজারে তালিকাভুক্ত করতে পারি, তবে বাজারের জন্য অনেক ভালো কিছু হবে। বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এদেরকে নিয়ে আসতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষণীয়। এই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

শাহেদ ইমরান: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এক সময় আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু এখন আর সেটি নেই। তাছাড়া মাঝখানে বাজারে প্রায় দুই বছর ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার কারণে এবং ডলারের অস্থিতিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিযোগকারীরা সময়মতো বিনিয়োগ তুলে নিয়ে যেতে পারেননি। যার কারণে তাদের মধ্যে বাজার নিয়ে এক ধরনের নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে। এখন পলিসিগত পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স বা লিজিং কোম্পানি বাজারকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে পারবে না।

বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?

শাহেদ ইমরান: বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি রয়েছে এবং এর প্রভাব সব দেশেই পড়ে। এখনকার ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিতে ইনফ্লেশন হবেই। আমাদের দেশে ট্রেজারি বন্ডে সাড়ে ১২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। যার ফলে ইনফ্লেশন বা মূল্যস্ফীতিতো হবেই। তবে ইনফ্লেশনের সাথে সাথে আমাদের আয়কেও বাড়াতে হবে। অনেকেই পুঁজিবাজারে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করে এই ইনফ্লেশনকে এডজাস্ট করার চেষ্টা করছেন বা করবেন। এটাই স্বাভাবিক।

বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কখন এবং তাদের কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

শাহেদ ইমরান: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজারে বিনিয়োগ এখনই মোক্ষম সময়। কিছু কিছু শেয়ার যথেষ্ট ভালো। কিন্তু তাদের দর এখন ফেসভ্যালুতে বা ফেসভ্যালুর নিচে। তাদের মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ৫, ৪ অথবা ৩। এসব কোম্পানিতে এখনই বিনিয়োগের মোক্ষম সময় এবং যাচাই বাছাই করে বিনিয়োগ করলে রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে অবশ্যই দেখে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বর্তমান বাজারে কী সম্ভাবনা রয়েছে? বিনিয়োগকারীরা কিভাবে একটি স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?

শাহেদ ইমরান: বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। প্রত্যেকটা বিনিয়োগের একটা ফান্ডামেন্টাল কৌশল আছে। মোট বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে। যেসব শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলোতে।বাকি টাকা নিজের কাছে ক্যাশ রাখতে হবে। ১০০ শতাংশ বিনিয়োগ এক জায়গায় করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। আর সংসার চালানোর টাকা দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না।

বিজনেস জার্নাল: এনএলআই সিকিউরিটিজ সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

আরও পড়ুন: বিদ্যমান সুদহার বাজার স্থিতিশীলতার প্রধান প্রতিবন্ধকতা: সাইফুল ইসলাম

শাহেদ ইমরান: আমাদের সিকিউরিটিজ হাউজের যাত্রা শুরু ২০১৪ সাল থেকে। লাভজনক ভাবেই আমরা ব্যবসা পরিচালনা করছি। আমরা বড় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ছায়াতলে আছে। এটি একটি বিশাল অর্গানাইজেশন। যার লাইফ ফান্ডেই ৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এই বিশাল মহীরুহের ছায়াতলে থাকার ফলে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমরা সবসময় আইন-কানুন মেনে চলার চেষ্টা করি। রুলসগুলো মেনে চলার কারণে আমাদের এখানকার বিনিযোগকারীরা সাধারণত পুঁজি হারান না। আর আমাদের বিনিয়োগকারীদের বলবো, ক্যাশে বিনিয়োগ করেন। মার্জিন লোন নিয়ে বিনিযোগ করবেন না। আমাদের সিকিউরিটিজ হাউজে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। আমাদের রিসার্চ টিম রয়েছে। বিনিযোগকারীরা চাইলে তাদের সাথে পরামর্শ করে আমাদের এখানে বিনিযোগ করতে পারেন।

বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহেদ ইমরান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ঢাকা/টিএ