১০:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

শেয়ারবাজারের উন্নয়নে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন: শাকিল রিজভী

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১০:০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
  • / ১২৫১১ বার দেখা হয়েছে

শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাকিল রিজভী, যিনি দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবেও বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন। পুঁজিবাজার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিকে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি শেয়ার বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একান্তে কথা বলেছেন শেয়ারবাজার ও অর্থনীতি বিষয়ক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বিজনেস জার্নালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।

বিজনেস জার্নাল: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কী?

শাকিল রিজভী: সম্প্রতি বাজার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ব্যাংক ইন্টারেস্ট (সুদ) বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বাজারে। তবে এখন বাজার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। নতুন করে খারাপ কিছু হচ্ছে না বাজারে। বাজারের পরিপূর্ণ উন্নয়নে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ব্যাংক ইন্টারেস্ট বৃদ্ধি, গত কয়েক বছর খারাপ ও নিম্ন মানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাজারে আসার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে তারা বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। বরং তারা মার্কেট থেকে চলে গেছেন, অন্য বিনিয়োগকারীদেরকেও সাথে করে নিয়ে গেছেন, যার কারণে বাজারে পতন হয়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?

শাকিল রিজভী: বর্তমানে পুঁজিবাজারে আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি। অনেক বিনিয়োগকারী বাজার থেকে চলে যাওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ওভারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যাও বাড়বে।

বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী, এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

শাকিল রিজভী: নতুন কোনো পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত তেমন চ্যালেঞ্জ নেই। বর্তমানে অনেক শেয়ারের প্রাইস নিচে চলে গেছে। ফলে বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ নেই বললেই চলে। এখনই সময় বিনিয়োগ করা। তবে দেখে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে বিনিয়োগকারীদের।

বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে কী? কোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে কী?

শাকিল রিজভী: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তার হারানো গৌরব ফেরানোর চেষ্টা করছে। অতিতে কিছু সময় খারাপ কাজ যেমন হয়েছে, তেমনি ভালো কাজও হয়েছে। বর্তমান কমিশন ভালো করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। গত কয়েক বছরে একজন ব্যক্তিই ব্যাংক থেকে বেশিরভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে ভবিষ্যতে না হয়, সেজন্য নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি বাজারের উন্নয়নে ট্যাক্সের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

শাকিল রিজভী: বর্তমানে বাজারে যথেষ্ট আস্থার ঘাটতি রয়েছে। আর এই আস্থার ঘাটতির কারণে অনেক শেয়ার আন্ডারভ্যালু অবস্থায় রয়েছে। ভালো শেয়ারও কম দামে বিক্রি হচ্ছে। আস্থার ঘাটতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। কথা কম বলে কাজ বেশি করতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা সঠিক রাস্তায় আছি।

বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে? ডিএসই-সিএসই এবং বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?

শাকিল রিজভী: ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্টের বয়স ১১ বছর হয়েছে। যখন অ্যাক্টটি তৈরি হয়, তখন কথা ছিল ৫ বছর পর পর রিভিউ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, একবারেও অ্যাক্টটি রিভিউ হয়নি। এই অ্যাক্টে অবাস্তব কিছু বিষয় রয়েছে। যেগুলো রিভিউ করা খুবই জরুরী।

বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? শোনা যাচ্ছে, বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করছে? কেন তারা কর্মী ছাটাই করছে?

শাকিল রিজভী: বর্তমানে যে-পরিমাণ ট্রেড (লেনদেন) হচ্ছে তাতে করে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো লোকসান করছে। ভর্তুকী দিয়ে তারা হাউজ পরিচালনা করছে। বিশেষ করে গত ২/৩ বছর ধরে খুবই বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো। এই অবস্থায় অনেক হাউজ ছোট হয়েছে, বন্ধ হয়েছে। কর্মীদের বেতন-বোনাসও ঠিকভাবে দিতে পারছে না। অনেক কর্মীকে ছাটাই করা হয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে? বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ কী?

শাকিল রিজভী: অতিতে যেসব আইপিও বাজারে এসেছে সেগুলোর বেশিরভাগেই বাজে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিও অবশ্যই সুযোগ। কারণ ফেসভ্যালুতে (অবিহিত মূল্য) তারা যে শেয়ারগুলো আইপিও’র মাধ্যমে পায়, সেগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। এতে করে তারা লাভবান হয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন: প্রিমিয়ার ব্যাংককে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি

বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষনীয়? এই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

শাকিল রিজভী: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেখতে চায় বাজারে আইনের শাসন আছে কি-না। ভালো কোম্পানির গ্রোথ আছে কি-না। তারা ডলারের মূল্যটাকে বেশি দেখার চেষ্টা করে। আগামী তিন বছর ডলারের মূল্য কেমন হবে, তারা বিনিয়োগ করলে ডলারে কনভার্ট করে লাভবান হতে পারবেন কি-না। এসমস্ত বিষয় তারা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখেন। ডলারসহ বিভিন্ন অস্থিরতার কারণে আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ অনেক কমে গেছে।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে প্রসপেক্টাসেও। তাদেরকে দাওয়াত করার চেয়ে এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে পারলে তাদের বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?

শাকিল রিজভী: গত কয়েক বছর ধরেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন অস্থিরতার কারণে আমাদের পুঁজিবাজার বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও লোকাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় সাধারণ মানুষ জীবন পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণত উদ্বৃত্ত টাকা মানুষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকেন। জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্বৃত্ত টাকা তাদের অনেক কমে গেছে।

বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কখন? এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

শাকিল রিজভী: যে-কোনো সময় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারে। তবে যে শেয়ারটি কিনবেন, সেটি কেমন, তা ভালো করে খেয়াল করতে হবে। ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানিটি গ্রোথ আছে কিনা, ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডে কার রয়েছেন, কোম্পানিটির অতিতের ডিভিডেন্ড দেওয়ার রেকর্ড এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাথে কোম্পানির মালিকের সম্পর্ক কেমন, এসব দেখে বিনিয়োগ করা উচিত।

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের শুল্কনীতি: ভারতের পুঁজিবাজারে গাড়ি নির্মাণ কোম্পানির দর পতন

বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজারে কী দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা সম্ভব? বিনিয়োগকারীরা কীভাবে একটি স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?

শাকিল রিজভী: আমি আগেও বলেছি বাজার থেকে অনেক বিনিয়োগকারী চলে গেছেন। যে-কারণে আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের এখনই মোক্ষম সময়। কমপক্ষে ২/৩ বছর বা ৫ বছরের জন্য বিনিয়োগ করা উচিত।

তিনি বলেন, শেয়ার যেমন কিনতে হবে, তেমনি বিক্রিও করতে হবে। তবে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে লাভে বিক্রি করার জন্য। লাভে বিক্রি করতে করতে বিনিয়োগের টাকা উঠিয়ে নিতে হবে। এতে করে বাজারে থাকা অবশিষ্ট বিনিয়োগ নিয়ে পেনিক সৃষ্টি হবে না।

বিজনেস জার্নাল: আপনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে ডিএসই’র চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আপনারা পুঁজিবাজার নিয়ে বাজেট প্রস্তাবনা দিয়েছেন। কিন্তু এনবিআর চেয়ারম্যান আপনাদের বাজেট প্রস্তাবনায় কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে ভৎসনা করেছেন। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?

আরও পড়ুন: মার্চেন্ট ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী বিনিয়োগে লোকসান এড়ানো সম্ভব: মাজেদা খাতুন

শাকিল রিজভী: এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আমাদের দাবিগুলো ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। বর্তমানে বছরে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভবান হলে ট্যাক্স মৌকুফ রয়েছে। সে-ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু প্রত্যেকদিন লেনদেনের উপরে যে ট্যাক্স দিতে হয় সেটি মৌকুফের কথা আমরা বলেছি।

বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগাকারীদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

শাকিল রিজভী: যাদের উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে কেবল তাদেরই পুঁজিবাজারে আসা উচিত। ধার-দেনা করে, সংসার চালানোর টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়। যাদের আইডল মানি (উদ্বৃত্ত অর্থ) আছে, তাদেরকে এই বাজারে বেশি প্রয়োজন। আর ভালো মানের শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। জেনে-বুঝে

ঢাকা/টিএ

শেয়ার করুন

শেয়ারবাজারের উন্নয়নে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন: শাকিল রিজভী

আপডেট: ১০:০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাকিল রিজভী, যিনি দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবেও বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন। পুঁজিবাজার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিকে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি শেয়ার বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একান্তে কথা বলেছেন শেয়ারবাজার ও অর্থনীতি বিষয়ক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বিজনেস জার্নালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।

বিজনেস জার্নাল: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কী?

শাকিল রিজভী: সম্প্রতি বাজার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ব্যাংক ইন্টারেস্ট (সুদ) বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বাজারে। তবে এখন বাজার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। নতুন করে খারাপ কিছু হচ্ছে না বাজারে। বাজারের পরিপূর্ণ উন্নয়নে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ব্যাংক ইন্টারেস্ট বৃদ্ধি, গত কয়েক বছর খারাপ ও নিম্ন মানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাজারে আসার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে তারা বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। বরং তারা মার্কেট থেকে চলে গেছেন, অন্য বিনিয়োগকারীদেরকেও সাথে করে নিয়ে গেছেন, যার কারণে বাজারে পতন হয়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?

শাকিল রিজভী: বর্তমানে পুঁজিবাজারে আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি। অনেক বিনিয়োগকারী বাজার থেকে চলে যাওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ওভারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যাও বাড়বে।

বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী, এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

শাকিল রিজভী: নতুন কোনো পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত তেমন চ্যালেঞ্জ নেই। বর্তমানে অনেক শেয়ারের প্রাইস নিচে চলে গেছে। ফলে বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জ নেই বললেই চলে। এখনই সময় বিনিয়োগ করা। তবে দেখে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে বিনিয়োগকারীদের।

বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে কী? কোনো নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে কী?

শাকিল রিজভী: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তার হারানো গৌরব ফেরানোর চেষ্টা করছে। অতিতে কিছু সময় খারাপ কাজ যেমন হয়েছে, তেমনি ভালো কাজও হয়েছে। বর্তমান কমিশন ভালো করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। গত কয়েক বছরে একজন ব্যক্তিই ব্যাংক থেকে বেশিরভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে ভবিষ্যতে না হয়, সেজন্য নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি বাজারের উন্নয়নে ট্যাক্সের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হবে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

শাকিল রিজভী: বর্তমানে বাজারে যথেষ্ট আস্থার ঘাটতি রয়েছে। আর এই আস্থার ঘাটতির কারণে অনেক শেয়ার আন্ডারভ্যালু অবস্থায় রয়েছে। ভালো শেয়ারও কম দামে বিক্রি হচ্ছে। আস্থার ঘাটতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। কথা কম বলে কাজ বেশি করতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা সঠিক রাস্তায় আছি।

বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে? ডিএসই-সিএসই এবং বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?

শাকিল রিজভী: ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্টের বয়স ১১ বছর হয়েছে। যখন অ্যাক্টটি তৈরি হয়, তখন কথা ছিল ৫ বছর পর পর রিভিউ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, একবারেও অ্যাক্টটি রিভিউ হয়নি। এই অ্যাক্টে অবাস্তব কিছু বিষয় রয়েছে। যেগুলো রিভিউ করা খুবই জরুরী।

বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? শোনা যাচ্ছে, বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মী ছাটাই করছে? কেন তারা কর্মী ছাটাই করছে?

শাকিল রিজভী: বর্তমানে যে-পরিমাণ ট্রেড (লেনদেন) হচ্ছে তাতে করে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো লোকসান করছে। ভর্তুকী দিয়ে তারা হাউজ পরিচালনা করছে। বিশেষ করে গত ২/৩ বছর ধরে খুবই বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সিকিউরিটিজ হাউজগুলো। এই অবস্থায় অনেক হাউজ ছোট হয়েছে, বন্ধ হয়েছে। কর্মীদের বেতন-বোনাসও ঠিকভাবে দিতে পারছে না। অনেক কর্মীকে ছাটাই করা হয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে? বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ কী?

শাকিল রিজভী: অতিতে যেসব আইপিও বাজারে এসেছে সেগুলোর বেশিরভাগেই বাজে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিও অবশ্যই সুযোগ। কারণ ফেসভ্যালুতে (অবিহিত মূল্য) তারা যে শেয়ারগুলো আইপিও’র মাধ্যমে পায়, সেগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। এতে করে তারা লাভবান হয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন: প্রিমিয়ার ব্যাংককে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি

বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষনীয়? এই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

শাকিল রিজভী: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেখতে চায় বাজারে আইনের শাসন আছে কি-না। ভালো কোম্পানির গ্রোথ আছে কি-না। তারা ডলারের মূল্যটাকে বেশি দেখার চেষ্টা করে। আগামী তিন বছর ডলারের মূল্য কেমন হবে, তারা বিনিয়োগ করলে ডলারে কনভার্ট করে লাভবান হতে পারবেন কি-না। এসমস্ত বিষয় তারা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখেন। ডলারসহ বিভিন্ন অস্থিরতার কারণে আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ অনেক কমে গেছে।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে প্রসপেক্টাসেও। তাদেরকে দাওয়াত করার চেয়ে এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে পারলে তাদের বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?

শাকিল রিজভী: গত কয়েক বছর ধরেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন অস্থিরতার কারণে আমাদের পুঁজিবাজার বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও লোকাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় সাধারণ মানুষ জীবন পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। সাধারণত উদ্বৃত্ত টাকা মানুষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকেন। জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্বৃত্ত টাকা তাদের অনেক কমে গেছে।

বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কখন? এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

শাকিল রিজভী: যে-কোনো সময় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারে। তবে যে শেয়ারটি কিনবেন, সেটি কেমন, তা ভালো করে খেয়াল করতে হবে। ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানিটি গ্রোথ আছে কিনা, ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডে কার রয়েছেন, কোম্পানিটির অতিতের ডিভিডেন্ড দেওয়ার রেকর্ড এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাথে কোম্পানির মালিকের সম্পর্ক কেমন, এসব দেখে বিনিয়োগ করা উচিত।

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের শুল্কনীতি: ভারতের পুঁজিবাজারে গাড়ি নির্মাণ কোম্পানির দর পতন

বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজারে কী দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা সম্ভব? বিনিয়োগকারীরা কীভাবে একটি স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?

শাকিল রিজভী: আমি আগেও বলেছি বাজার থেকে অনেক বিনিয়োগকারী চলে গেছেন। যে-কারণে আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের এখনই মোক্ষম সময়। কমপক্ষে ২/৩ বছর বা ৫ বছরের জন্য বিনিয়োগ করা উচিত।

তিনি বলেন, শেয়ার যেমন কিনতে হবে, তেমনি বিক্রিও করতে হবে। তবে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে লাভে বিক্রি করার জন্য। লাভে বিক্রি করতে করতে বিনিয়োগের টাকা উঠিয়ে নিতে হবে। এতে করে বাজারে থাকা অবশিষ্ট বিনিয়োগ নিয়ে পেনিক সৃষ্টি হবে না।

বিজনেস জার্নাল: আপনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে ডিএসই’র চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আপনারা পুঁজিবাজার নিয়ে বাজেট প্রস্তাবনা দিয়েছেন। কিন্তু এনবিআর চেয়ারম্যান আপনাদের বাজেট প্রস্তাবনায় কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়ে ভৎসনা করেছেন। এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?

আরও পড়ুন: মার্চেন্ট ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী বিনিয়োগে লোকসান এড়ানো সম্ভব: মাজেদা খাতুন

শাকিল রিজভী: এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আমাদের দাবিগুলো ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। বর্তমানে বছরে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভবান হলে ট্যাক্স মৌকুফ রয়েছে। সে-ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু প্রত্যেকদিন লেনদেনের উপরে যে ট্যাক্স দিতে হয় সেটি মৌকুফের কথা আমরা বলেছি।

বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগাকারীদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।

শাকিল রিজভী: যাদের উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে কেবল তাদেরই পুঁজিবাজারে আসা উচিত। ধার-দেনা করে, সংসার চালানোর টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়। যাদের আইডল মানি (উদ্বৃত্ত অর্থ) আছে, তাদেরকে এই বাজারে বেশি প্রয়োজন। আর ভালো মানের শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। জেনে-বুঝে

ঢাকা/টিএ