প্রশ্নবিদ্ধ আইসিবির ভূমিকা
৩ হাজার কোটি টাকার সুফল পায়নি পুঁজিবাজার!

- আপডেট: ০৪:৪২:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১০৮৬৪ বার দেখা হয়েছে
নানা অনিয়মে জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) প্রতি পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের আস্থা অনেকটা শুণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ফলে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের কিছু অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলেও, তাদের পথ অনুসরণ করছেন না অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা। বাজারে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত রয়েছেন বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ফলে বাজার এখনো তলানীতে পড়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
সূত্রটি জানায়, নিম্ন মানের শেয়ারে বিনিয়োগ করে লোকসান করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আইন বহির্ভূত সুবিধা দেওয়া ও জাল জালিয়াতি-প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে বিনিয়োগ দেখিয়ে ঋণ পরিশোধ না করাসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা। যার পুরো নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আইসিবির উপরে। ফলে পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে বিনিয়োগ শুরু করলেও অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছে না।
সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কোন কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। আদৌ ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করছে, নাকি বাজার কারসাজিকারকদের সাথে যোগসাজস করে শেয়ার কিনছে, সে ব্যাপারে ধোয়াশার মধ্যে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আইসিবি কখন কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করছে, সেটি যদি বিনিয়োগকারীরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারতো, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিও বিনিয়োগকারীদের একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকতো। অতীতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে আইসিবির বিনিয়োগকৃত শেয়ারের নাম ততক্ষণাৎ জানা যেতো। কিন্তু সেই সফটওয়্যার কেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেটি নিয়েও এখন বিনিয়োগকারীদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের(বিএমবিএ) সভাপতি মাজেদা খাতুন বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে এখনো আস্থা ফিরে আসেনি। যে কারণে আইসিবি বিনিয়োগ করলেও, সেই পথে হাটছেন না বিনিয়োগকারীরা। আমরা জানতে পেরেছি, ইতিমধ্যে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়েছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী অতিতে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সেই বিনিয়োগও তারা এখনো উঠাতে পারেননি। তাহলে কেন তারা আবার নতুন করে বিনিয়োগ করবেন পুঁজিবাজারে। যে যাই বলুক, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত আইসিবি একাই এই বাজারের উন্নয়নে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে না। আর আইসিবিতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারি থাকতে পারে। তাই বলে পুরো আইসিবিকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না।
তথ্য বিশ্ল্যেষণে দেখা গেছে, আইসিবি ঋণ পাওয়ার এক সপ্তাহ আগে গত ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোট লেনদেন হয়েছে ৪৭৬ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার টাকা। আর গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৮৯ কোটি ৯৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। প্রায় দুই মাসের ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ৮৬ কোটি ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১৮ শতাংশ লেনদেন কমেছে। ৪ ডিসেম্বর বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি ৭১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। আর ৩০ জানুয়ারি তা এসে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৫ কোটি ৯০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ২ হাজার কোটি ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ ০.৩০ শতাংশ বাজার মূলধন কমেছে। ৪ ডিসেম্বর ডিএসই প্রধান সূচক-ডিএসইক্স ছিল ৫ হাজার ২৩৮ পয়েন্ট। আর বৃহস্পতিবার তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১১৩ পয়েন্ট। এই সময় সূচক কমেছে ১২৫ পয়েন্ট কমেছে। অর্থ্যাত আইসিবি নতুন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে তারল্যতো বাড়েইনি উপরন্ত কমেছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, আইসিবি নিজেদের সমস্যা সমাধান বা স্বার্থের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তারা মার্কেটকে ভাইব্রেন্ট করার জন্য টাকা নেয়নি। ট্রেজারি বিল, বন্ডে ইন্টারেস্ট অনেক হাই, ১২ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সেসব জায়গায় বিনিয়োগ করছেন। তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন না
তিনি বলেন, দীঘদিন বাজারের পতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতা কমে গেছে। ফলে তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না। আইসিবিসহ কেউই বাজারের আস্থা ফেরাতে কাজ করছে না। এই আস্থা যতদিন আসবে না, ততদিন বাজার এরকম ভঙ্গুর অবস্থায় থাকবে।
আরও পড়ুন: ফু-ওয়াং সিরামিকের আয় কমেছে
সম্প্রতি আইসিবির সার্বিক বিষয়ে আলাপকালে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন বিজনেস জার্নালকে বলেন, ‘আমরাতো বিনিয়োগ শুরু করেছি। বিনিযোগকারীরা বিনিয়োগে না আসলে আমরা কি করতে পারি।’
আপনারা ঋণ পাওয়ার আগে বলেছিলেন, এই ঋণ দিয়ে আইসিবি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে অন্যান্য বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। তাহলে কেন তারা আপনাদের পথ অনুসরণ করছেন না, তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ না করলে আমাদের কি-বা করার আছে।
প্রসঙ্গত, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা আনতে বিনিয়োগের জন্য সরকারি সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই অনুমোদন দিয়েছিলেন।
এর আগে গত ৫ নভেম্বর আইসিবিকে ৩ হাজার কোটি টাকা প্রদানে সভরেন গ্যারান্টির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব বরাবর চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকেও এ চিঠি পাঠানো হয়।
গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) প্রস্তাবিত ঋণ পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে এবং উচ্চহার সুদে গ্রহণ করা তহবিল পরিশোধের মাধ্যমে নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করবে। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর অনুকূলে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ এবং ঋণের ওপর অর্জিত বা আরোপিত সুদ অথবা এর (আসল ও সুদ) কোনো অংশ আইসিবি পরিশোধে অসমর্থ হলে সরকার যথানিয়মে তা পরিশোধ করবে।
তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সরকারকে প্রদেয় মুনাফা থেকে অপরিশোধিত বা বকেয়া ঋণ বা ঋণের ওপর ধার্য সুদ সমন্বয় করা যাবে না। এ গ্যারান্টির মেয়াদ ইস্যুর তারিখ থেকে ১৮ মাসের জন্য বলবৎ থাকবে।
জানা গেছে, গত ১৩ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিবির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৭ নভেম্বর ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। ৩ ডিসেম্বর এ ঋণের সুদহার ১০ শতাংশ পরিবর্তন করে ব্যাংক রেটে (৪ শতাংশ) নির্ধারণ করা হয়। মঞ্জুরীকৃত ঋণের অর্থ ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আইসিবির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ সুদহারে নেয়া আমানত ও ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেছে। বাকি ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৫০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে।
ঢাকা/টিএ