০৬:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪

আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে বাজেটে বাড়বে ভর্তুকির চাপ

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১০:৪৭:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ জুন ২০২৪
  • / ১০২৭৩ বার দেখা হয়েছে

ভর্তুকির জাল থেকে সরকার বের হতে চাইলেও তা উল্টো বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার শর্তে ভর্তুকি ব্যয় ধাপে ধাপে কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম কমলেও আগামী অর্থবছরে এই ব্যয় মেটাতে সরকারকে ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি উসকে দিচ্ছে ডলারের উচ্চমূল্য।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও সুদাসল পরিশোধে সরকারকে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বেশি বাড়াতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, সব মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতি প্রবল চাপে পড়েছে, যা অব্যাহত থাকলে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে তা বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ হচ্ছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে মূল্য সমন্বয় করে আসন্ন বাজেটের প্রাথমিক প্রাক্কলনে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা করেছিল সরকার।

কিন্তু সম্প্রতি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এখন নতুন করে ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে। এমনকি ডলারের দাম আরো বাড়লে ভর্তুকিও আরো বাড়াতে হতে পারে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও খাদ্য খাতের জন্য ভর্তুকি গতবারের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতেই আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভর্তুকি ও প্রণোদনার জন্য এক লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হবে, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২.১৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ভর্তুকি ও প্রণোদনার বড় অংশই বরাদ্দ রাখা হতে পারে বিদ্যুৎ ও কৃষি খাতে। এ দুটি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এলএনজি আমদানি ও খাদ্যে ভর্তুকি ছাড়াও সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও ভর্তুকি বাড়ছে।

আরও পড়ুন: মধ্যবিত্তদের টিসিবির পণ্য দেওয়া হবে: প্রতিমন্ত্রী

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এত ভর্তুকির পরও তা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

তিন বছরে ভর্তুকি সমন্বয় উল্টো পথে

সরকারের পরিকল্পনা ছিল ডলার রেট ১১০ টাকা হিসাবে ধরে ধাপে ধাপে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মূল্য সমন্বয় করে তিন বছরের মধ্যে ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া। জ্বালানি কিংবা ডলারের দাম বাড়লে সময়সীমা চার থেকে পাঁচ বছর করার ভাবনা ছিল। কিংবা আরো বেশি মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হতো, কিন্তু সরকার ভর্তুকি না কমিয়ে উল্টো বাড়াচ্ছে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন ও আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে সরবরাহ করায় প্রতিবছর এ খাতে লোকসান তথা ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। আইএমএফের পরামর্শের জেরে এরই মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ব্যয় সমন্বয়ের পথে হাঁটতে শুরু করেছে সরকার।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি  ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মূল্যবৃদ্ধি ও ভর্তুকির বিষয়ে বলছেন, জ্বালানি খাতে সরকার বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে আসছে। ভর্তুকি কমিয়ে আনতেই উৎপাদন ও বিক্রির মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য কমবেশি ১১৭ টাকার মতো হলেও সংকটের কারণে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেট থেকে তা কিনতে প্রায় ১২৪ টাকা ব্যয় হচ্ছে। বর্তমানে ডলারপ্রতি প্রায় ৪৭ টাকা লোকসান হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ডলারে পরিশোধ করতে হওয়ায় সরকারের লোকসান বাড়ছে।

বিদ্যুতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি

চলতি বছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি বরাদ্দও কিছুটা বেড়ে সাত হাজার কোটি টাকা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কয়েক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও ঘাটতি বাড়ছে। বিশেষ করে ডলারের দাম বেড়ে ১১৭ টাকা হওয়ায় এবং বাজারভিত্তিক ক্রলিংপেগ পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের কারণে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এখন বিদ্যুৎ খাতে মাসে গড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলে তা আগামী অর্থবছরে কমে আড়াই হাজার কোটি টাকায় নামত। আগের বকেয়াসহ চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। তখন পর্যন্ত বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি থকে জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে আরো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া যোগ হবে।

দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) পাশাপাশি ভারতীয় রপ্তানিকারকরা সরকারকে পাওনার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ জন্য সরকার বন্ড জারি করে এরই মধ্যে ভর্তুকির কিছু অর্থ পরিশোধ করেছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি আগামী দুই অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ দিয়ে পরিশোধ করা হবে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে খাদ্য ব্যয় বাড়ছে: সিপিডি

কৃষিতে ডলার ব্যয় কমলেও টাকায় বাড়াবে ভর্তুকি   

কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সার আমদানিতে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে আসায় এ খাতে ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কিন্তু মূলত ডলারের দামের কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারেও সরকারকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে।

কৃষি খাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ২৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হতে পারে। তবে বর্তমানে টাকার অভাবে কৃষি খাতের ভর্তুকির বকেয়াও পরিশোধ করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ব্যাংক সার আমদানির এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে বন্ড ইস্যু করেছে সরকার।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইংয়ের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ থাকলেও আমদানি ব্যয় ও ডলারের বিনিময় মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারকে বাড়তি ব্যয় করতে হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। এতে ভর্তুকি বাবদ খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরও সারের দাম কমতির দিকে। ডলারের মূল্য আগের অবস্থায় থাকলে ভর্তুকি বাবদ খরচ আরো প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমত বলে মনে করেন তিনি।

খাদ্য আমদানি ব্যয় বাড়বে

আগামী অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে সাত হাজার ৩৬০ কোটি টাকা করা হতে পারে। খাদ্য ভর্তুকির আওতায় মূলত সরকারি চাকরিজীবীদের রেশন দেওয়া হয়ে থাকে। তা ছাড়া আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ক্রয়ের বদলে খাদ্য আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। এ কারণে ভর্তুকি ব্যয়ও বাড়াতে হচ্ছে।

সরকার বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল, দাতব্য সংস্থা, গবেষণা সংস্থা ও এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বাজেট থেকে অনুদান হিসেবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে, যা ভর্তুকি হিসেবে দেখানো হয়। আগামী অর্থবছর এ খাতে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ভর্তুকি মূল্যে এক কোটি পরিবারকে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে। খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি (ওএমএস)সহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দের অর্থ ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করে সরকার। আগামী অর্থবছর এসব খাতে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হতে পারে।

রপ্তানিতে প্রণোদনা কমবে

২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশের। তখন রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দিতে পারবে না সরকার। এ জন্য বিরূপ প্রভাব এড়াতে আগে থেকেই ধাপে ধাপে প্রণোদনা কমানোর পরিকল্পনা হয়েছে। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে রপ্তানি প্রণোদনা কমেছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা কমানো হবে।

প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী করতে সরকার ২.৫% হারে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এ জন্য আগামী বাজেটে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এটি ৩ শতাংশ করার জন্য সংসদীয় কমিটির সুপারিশ রয়েছে।

আগামী ৬ জুন আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত সাত লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হবে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে ৬.৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার ধরা হবে ৬.৫ শতাংশ। তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে।

ঢাকা/এসএইচ

শেয়ার করুন

x

আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে বাজেটে বাড়বে ভর্তুকির চাপ

আপডেট: ১০:৪৭:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ জুন ২০২৪

ভর্তুকির জাল থেকে সরকার বের হতে চাইলেও তা উল্টো বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার শর্তে ভর্তুকি ব্যয় ধাপে ধাপে কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম কমলেও আগামী অর্থবছরে এই ব্যয় মেটাতে সরকারকে ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি উসকে দিচ্ছে ডলারের উচ্চমূল্য।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও সুদাসল পরিশোধে সরকারকে ব্যয় বরাদ্দ অনেক বেশি বাড়াতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, সব মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতি প্রবল চাপে পড়েছে, যা অব্যাহত থাকলে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে তা বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ হচ্ছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে মূল্য সমন্বয় করে আসন্ন বাজেটের প্রাথমিক প্রাক্কলনে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা করেছিল সরকার।

কিন্তু সম্প্রতি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এখন নতুন করে ভর্তুকি বাড়াতে হচ্ছে। এমনকি ডলারের দাম আরো বাড়লে ভর্তুকিও আরো বাড়াতে হতে পারে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও খাদ্য খাতের জন্য ভর্তুকি গতবারের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতেই আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভর্তুকি ও প্রণোদনার জন্য এক লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হবে, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২.১৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ভর্তুকি ও প্রণোদনার বড় অংশই বরাদ্দ রাখা হতে পারে বিদ্যুৎ ও কৃষি খাতে। এ দুটি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এলএনজি আমদানি ও খাদ্যে ভর্তুকি ছাড়াও সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও ভর্তুকি বাড়ছে।

আরও পড়ুন: মধ্যবিত্তদের টিসিবির পণ্য দেওয়া হবে: প্রতিমন্ত্রী

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এত ভর্তুকির পরও তা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

তিন বছরে ভর্তুকি সমন্বয় উল্টো পথে

সরকারের পরিকল্পনা ছিল ডলার রেট ১১০ টাকা হিসাবে ধরে ধাপে ধাপে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মূল্য সমন্বয় করে তিন বছরের মধ্যে ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া। জ্বালানি কিংবা ডলারের দাম বাড়লে সময়সীমা চার থেকে পাঁচ বছর করার ভাবনা ছিল। কিংবা আরো বেশি মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হতো, কিন্তু সরকার ভর্তুকি না কমিয়ে উল্টো বাড়াচ্ছে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন ও আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে সরবরাহ করায় প্রতিবছর এ খাতে লোকসান তথা ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। আইএমএফের পরামর্শের জেরে এরই মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ব্যয় সমন্বয়ের পথে হাঁটতে শুরু করেছে সরকার।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি  ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মূল্যবৃদ্ধি ও ভর্তুকির বিষয়ে বলছেন, জ্বালানি খাতে সরকার বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে আসছে। ভর্তুকি কমিয়ে আনতেই উৎপাদন ও বিক্রির মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য কমবেশি ১১৭ টাকার মতো হলেও সংকটের কারণে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেট থেকে তা কিনতে প্রায় ১২৪ টাকা ব্যয় হচ্ছে। বর্তমানে ডলারপ্রতি প্রায় ৪৭ টাকা লোকসান হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ডলারে পরিশোধ করতে হওয়ায় সরকারের লোকসান বাড়ছে।

বিদ্যুতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি

চলতি বছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি বরাদ্দও কিছুটা বেড়ে সাত হাজার কোটি টাকা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কয়েক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও ঘাটতি বাড়ছে। বিশেষ করে ডলারের দাম বেড়ে ১১৭ টাকা হওয়ায় এবং বাজারভিত্তিক ক্রলিংপেগ পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের কারণে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এখন বিদ্যুৎ খাতে মাসে গড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলে তা আগামী অর্থবছরে কমে আড়াই হাজার কোটি টাকায় নামত। আগের বকেয়াসহ চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। তখন পর্যন্ত বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি থকে জুন পর্যন্ত পাঁচ মাসে আরো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া যোগ হবে।

দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) পাশাপাশি ভারতীয় রপ্তানিকারকরা সরকারকে পাওনার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ জন্য সরকার বন্ড জারি করে এরই মধ্যে ভর্তুকির কিছু অর্থ পরিশোধ করেছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি আগামী দুই অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ দিয়ে পরিশোধ করা হবে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীনভাবে খাদ্য ব্যয় বাড়ছে: সিপিডি

কৃষিতে ডলার ব্যয় কমলেও টাকায় বাড়াবে ভর্তুকি   

কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সার আমদানিতে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে আসায় এ খাতে ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কিন্তু মূলত ডলারের দামের কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারেও সরকারকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে।

কৃষি খাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ২৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হতে পারে। তবে বর্তমানে টাকার অভাবে কৃষি খাতের ভর্তুকির বকেয়াও পরিশোধ করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ব্যাংক সার আমদানির এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে বন্ড ইস্যু করেছে সরকার।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ উইংয়ের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ থাকলেও আমদানি ব্যয় ও ডলারের বিনিময় মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারকে বাড়তি ব্যয় করতে হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। এতে ভর্তুকি বাবদ খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরও সারের দাম কমতির দিকে। ডলারের মূল্য আগের অবস্থায় থাকলে ভর্তুকি বাবদ খরচ আরো প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমত বলে মনে করেন তিনি।

খাদ্য আমদানি ব্যয় বাড়বে

আগামী অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য ভর্তুকি প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে সাত হাজার ৩৬০ কোটি টাকা করা হতে পারে। খাদ্য ভর্তুকির আওতায় মূলত সরকারি চাকরিজীবীদের রেশন দেওয়া হয়ে থাকে। তা ছাড়া আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ক্রয়ের বদলে খাদ্য আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। এ কারণে ভর্তুকি ব্যয়ও বাড়াতে হচ্ছে।

সরকার বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল, দাতব্য সংস্থা, গবেষণা সংস্থা ও এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বাজেট থেকে অনুদান হিসেবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে, যা ভর্তুকি হিসেবে দেখানো হয়। আগামী অর্থবছর এ খাতে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ভর্তুকি মূল্যে এক কোটি পরিবারকে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করছে। খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি (ওএমএস)সহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দের অর্থ ভর্তুকি হিসেবে ব্যয় করে সরকার। আগামী অর্থবছর এসব খাতে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হতে পারে।

রপ্তানিতে প্রণোদনা কমবে

২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশের। তখন রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দিতে পারবে না সরকার। এ জন্য বিরূপ প্রভাব এড়াতে আগে থেকেই ধাপে ধাপে প্রণোদনা কমানোর পরিকল্পনা হয়েছে। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে রপ্তানি প্রণোদনা কমেছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা কমানো হবে।

প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী করতে সরকার ২.৫% হারে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এ জন্য আগামী বাজেটে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এটি ৩ শতাংশ করার জন্য সংসদীয় কমিটির সুপারিশ রয়েছে।

আগামী ৬ জুন আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত সাত লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হবে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে ৬.৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার ধরা হবে ৬.৫ শতাংশ। তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে।

ঢাকা/এসএইচ