০৬:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
সিকিউরিটিজ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি

এবি ব্যাংক ইস্যুতে স্টক এক্সচেঞ্জ যেন ‘নীরব দর্শক’!

বিশেষ প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৪:৫৯:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১০৩০৭ বার দেখা হয়েছে

শেয়ারেরবাজার মানেই স্বপ্ন, ছোট-বড় সবাই এখানে একদিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকার, ভবিষ্যৎ গড়ার আশা নিয়ে আসে। সেই আশা নিয়মে-নীতিতে ভর করে; যারা কোম্পানির পেছনে উদ্যোক্তা-পরিচালক হয়ে দাঁড়ায়- তাঁদের কাছে একটু বেশি দায়িত্ব থাকে, কারণ তাদেরই হাতে থাকা শেয়ার একজন সাধারণ বিনিয়োগকারীর আস্থা ও নিরাপত্তা বোঝায়। কিন্তু আজকাল আমরা দেখছি যে সেই আস্থা ভেঙ্গে পড়ছে; অনেক কোম্পানিতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতের শেয়ার কমে যাচ্ছে, অনেকে আইন থাকা সত্বেও সম্মিলিত শেয়ার ধারণের নির্ধারিত সীমার নিচেও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আজ আবারও প্রশ্ন উঠেছে- আইন আছে, কিন্তু তা মানে কে? এবি ব্যাংক পিএলসির সাম্প্রতিক শেয়ারহোল্ডিং পরিবর্তন যেন সেই প্রশ্নেরই নতুন জবাব হয়ে এসেছে। দেশের অন্যতম পুরনো ও আলোচিত এই বেসরকারি ব্যাংকটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে থাকা শেয়ার মাত্র এক মাসে প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে। জুলাই ২০২৫ মাসে পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকগণ কোম্পানির মোট ৩১.২১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন, কিন্তু আগস্ট মাসে সেই অংশ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১.২৩ শতাংশে। অর্থ্যাৎ ব্যাংকটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে এখন আর নেই আইন অনুযায়ী ন্যূনতম শেয়ারহোল্ডিংয়ের পরিমাণ, যা বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ আইন ও বিএসইসির নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন।

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৬১ কোটি টাকার পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা!

অথচ আইন স্পষ্টভাবে বলা আছে, তালিকাভুক্ত যে কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে অন্তত ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- যে কোম্পানির  উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ শেয়ার নেই, সেই কোম্পানিটি আরও শেয়ার বিক্রি করে সেপ্টেম্বর শেষে তা ১৮ শতাংশের (১৮.৯৫ শতাংশ) ঘরে নামিয়ে এনেছে। তারচেয়ে আজব বিষয় হলো- আইন লঙ্ঘণের সীমা পার করেও সেই শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জ ছিলো নিশ্চুপ দর্শক।

আরও পড়ুন: লাভোলো’র মুনাফা উড়ছে কাগজে, নগদ ডুবছে বাস্তবে!

এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য একটাই- যাতে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা কোম্পানির ভাগ্যনির্ধারণে নিজেরাও অংশীদার থাকেন, অর্থ্যাৎ তাদের স্বার্থ কোম্পানির সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কারণ, যখন পরিচালক নিজে শেয়ারের মালিক থাকেন, তখন তিনি কোম্পানির ক্ষতি হতে দিতে চান না, কারণ সেই ক্ষতি তার নিজেরও ক্ষতি। কিন্তু এবি ব্যাংকের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এক মাসের ব্যবধানে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার এতোটা কমে যাওয়া মানে, তারা হয় নিজেরা শেয়ার বিক্রি করেছেন, নয়তো সেই শেয়ার অন্য কারো কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। কেন এই বিক্রি হলো, কার কাছে বিক্রি হলো, কী উদ্দেশ্যে হলো- এসব প্রশ্নের জবাব কারও কাছেই নেই।

আরও পড়ুন: বেষ্ট হোল্ডিংসের আর্থিক প্রতিবেদনে অস্পষ্টতা: বিভ্রান্তিতে বিনিয়োগকারীরা!

শুধু এবি ব্যাংক নয়, দেশের অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানিই বছর বছর ধরে এই একই আইন অমান্য করে চলছে। কেউ গোপনে শেয়ার বিক্রি করছে, কেউ আবার আত্মীয়স্বজন বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার স্থানান্তর করছে, যাতে কাগজে-কলমে আইন মানা দেখানো যায়। অনেক কোম্পানি ধীরে ধীরে ‘silent sell’ পদ্ধতিতে নিজেদের অংশ কমিয়ে দেয়, যাতে একবারে বড় বিক্রির ঘোষণা না দিতে হয় এবং বাজারে আলোড়ন না ওঠে। কিন্তু এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধোঁয়াশায় পড়ে যায়। তারা ভাবেন, কোম্পানির পরিচালকরা যখন নিজেরাই শেয়ার বিক্রি করছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু জানেন যা সাধারণ মানুষ জানে না। এই ভয় থেকেই বাজারে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১১ সালে বিএসইসি আইন করে বলে দেয়, উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে এবং যাদের নেই, তাদের দ্রুত পূরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে একজন পরিচালক বোর্ডে থাকতে হলে অন্তত দুই শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। কিন্তু গত ১৪ বছরেও এই আইন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলো আইন ভাঙছে আর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো শুধু নোটিশ দিচ্ছে, চিঠি পাঠাচ্ছে, তারপর সময় বাড়াচ্ছে। কিন্তু কোনো শাস্তি হচ্ছে না।

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানি প্রণোদনা উধাও: ফুলে ফেঁপে উঠছে ‘রিসিভ্যাবলস’

২০২৫ সালের মাঝামাঝি বিএসইসি প্রকাশ্যে জানায়, ৪৪টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি এই আইন মানছে না, তাদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা ৩০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করছেন। তাদের নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বলা হয়েছিল, শেয়ার বাড়াতে হবে। কিন্তু কয়েক মাস কেটে গেলেও সেই নির্দেশ মানেনি বেশিরভাগ কোম্পানি। বরং কেউ কেউ আবার সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে, যা বিএসইসি বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। এতে বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কঠোর নয়, বরং নরম। ফলে কোম্পানিগুলোও মনে করে- চিঠি এলে একটু উত্তর দিলেই হবে, তাতে কিছুই হবে না।

এদিকে, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ভূমিকা এখানে সমানভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ৩০ শতাংশের নিচে নামলে তাৎক্ষণিকভাবে বাজারকে জানানো, কারণ অনুসন্ধান করা এবং তদন্ত শুরু করা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে ডিএসই বরাবরই চুপ থাকে। কখনও অনেক দেরিতে নোটিশ দেয়, কখনও সেটাও দেয় না। এতে কোম্পানিগুলো সুযোগ নেয়। তারা আইন ভেঙেও সহজেই সময় পায়, আবার বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির বোঝা বাড়ে।

আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিম: ৬৯ বছর অপেক্ষার ফাঁদে বিনিয়োগকারীরা!

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন এমন আচরণ করছে যেন তারা কোম্পানিগুলোর পরামর্শদাতা, নিয়ন্ত্রক নয়। যদি কেউ আইন ভাঙে, তাহলে তাদের বোর্ড স্থগিত করা উচিত, শেয়ার ট্রেডিং সীমিত করা উচিত- কিন্তু তা হচ্ছে না। এবি ব্যাংকের এই ঘটনাটি এক ধরনের সতর্কবার্তা। যখন একটি ব্যাংক- যার লাখো গ্রাহক, হাজারো বিনিয়োগকারী, তারই পরিচালকরা নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যেতে শুরু করেন, তখন সেটা শুধু সংখ্যার পরিবর্তন নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার সংকেত। এটি দেখিয়ে দেয়, কোম্পানির অভ্যন্তরীণ স্থিতি, ব্যবস্থাপনা বা ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়তো অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই বিক্রি ও পরিবর্তন যদি আইনবিরুদ্ধ হয়, তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু করা। সেটি না হওয়ায় বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি কতোটা দুর্বল।

আবু সালেহ নামের এক বিনিয়োগকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যখন দেখি পরিচালকেরা নিজেরাই শেয়ার বিক্রি করছেন, তখন মনে হয় তারা নিজের কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে আর আশাবাদী নন। তখন আমরাও ভয় পাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই অবস্থার দায় কে নেবে? আইনের যে উদ্দেশ্য ছিল বাজারে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা, সেটাই এখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই; নিয়ন্ত্রক আছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া নেই; এক্সচেঞ্জ আছে, কিন্তু তদারকি নেই। ফলে বাজারে এক অদৃশ্য বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখন বিশ্বাস হারাচ্ছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ।’

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ: কাগুজে মুনাফার আড়ালে নগদ প্রবাহের সংকট!

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলে, ‘এই অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক। কারণ, যখন বাজারের নিয়ন্ত্রকরা নিরব হয়ে যান, তখন পুঁজিবাজার এক শ্রেণির প্রভাবশালীর খেলায় পরিণত হয়। তখন সাধারণ মানুষ শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হয় না, বরং পুরো অর্থনীতির প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় প্রয়োজন আইনের কার্যকর প্রয়োগ, তাৎক্ষণিক তদন্ত, এবং দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে তারা শুধু নামেই নয়, কাজে সত্যিকারের নিয়ন্ত্রক। যারা আইন ভেঙেছে, তাদের বোর্ডের ক্ষমতা স্থগিত করা, শেয়ার ট্রেডিংয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, এবং জনগণকে জানানো জরুরি-কোন কোম্পানি আইন মানছে না, আর তার পরিণতি কি।’

তবে এবি ব্যাংক ইস্যুতে আগে স্টক এক্সচেঞ্জকে জবাবদিহীতার আওতায় আনা উচিত বলে তিনি মনে করছেন। কারণ, যেখানে জুলাইয়ে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা-পরিচালকের শেয়ার ছিলো ৩০ শতাংশের ওপরে। সেখানে আগষ্টে তা বিএসইসির নির্ধারিত সীমার নিচে নামলো? তখন স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্বশীলরা কি করছিলেন। তখনতো কোন ব্যবস্থা নেন-ই নাই বরং সেপ্টেম্বরে তা আরও কমেছে। যা মেনে নেয়া যায় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তারমতে, ‘আইন কেবল কাগজে থাকলে তার কোনো মূল্য নেই। আইন তখনই জীবন্ত হয়, যখন মানুষ দেখে তা লঙ্ঘন করলে শাস্তি হয়। এবি ব্যাংকের ঘটনাটি যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা চোখ বন্ধ করে পার করে দেয়, তাহলে অন্য কোম্পানিগুলোও একই পথে হাঁটবে। কিন্তু যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বাজারে নতুন আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

বিজনেসজার্নাল/এইচকে

শেয়ার করুন

error: Content is protected ! Please Don't Try!

সিকিউরিটিজ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি

এবি ব্যাংক ইস্যুতে স্টক এক্সচেঞ্জ যেন ‘নীরব দর্শক’!

আপডেট: ০৪:৫৯:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫

শেয়ারেরবাজার মানেই স্বপ্ন, ছোট-বড় সবাই এখানে একদিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকার, ভবিষ্যৎ গড়ার আশা নিয়ে আসে। সেই আশা নিয়মে-নীতিতে ভর করে; যারা কোম্পানির পেছনে উদ্যোক্তা-পরিচালক হয়ে দাঁড়ায়- তাঁদের কাছে একটু বেশি দায়িত্ব থাকে, কারণ তাদেরই হাতে থাকা শেয়ার একজন সাধারণ বিনিয়োগকারীর আস্থা ও নিরাপত্তা বোঝায়। কিন্তু আজকাল আমরা দেখছি যে সেই আস্থা ভেঙ্গে পড়ছে; অনেক কোম্পানিতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতের শেয়ার কমে যাচ্ছে, অনেকে আইন থাকা সত্বেও সম্মিলিত শেয়ার ধারণের নির্ধারিত সীমার নিচেও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আজ আবারও প্রশ্ন উঠেছে- আইন আছে, কিন্তু তা মানে কে? এবি ব্যাংক পিএলসির সাম্প্রতিক শেয়ারহোল্ডিং পরিবর্তন যেন সেই প্রশ্নেরই নতুন জবাব হয়ে এসেছে। দেশের অন্যতম পুরনো ও আলোচিত এই বেসরকারি ব্যাংকটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে থাকা শেয়ার মাত্র এক মাসে প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে। জুলাই ২০২৫ মাসে পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকগণ কোম্পানির মোট ৩১.২১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন, কিন্তু আগস্ট মাসে সেই অংশ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১.২৩ শতাংশে। অর্থ্যাৎ ব্যাংকটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে এখন আর নেই আইন অনুযায়ী ন্যূনতম শেয়ারহোল্ডিংয়ের পরিমাণ, যা বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ আইন ও বিএসইসির নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন।

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৬১ কোটি টাকার পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা!

অথচ আইন স্পষ্টভাবে বলা আছে, তালিকাভুক্ত যে কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে অন্তত ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- যে কোম্পানির  উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে আইন অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ শেয়ার নেই, সেই কোম্পানিটি আরও শেয়ার বিক্রি করে সেপ্টেম্বর শেষে তা ১৮ শতাংশের (১৮.৯৫ শতাংশ) ঘরে নামিয়ে এনেছে। তারচেয়ে আজব বিষয় হলো- আইন লঙ্ঘণের সীমা পার করেও সেই শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জ ছিলো নিশ্চুপ দর্শক।

আরও পড়ুন: লাভোলো’র মুনাফা উড়ছে কাগজে, নগদ ডুবছে বাস্তবে!

এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য একটাই- যাতে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা কোম্পানির ভাগ্যনির্ধারণে নিজেরাও অংশীদার থাকেন, অর্থ্যাৎ তাদের স্বার্থ কোম্পানির সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কারণ, যখন পরিচালক নিজে শেয়ারের মালিক থাকেন, তখন তিনি কোম্পানির ক্ষতি হতে দিতে চান না, কারণ সেই ক্ষতি তার নিজেরও ক্ষতি। কিন্তু এবি ব্যাংকের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এক মাসের ব্যবধানে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার এতোটা কমে যাওয়া মানে, তারা হয় নিজেরা শেয়ার বিক্রি করেছেন, নয়তো সেই শেয়ার অন্য কারো কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। কেন এই বিক্রি হলো, কার কাছে বিক্রি হলো, কী উদ্দেশ্যে হলো- এসব প্রশ্নের জবাব কারও কাছেই নেই।

আরও পড়ুন: বেষ্ট হোল্ডিংসের আর্থিক প্রতিবেদনে অস্পষ্টতা: বিভ্রান্তিতে বিনিয়োগকারীরা!

শুধু এবি ব্যাংক নয়, দেশের অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানিই বছর বছর ধরে এই একই আইন অমান্য করে চলছে। কেউ গোপনে শেয়ার বিক্রি করছে, কেউ আবার আত্মীয়স্বজন বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার স্থানান্তর করছে, যাতে কাগজে-কলমে আইন মানা দেখানো যায়। অনেক কোম্পানি ধীরে ধীরে ‘silent sell’ পদ্ধতিতে নিজেদের অংশ কমিয়ে দেয়, যাতে একবারে বড় বিক্রির ঘোষণা না দিতে হয় এবং বাজারে আলোড়ন না ওঠে। কিন্তু এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধোঁয়াশায় পড়ে যায়। তারা ভাবেন, কোম্পানির পরিচালকরা যখন নিজেরাই শেয়ার বিক্রি করছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু জানেন যা সাধারণ মানুষ জানে না। এই ভয় থেকেই বাজারে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১১ সালে বিএসইসি আইন করে বলে দেয়, উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে এবং যাদের নেই, তাদের দ্রুত পূরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে একজন পরিচালক বোর্ডে থাকতে হলে অন্তত দুই শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। কিন্তু গত ১৪ বছরেও এই আইন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলো আইন ভাঙছে আর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো শুধু নোটিশ দিচ্ছে, চিঠি পাঠাচ্ছে, তারপর সময় বাড়াচ্ছে। কিন্তু কোনো শাস্তি হচ্ছে না।

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানি প্রণোদনা উধাও: ফুলে ফেঁপে উঠছে ‘রিসিভ্যাবলস’

২০২৫ সালের মাঝামাঝি বিএসইসি প্রকাশ্যে জানায়, ৪৪টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি এই আইন মানছে না, তাদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা ৩০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করছেন। তাদের নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বলা হয়েছিল, শেয়ার বাড়াতে হবে। কিন্তু কয়েক মাস কেটে গেলেও সেই নির্দেশ মানেনি বেশিরভাগ কোম্পানি। বরং কেউ কেউ আবার সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে, যা বিএসইসি বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। এতে বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কঠোর নয়, বরং নরম। ফলে কোম্পানিগুলোও মনে করে- চিঠি এলে একটু উত্তর দিলেই হবে, তাতে কিছুই হবে না।

এদিকে, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ভূমিকা এখানে সমানভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ৩০ শতাংশের নিচে নামলে তাৎক্ষণিকভাবে বাজারকে জানানো, কারণ অনুসন্ধান করা এবং তদন্ত শুরু করা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে ডিএসই বরাবরই চুপ থাকে। কখনও অনেক দেরিতে নোটিশ দেয়, কখনও সেটাও দেয় না। এতে কোম্পানিগুলো সুযোগ নেয়। তারা আইন ভেঙেও সহজেই সময় পায়, আবার বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির বোঝা বাড়ে।

আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিম: ৬৯ বছর অপেক্ষার ফাঁদে বিনিয়োগকারীরা!

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন এমন আচরণ করছে যেন তারা কোম্পানিগুলোর পরামর্শদাতা, নিয়ন্ত্রক নয়। যদি কেউ আইন ভাঙে, তাহলে তাদের বোর্ড স্থগিত করা উচিত, শেয়ার ট্রেডিং সীমিত করা উচিত- কিন্তু তা হচ্ছে না। এবি ব্যাংকের এই ঘটনাটি এক ধরনের সতর্কবার্তা। যখন একটি ব্যাংক- যার লাখো গ্রাহক, হাজারো বিনিয়োগকারী, তারই পরিচালকরা নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যেতে শুরু করেন, তখন সেটা শুধু সংখ্যার পরিবর্তন নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার সংকেত। এটি দেখিয়ে দেয়, কোম্পানির অভ্যন্তরীণ স্থিতি, ব্যবস্থাপনা বা ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়তো অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই বিক্রি ও পরিবর্তন যদি আইনবিরুদ্ধ হয়, তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু করা। সেটি না হওয়ায় বোঝা যায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি কতোটা দুর্বল।

আবু সালেহ নামের এক বিনিয়োগকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যখন দেখি পরিচালকেরা নিজেরাই শেয়ার বিক্রি করছেন, তখন মনে হয় তারা নিজের কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে আর আশাবাদী নন। তখন আমরাও ভয় পাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই অবস্থার দায় কে নেবে? আইনের যে উদ্দেশ্য ছিল বাজারে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা, সেটাই এখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই; নিয়ন্ত্রক আছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া নেই; এক্সচেঞ্জ আছে, কিন্তু তদারকি নেই। ফলে বাজারে এক অদৃশ্য বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখন বিশ্বাস হারাচ্ছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ।’

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ: কাগুজে মুনাফার আড়ালে নগদ প্রবাহের সংকট!

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলে, ‘এই অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক। কারণ, যখন বাজারের নিয়ন্ত্রকরা নিরব হয়ে যান, তখন পুঁজিবাজার এক শ্রেণির প্রভাবশালীর খেলায় পরিণত হয়। তখন সাধারণ মানুষ শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হয় না, বরং পুরো অর্থনীতির প্রতি তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় প্রয়োজন আইনের কার্যকর প্রয়োগ, তাৎক্ষণিক তদন্ত, এবং দৃশ্যমান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে তারা শুধু নামেই নয়, কাজে সত্যিকারের নিয়ন্ত্রক। যারা আইন ভেঙেছে, তাদের বোর্ডের ক্ষমতা স্থগিত করা, শেয়ার ট্রেডিংয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, এবং জনগণকে জানানো জরুরি-কোন কোম্পানি আইন মানছে না, আর তার পরিণতি কি।’

তবে এবি ব্যাংক ইস্যুতে আগে স্টক এক্সচেঞ্জকে জবাবদিহীতার আওতায় আনা উচিত বলে তিনি মনে করছেন। কারণ, যেখানে জুলাইয়ে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা-পরিচালকের শেয়ার ছিলো ৩০ শতাংশের ওপরে। সেখানে আগষ্টে তা বিএসইসির নির্ধারিত সীমার নিচে নামলো? তখন স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্বশীলরা কি করছিলেন। তখনতো কোন ব্যবস্থা নেন-ই নাই বরং সেপ্টেম্বরে তা আরও কমেছে। যা মেনে নেয়া যায় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তারমতে, ‘আইন কেবল কাগজে থাকলে তার কোনো মূল্য নেই। আইন তখনই জীবন্ত হয়, যখন মানুষ দেখে তা লঙ্ঘন করলে শাস্তি হয়। এবি ব্যাংকের ঘটনাটি যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা চোখ বন্ধ করে পার করে দেয়, তাহলে অন্য কোম্পানিগুলোও একই পথে হাঁটবে। কিন্তু যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বাজারে নতুন আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

বিজনেসজার্নাল/এইচকে