ঝলমলে শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য হতে পারে ‘অন্ধকার সুড়ঙ্গ’

- আপডেট: ০২:৩৯:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
- / ১০২৬৭ বার দেখা হয়েছে
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি শিল্প খাত ও কোম্পানিগুলোর জন্য তাৎক্ষণিক অর্থায়ন নিশ্চিত করে এবং সাধারণ মানুষকে তাদের সঞ্চয়কে লাভজনক বিনিয়োগে রূপান্তর করার সুযোগ দেয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে শেয়ারবাজার দেশকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
তবে বাজারে কিছু দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই তাদের মূলধন হারানোর ঝুঁকির মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে কিছু তালিকাভুক্ত কোম্পানি ঋণ বোঝা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং স্বচ্ছতার অভাবের কারণে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
শেয়ারবাজার একসময় ছিল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারীদের স্বপ্নের প্রতীক। ডিএসই এবং সিএসই’র মতো দুটি প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শত শত কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়ে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি দেখাচ্ছে যে, এই ঝলমলে শেয়ারবাজারও বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন এক প্রকার “অন্ধকার সুড়ঙ্গ”-এ পরিণত হয়েছে। আশু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বর্তমানের ঝলমলে শেয়ারবাজারও ফের অন্ধকার সুরঙ্গে পরিণত হতে পারে।
রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস (আরএসআরএম), নূরানী ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার এবং আরামিট সিমেন্টের মতো তিনটি কোম্পানির উদাহরণ আমাদের দেখায় যে, শুধুমাত্র বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেই বিনিয়োগকারীর স্বপ্ন পূরণ হয় না। উল্টো, কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত বা বন্ধ হলে বিনিয়োগকারীর মূলধন হারার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
শেয়ারবাজারের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি
১. অচল বা সংকটাপন্ন কোম্পানি এবং তার প্রভাব: রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করা এবং ঋণের বোঝা কোম্পানির স্থায়ী উৎপাদন বন্ধের কারণ হয়েছে। ফলে শেয়ারের মূল্য প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। বিনিয়োগকারীরা বছরের পর বছর তাদের মূলধনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করেছে।
নূরানী ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কয়েক বছরের মধ্যেই ঋণ বোঝা এবং আর্থিক সমস্যার কারণে কার্যক্রম স্থগিত হয়। বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশের প্রত্যাশা করলেও দীর্ঘদিন ধরে তারা কোনো তথ্য বা ডিভিডেন্ড পাননি। এর ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতি এবং মানসিক চাপ দুটোই বেড়ে গেছে।
আরামিট সিমেন্টের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার কারণে কোম্পানিটি লোকসান করছে। শেয়ারের বাজার মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা তাদের সঞ্চয় এবং ভবিষ্যৎ আয়ের নিশ্চয়তা হারাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: চলতি সপ্তাহে আসছে ৫ প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ড-ইপিএস
এই উদাহরণগুলি দেখায় যে, কোম্পানির কার্যক্রম স্বচ্ছ না হলে বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি অপরিমেয় হয়। ব্যবসায় লাভ-লোকসান স্বাভাবিক হলেও, তথ্যের অভাব এবং ভবিষ্যৎ অজানার কারণে ক্ষতি অপূরণীয় হয়ে ওঠে।
২. বিনিয়োগকারীর আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি: বিনিয়োগকারীরা শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হননি, বরং মানসিক চাপও বেড়েছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ করা, শেয়ারের মূল্য হ্রাস এবং উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া তাদের আত্মবিশ্বাসকে হ্রাস করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, নূরানী ডাইং-এর বিনিয়োগকারী বলেছেন, “ডিভিডেন্ডের আশাতেই বিনিয়োগ করেছিলাম। বছরের পর বছর কারখানা বন্ধ থাকলে আমাদের লোকসান ছাড়া আর কী প্রাপ্য?” এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে বিনিয়োগকারীর জন্য মূলধনের নিরাপত্তা এবং নিয়মিত আয় অপরিহার্য।
শেয়ারের বাজারমূল্যও ক্রমহ্রাস পাচ্ছে। আরএসআরএম-এর শেয়ারের দাম এক বছরে প্রায় ২০ টাকার উপরে থাকলেও বর্তমানে এটি ৯.৯০ টাকায় নেমেছে। নূরানী ডাইং-এর শেয়ারের দাম ২.৮০ টাকায় পৌঁছেছে। আরামিট সিমেন্টের শেয়ার ১২.৯০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এই পতন শুধুমাত্র বিনিয়োগকারীর ক্ষতি বাড়াচ্ছে না, বরং বাজারে বিশ্বাসও কমিয়ে দিচ্ছে।
সমস্যার মূল কারণসমূহ
১. অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা: অনেক কোম্পানি নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশে ব্যর্থ। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ধরনের অন্ধকার সৃষ্টি করে। কোম্পানি তথ্য না দেওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান।
নূরানী ডাইং উদাহরণস্বরূপ, দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের কাছে কোনো আর্থিক প্রতিবেদন বা ডিভিডেন্ড প্রদান করেনি। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধনের উপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না।
২. দুর্বল প্রশাসন এবং সুশাসনের অভাব: কোম্পানির ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাব বাজারের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। আরামিট সিমেন্টের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্নীতির অভিযোগ কোম্পানির পরিচালনায় বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, “দুর্বল কোম্পানিগুলোর ওপর নিয়মিত নজরদারি করলে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আগেই বোঝা যেত।” সুতরাং কার্যকর প্রশাসন বিনিয়োগকারীর ক্ষতি কমানোর জন্য অপরিহার্য।
৩. ঋণের বোঝা এবং আর্থিক চাপ: উচ্চ ঋণ বোঝা কোম্পানির উৎপাদন এবং কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। আরএসআরএম প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় উৎপাদন বন্ধ। নূরানী ডাইং-এর ব্যাংক ঋণ কোম্পানিকে স্থায়ীভাবে অচল করে দেয়। আরামিট সিমেন্টও ঋণ বোঝার কারণে লোকসান সহ্য করছে। ঋণের বোঝা এবং ব্যর্থ ব্যবস্থাপনা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি।
৪. নিয়ন্ত্রক সংস্থার সীমাবদ্ধতা: ডিএসই এবং বিএসইসি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। তবে কার্যকর নিয়মিত নজরদারি না থাকলে দুর্বল কোম্পানিগুলো সময়মতো শনাক্ত হয় না। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. বিনিয়োগকারীর সীমিত সচেতনতা: অনেক বিনিয়োগকারী কোম্পানির আর্থিক অবস্থা যাচাই না করে বিনিয়োগ করেন। তথ্যের অভাব এবং ঝুঁকি বোঝার সীমাবদ্ধতা তাদের ক্ষতির কারণ। নতুন বিনিয়োগকারীরা সহজেই ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ
১. স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য করা উচিত। ঋণ বোঝা, উৎপাদন, পরিচালনাগত সিদ্ধান্ত এবং লভ্যাংশ সম্পর্কিত তথ্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ভাগ করা আবশ্যক।
২. কঠোর নিয়ন্ত্রক নজরদারি: দুর্বল কোম্পানিগুলো নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় আনা দরকার। ঋণ বোঝা, উৎপাদন সক্ষমতা এবং ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতা সূচক তৈরি করা যেতে পারে।
৩. বিনিয়োগকারীর সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ এবং গাইডলাইনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত।
৪. প্রয়োজনীয় পুনর্গঠন: অচল বা সংকটাপন্ন কোম্পানিগুলোকে পুনর্গঠন এবং কার্যকরী মূলধন নিশ্চিত করে পুনরায় চালু করা যায়। এতে বিনিয়োগকারীর ক্ষতি কমানো সম্ভব।
৫. সতর্কতামূলক ব্যবস্থা: শেয়ারের দাম, ঋণ বোঝা এবং পরিচালনাগত সংকেত বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করা যেতে পারে। “রেড ফ্ল্যাগ” সূচক তৈরি করলে বাজারের অস্থিরতা মোকাবেলা সহজ হয়।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনও সম্ভাবনাময়। তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস, নূরানী ডাইং এবং আরামিট সিমেন্টের উদাহরণ দেখায় যে, কোম্পানির দুর্বলতা, তথ্যের অভাব, ঋণের বোঝা এবং প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা একত্রিত হয়ে বিনিয়োগকারীর ক্ষতি বাড়ায়।
সমাধান শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ নয়, বরং কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা, বিনিয়োগকারীর সচেতনতা এবং প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব। নিরাপদ এবং লাভজনক শেয়ারবাজারের জন্য স্বচ্ছতা, নিয়মিত প্রতিবেদন, আর্থিক পুনর্গঠন এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।
লেখক: হাসান কবির জনি
প্রকাশক ও সম্পাদক, বিজনেস জার্নাল।