তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা পুঁজিবাজারের বড় চ্যালেঞ্জ: বিএসইসি কমিশনার

- আপডেট: ১১:১৭:২৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
- / ১০২০৮ বার দেখা হয়েছে
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মো. সাইফুদ্দিন বলেছেন, “তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা এখনো পুঁজিবাজারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ, যা বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির কারণ হয়ে আছে।”
গতকাল বুধবার (৮ অক্টোবর) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ পিএলসি, ডিএসই ব্রোকারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) যৌথ উদ্যোগে হাইব্রিড পদ্ধতিতে আয়োজিত এক শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য তিনি এ কথা বলেন।
ডিএসই থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ ২০২৫ এর ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ডিএসই’র চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম, সিএসই’র চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ডিএসই’র সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামরুন নাহার।
সাইফুদ্দিন বলেন, “আমাদের পুঁজিবাজারে একটি সম্পূর্ণ ইনভেস্টমেন্ট ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। আমরা এখন কোথায় আছি, তা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমাদের বর্তমান অবস্থা, কাঠামোগত ঘাটতি এবং জবাবদিহিতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি।”
বিএসইসি’র কমিশনার বলেন, “পুঁজিবাজারের প্রযুক্তিগত কাঠামোয় রয়েছে এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারগণ যেমন সিডিবিএল, সিসিবিএল ইত্যাদি। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখনো যথাযথ যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব আছে। এখন সময় এসেছে সব প্রতিষ্ঠানের একসাথে সমন্বয় করে কাজ করার।”
তিনি বলেন, “বিএসইসি সম্প্রতি একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে-এক্সট্যান্ডেড বিজনেস রিপোর্টিং মডেল (এসবিআরএম) ফরম্যাটে আর্থিক প্রতিবেদন দাখিলের ব্যবস্থা চালু করার।এটি একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেশিন-রিডেবল ফরম্যাট, যা আইএফআরএস স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে তৈরি। এতে গবেষণা, বিশ্লেষণ, এবং নজরদারি অনেক সহজ হবে।এটি করতে হলে অডিটরসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতার প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, “বাস্তবতা হচ্ছে বাজারের অংশগ্রহণ কমছে, ফলে সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে।যারা পুঁজিবাজারে আছেন তাদের সম্পদ বাড়ছে না, বরং বাজারের আকার বছরে প্রায় ৩ শতাংশ হারে সঙ্কুচিত হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির বিপরীত চিত্র। এখনই সময় যৌথভাবে দায়িত্ব নেওয়ার।”
তিনি বলেন, “প্রযুক্তি এখন আমাদেরকে নতুনভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছে। আগে যেসব কাজে সীমাবদ্ধতা ছিল, আজ তা সম্ভব। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা যদি উদ্যোগ নিই, তাহলে পুরো কাঠামোকে বদলে দেওয়া সম্ভব। আসুন, আমরা সবাই মিলে সেটি বাস্তবায়ন করি।”
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, “বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন প্রোডাক্ট আসছে। সাথে সাথে পুঁজিবাজারে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা প্রযুক্তিতে বড় বড় বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু সেখান থেকে সুফল খুব ভালভাবে পাইনি। একটা বড় কারণ হলো পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সম্বয়ের অভাব। আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারের টেকনোলজি আর্কিটেক্ট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য যদি অবাধ তথ্য প্রবাহ না থাকে তবে প্রযুক্তির মাধ্যমে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তার অনেক কিছু সিস্টেম ধরতে পারছে না। এজন্য অনেক অনিচ্ছাকৃত ননকমপ্লায়েন্স হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।”
তিনি বলেন, “ফাইন্যান্সিয়াল প্রোডাক্ট নির্ভর করে তার আন্ডারলাইন অ্যাসেটের উপর। ডিএসই’র প্রোডাক্টগুলোর অধিকাংশই হলো ইক্যুইটি। একটি বড় অংশের কোম্পানির তথ্যগুলো সঠিকভাবে আসছে না। সেক্ষেত্রে পুরো দেশের ইকোসিস্টেম পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। আমাদের কার্যক্রমগুলোকে টেকনোলজি ব্যবহার করে ডিজিটাইলাইজ করতে পারলে স্বচ্ছতা বৃদ্দি পাবে। সেক্ষেত্রে শুধু পুঁজিবাজার নয় ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব আদায়সহ আরো সব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করে অর্থনীতিকে আরো দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান বলেন, “শেয়ারবাজারে অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের পরও কিছু অনিয়ম ও প্রতারণা ঘটেছে, যা ইঙ্গিত করে যে প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ ও তদারকি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।”
তিনি বলেন, “প্রযুক্তি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য হলো দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি; তবে তা সফল করতে রিপোর্টিং, সারভেলেন্স ও মনিটরিং সিস্টেম শক্তিশালী করা জরুরি।”
তিনি বলেন, “পুঁজিবাজারের ইকোসিস্টেমে এখনো কিছু ‘মিসিং লিংক’ রয়েছে, যা স্ক্যামের ঝুঁকি বাড়ায়। এজন্য তথ্যের সঠিক ব্যবহার, যাচাই ও ডিজিটাল টুলস ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।”
হাবীবুর রহমান উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষের আর্থিক জ্ঞান সীমিত, ফলে অনেক বিনিয়োগকারী গুজবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন ও ক্ষতিগ্রস্ত হন।”
ডিএসই’র প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আসাদুর রহমান বলেন, “বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহটি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা ও সুরক্ষা প্রচার এবং ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিনিয়োগ শিক্ষা বৃদ্ধি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। আমরা আমাদের বাজারে স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। সুশাসন ও জবাবদিহিতার মান বজায় রাখতে এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
সিডিবিএলর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আব্দুল মোতালেব চৌধুরী বলেন, “উদীয়মান প্রযুক্তির ব্লকচেইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো উদ্ভাবনী বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। সিডিবিএল ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে বেশ কিছু কার্যক্রম চালু করেছে, যার মধ্যে লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য বিনিয়োগকারীদের ই-মেইল ও মোবাইল নম্বরে প্রেরণ অন্যতম।”
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকলে ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, “অগ্রসরমান প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ফাইন্যান্স বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ক্ষমতায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সচেতন ও তথ্যসমৃদ্ধ বিনিয়োগকারীই একটি টেকসই, স্বচ্ছ ও কার্যকর বাজার গঠনের মূল চালিকাশক্তি।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে এবং ডিজিটাল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বিনিয়োগকে আরো সহজ করেছে। তবে এখনও অনেক বিনিয়োগকারী রিয়েল-টাইম তথ্যের সীমিত প্রাপ্যতা, আর্থিক পণ্যের জটিলতা, কম আর্থিক সাক্ষরতা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভুল তথ্য ও প্রতারণার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ডেটা অ্যানালিটিক্স ও রোবো-অ্যাডভাইজরের মতো উদীয়মান প্রযুক্তি পুঁজিবাজারে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এসব প্রযুক্তি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে তথ্যভিত্তিক ও নিরাপদ করছে, একই সঙ্গে বাজারে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করছে।”
সমাপণী বক্তব্যে ডিএসই’র পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জাান বলেন, “আমরা যে সকল টেকনোলজি ব্যবহার করি সেগুলো আমাদের নিজেদের তৈরি করা শিখতে হবে। সেটি যদি আমরা না করি আমরা প্রযুক্তি সরবরাহকারীদের অধিনস্ত হয়ে থাকবো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে এ সকল কাজে যুক্ত করতে হবে। তাহলেই আমরা প্রযুক্তিতে উন্নত হতে পারবো, যা আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
সিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. সাই্ফুর রহমান মজুমদারের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সিএফএ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট আসিফ খান, আইসিএমএবি প্রেসিডেন্ট মাহতাব উদ্দিন আহমেদ এবং আইসিএবির, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রাক্তন সিনিয়র সচিব শুভাশীষ বোস।
ঢাকা/এসএইচ