বেস্ট হোল্ডিংস কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাচ্ছে আইসিবি!

- আপডেট: ১১:৩৫:৩১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
- / ১০২৪৪ বার দেখা হয়েছে
রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) প্রধান দায়িত্ব ছিল পুঁজিবাজারে স্থিতি রক্ষা, বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুরক্ষা করা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই প্রতিষ্ঠানের নামই এখন অনিয়ম, অস্বচ্ছ বিনিয়োগ আর দুর্বল তদারকির অভিযোগে আলোচিত। বেস্ট হোল্ডিংসের বিতর্কিত প্লেসমেন্ট ও আইপিও ইস্যুতে আইসিবি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে গুরুতর অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ব্যবস্থার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিএসইসি’র তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের নিবন্ধন তিন বছরের জন্য স্থগিত ও আইসিবির বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী, বেস্ট হোল্ডিংসের শেয়ার ইস্যু প্রক্রিয়ায় আইন ও নীতিমালা উপেক্ষা করে মূল্যায়ন জালিয়াতি, ভুল তথ্য সরবরাহ ও বিনিয়োগ বিভ্রান্তি ঘটানো হয়েছে- যার সবকিছুর সঙ্গে আইসিবির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তদন্ত কমিটির দাবি, বেস্ট হোল্ডিংসের প্লেসমেন্ট ও শেয়ার মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আইসিবি ও তার সহযোগীরা সিকিউরিটিজ আইন, প্লেসমেন্ট রুলস ও কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের একাধিক বিধান লঙ্ঘন করেছে।
আরও পড়ুন: বেস্ট হোল্ডিংস: ডেফার্ড ট্যাক্সের জাদুতে কর পরিশোধেও বেড়েছে মুনাফা!
তদন্তে দেখা গেছে, বেস্ট হোল্ডিংস কোম্পানির প্রতি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ছিল ১০ টাকা, কিন্তু আইসিবি ও আইসিবি ক্যাপিটালের সুপারিশে ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ শেয়ার বিক্রি হয়েছিল ৬৫ টাকা দরে । এই দরে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি নিজেই কোটি কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় করে।
অভিযোগ অনুযায়ী, কোম্পানির প্রকৃত সম্পদ ও নগদ প্রবাহ সেই উচ্চমূল্যকে সমর্থন করে না; বরং আর্থিক বিবরণীতে মুনাফা দেখানো হলেও নগদ প্রবাহে বড় ঘাটতি ছিল। এর ফলে সরকারি বিনিয়োগের হাজার কোটি টাকারও বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ‘ইস্যু ম্যানেজার’ হিসেবে কাজ করেও প্রকৃত সম্পদ যাচাই না করেই মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছে। জমি, হোটেল প্রকল্প ও সম্পত্তির মূল্য কাগজে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল, যা বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করেছে।
এমনকি কিছু দলিল ও সম্পদের মালিকানা নিয়ে সন্দেহজনক তথ্য পাওয়া গেছে- যা পরে জাতীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) দপ্তরও তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিমের হিসাবের ফাঁদে শেয়ারবাজার!
এর আগে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শুক্লা দাস একটি সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেন, তাদের সঙ্গে বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের কোনো ধরনের চুক্তি হয়নি। আইসিবি তাদের ইস্যু ম্যানেজার নয়। পরবর্তীতে আইসিবি জানিয়েছিলো আইসিবিকে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বেস্ট হোল্ডিংস কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছিল, এর ভিত্তিতেই ইস্যু ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এবং ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পেয়েই বেস্ট হোল্ডিংসের পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির আবেদন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেওয়া হয়েছে।
বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেস্ট হোল্ডিংস লোকসানি হলেও কাগজে-কলমে মুনাফা দেখানো হয়। কোম্পানিটির জমির দলিল ও মালিকানা জালিয়াতিতে ভরপুর। একটি জমির কাগজে মূল্য দেখানো হয় ৪ হাজার ৮১ কোটি টাকা। কিন্তু এই জমির প্রকৃত মালিকানা কোম্পানির নামে নেই। আবার কোম্পানির এই ভুয়া প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে ৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠান এখানে ১ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে সোনালী ৫০০ কোটি, অগ্রণী ৫০০ কোটি, জনতা ৫০০ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৩০০ কোটি এবং সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ১৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। আর এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯’শ কোটি টাকার ক্ষতি চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি।
আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৬১ কোটি টাকার পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা!
তদন্ত কমিটি এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে বিনিয়োগ করায় আইসিবিকে ন্যূনতম ১০ লাখ টাকা এবং আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের নিবন্ধন তিন বছরের জন্য স্থগিত করা সুপরিশ করা হয়েছে। এছাড়া আমিন আহমেদ ও হাসান আহমেদকে ১০ কোটি টাকা করে মোট ২০ কোটি টাকা জরিমানা; রেস ম্যানেজমেন্টকে ২৫ কোটি টাকা জরিমানা ও নিবন্ধন বাতিল; নাফিজ সরাফাত ও হাসান তাহের ইমামকে আজীবনের জন্য শেয়ারবাজারে নিষিদ্ধ; এবং বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে তাঁদের কমিশনারদের বিরুদ্ধে দুদকে তদন্ত পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও ১০টি মিউচুয়াল ফান্ডের নিবন্ধন বাতিল, বিজিআইসিকে জরিমানা এবং সংশ্লিষ্ট ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ও অডিট ফার্মগুলোর লাইসেন্স স্থগিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে, এর আগে সিএজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রূপান্তরযোগ্য বন্ডে আইসিবির বিনিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়, এবং এতে সরকারি তহবিলের সুরক্ষা ঝুঁকিতে পড়েছে। এছাড়া, আইসিবির এই ‘অস্বাভাবিক বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে’ প্রায় ৪৩৮ কোটি টাকার সম্ভাব্য ক্ষতি তৈরি হয়েছে। অর্থ্যাৎ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায় অস্বীকার করলেও, বাস্তবতা এখন পুরোপুরি বিপরীত দিক নির্দেশ করছে।
আরও পড়ুন: লাভোলো’র মুনাফা উড়ছে কাগজে, নগদ ডুবছে বাস্তবে!
ওই সময়ে সংসদে উপস্থাপিত সিএজি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আইসিবি তাদের নিজস্ব প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে ১৫০ কোটি টাকার রূপান্তরযোগ্য বন্ডে বিনিয়োগ করেছে, যদিও ওই কমিটি আগেই বলেছিল যে বেস্ট হোল্ডিংসের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই সিদ্ধান্তকে সিএজি ‘অযৌক্তিক ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ যাচাই-বাছাই ও সতর্কতা ছাড়াই এই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সরকারি তহবিল মারাত্মক আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে। কারণ আইসিবির বিনিয়োগ করা অর্থ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও সরকারি বিনিয়োগ তহবিল থেকে আসে, যা নিরাপদ ও লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ থাকে। কিন্তু বেস্ট হোল্ডিংসের মতো অনিশ্চিত ও ঋণভারাক্রান্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আইসিবি সেই তহবিলের নিরাপত্তা বিপন্ন করেছে।
আরও পড়ুন: বেষ্ট হোল্ডিংসের আর্থিক প্রতিবেদনে অস্পষ্টতা: বিভ্রান্তিতে বিনিয়োগকারীরা!
সিএজি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইসিবির প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি স্পষ্টভাবে লিখেছিল যে বেস্ট হোল্ডিংসের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই, কিন্তু ব্যবস্থাপনা সেই সুপারিশ উপেক্ষা করে বিনিয়োগ অনুমোদন দেয়। এতে বোঝা যায় যে, আইসিবি নিজস্ব নীতি ও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ভঙ্গ করেছে এবং বিনিয়োগ অনুমোদন রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী বিবেচনায় করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও একটি গুরুতর অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়, যে হোটেল সম্পত্তি (Le Méridien Dhaka) বন্ধক হিসেবে দেখানো হয়েছিল, তার বন্ধক দলিল ও বিমা নথিতে আইসিবির নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যদিও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেখানে আইসিবির নাম থাকা আবশ্যক ছিল। এর ফলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে, কারণ প্রয়োজনে আইসিবি সেই সম্পত্তির উপর কোনো আইনি অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না।
আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানি প্রণোদনা উধাও: ফুলে ফেঁপে উঠছে ‘রিসিভ্যাবলস’
এছাড়াও প্রতিবেদনে বলা হয়, আইসিবি বন্ডের কুপন ও মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে দেয়, অথচ এ বিষয়ে বোর্ড বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়নি। সিএজি এটিকে ‘গুরুতর প্রক্রিয়াগত লঙ্ঘন’ (Serious Procedural Violation) হিসেবে উল্লেখ করেছে। অর্থ্যাৎ, আইসিবি নিজের সিদ্ধান্তে চুক্তির শর্ত পরিবর্তন করেছে, যা আইনি ও প্রশাসনিকভাবে বেআইনি।
প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ করা হয়, আইসিবির ব্যালান্স শীট ও আর্থিক বিবরণীতে বেস্ট হোল্ডিংস থেকে প্রাপ্ত অবাস্তব আয়কে (Unrealized Income) প্রকৃত মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি হিসাববিদ্যার নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন মানদণ্ড আইএফআরএস (IFRS) অনুযায়ী সরাসরি অনিয়ম। সিএজি জানায়, ‘আইসিবির আর্থিক বিবরণীতে প্রকৃত বিনিয়োগ অবস্থার প্রতিফলন নেই; অনিশ্চিত ও সন্দেহজনক আয়কে মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা বিভ্রান্তিকর।’
আরও পড়ুন: এবি ব্যাংক ইস্যুতে স্টক এক্সচেঞ্জ যেন ‘নীরব দর্শক’!
সবশেষে প্রতিবেদনে বলা হয়, আইসিবির ব্যবস্থাপনা যথাযথ সতর্কতা ছাড়াই বিনিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে, যা তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া ও সরকারি নীতির লঙ্ঘন। এর ফলে সরকারি অর্থ ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়েছে। সেজন্য ওই সময়ে সিএজি সুপারিশ করেছিলো, বেস্ট হোল্ডিংস থেকে অবিলম্বে বিনিয়োগ ফেরত আনতে হবে এবং যেসব কর্মকর্তা এই অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অনিয়ম করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
সিএজি যে অডিট অবজেকশন রিপোর্ট সংসদে জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে আইসিবির ২০১৫-২০১৬ ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের আর্থিক কার্যক্রম নিরীক্ষার সময়ে দেখা গেছে, সরকারি এই বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান কেবল তহবিলের খরচ বিবেচনায় করলে ওই বন্ড বিনিয়োগটি অলাভজনক ছিল। এবং বিনিয়োগ করা হয়েছে এমন একটি কোম্পানিতে যার ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা সন্তোষজনক নয়। এ ক্ষেত্রে, আইসিবির কাছে ১৫৪ কোটি টাকা এখনও আদায় হয়নি।
আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিম: ৬৯ বছর অপেক্ষার ফাঁদে বিনিয়োগকারীরা!
তবে ওই সময়ে সিএজি নির্দেশ দিলেও আইসিবি অর্থ সংগ্রহ করার পরিবর্তে বেস্ট হোল্ডিংস বন্ডের কুপন পরিশোধের গুণমান সময়সীমা তিন বছর বাড়িয়ে ১৩ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত করা হয়েছিলো। এবং বন্ড বিনিয়োগের রিটার্ন সময় বাড়িয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করা হয়েছিলো।
এসব বিষয়ে কথা বলতে আইসিবির কোম্পানি সচিব রোকসানা ইয়াসমিনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে তার কথা বলার এখতিয়ার নাই বলে জানান।
পরবর্তীতে আইসিবি’র মহাব্যবস্থাপক বিভাস সাহার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বেস্ট হোল্ডিংস ইস্যুতে আইসিবির ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে আইসিবির মূল দায়িত্ব ছিল সুশৃঙ্খল বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তারা বরং ‘অতি-আগ্রহী বিনিয়োগকারী’ হিসেবে আচরণ করেছে, যেখানে সঠিক মূল্যায়ন, ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও আর্থিক সতর্কতা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। তারা আরও বলেন, আইসিবি একটি রাষ্ট্রীয় তহবিলের রক্ষক। তাদের প্রতিটি বিনিয়োগই জনগণের অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই অর্থ এমন এক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে যার আর্থিক সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ- এটা কেবল একটি ভুল সিদ্ধান্ত নয়, এটি পুঁজিবাজারে আস্থার অপচয়।
আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ: কাগুজে মুনাফার আড়ালে নগদ প্রবাহের সংকট!
বাজার সংশ্লিষ্টদের অনেকেই মনে করেন, আইসিবি ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে’ বিনিয়োগ করেছে এবং পরে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আইসিবির প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগ না করার সুপারিশ করেছিল, কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেই প্রতিবেদন উপেক্ষা করেছে। এটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার দুর্বলতার একটি বড় প্রমাণ।
তাদের মতে, বেস্ট হোল্ডিংস ইস্যু শুধু একটি কোম্পানির আর্থিক অনিয়ম নয়, বরং আইসিবির সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আইসিবিকে নিরাপদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু এই কেলেঙ্কারির পর অনেকেই মনে করছেন যে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির তদারকি ও স্বচ্ছতা এখন প্রশ্নের মুখে। কারন, যখন রাষ্ট্রীয় সংস্থা নিজের আর্থিক নীতিমালা মানে না, তখন বাজারে নৈতিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। বেস্ট হোল্ডিংস ইস্যু দেখিয়ে দিয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি ছাড়া এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও দায়মুক্ত নয়।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, আইসিবি কখনো বাজারে স্থিতিশীলতা আনার ভূমিকা পালন করার কথা, কিন্তু এখানে তারা বাজারকে বিভ্রান্ত করেছে। বেস্ট হোল্ডিংসের শেয়ারমূল্য অবাস্তবভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে, অথচ আইসিবি সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। তাদের মতে, আইসিবি এখন এক ‘দ্বৈত অবস্থানে’, একদিকে তারা বাজারে স্থিতিশীলতার প্রতীক, অন্যদিকে অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত। এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আইসিবিকে তার প্রশাসনিক ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে। তারা আরও বলেন, বিএসইসি যদি আইসিবির বিরুদ্ধে সুপারিশ কার্যকর করে, তাহলে এটি বাজারে ‘Accountability Turnaround’ হিসেবে কাজ করবে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রথমবারের মতো নিজেদের আর্থিক সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবে। যা পুরো বাজার ও আর্থিক খাতে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বিজনেসজার্নাল/ঢাকা/এইচকে