আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘কাগুজে মুনাফা’
রপ্তানি প্রণোদনা উধাও: ফুলে ফেঁপে উঠছে ‘রিসিভ্যাবলস’ (পর্ব-২)

- আপডেট: ০৯:৩০:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১০৩০৬ বার দেখা হয়েছে
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অনেকেই এখন কাগুজে মুনাফার চমকপ্রদ তথ্য দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। বাস্তবে নগদ প্রবাহ দুর্বল হলেও বা পাওনা টাকা আদায় অনিশ্চিত হলেও, আর্থিক প্রতিবেদনে সেই চিত্র গোপন রেখে বা ভিন্নভাবে সাজিয়ে তারা এমন এক মুনাফার গল্প তৈরি করছে যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চোখে পড়লেই আস্থা জন্মায়। কিন্তু এই আস্থা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ে যখন প্রকৃত তারল্য প্রবাহ সংকট প্রকাশ পায়।
আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত নগদ প্রবাহ বা পাওনা আদায়ের অনিশ্চয়তা গোপন রেখে কাগুজে হিসাব দিয়ে মুনাফার পাহাড় তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে নগদ প্রবাহ দুর্বল থাকায় এই কৃত্রিম মুনাফা একসময় ভেঙে পড়ে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই। এই প্রবণতার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর সদ্য প্রকাশিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয় মাসের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন।
এর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষন শুরু করে ‘বিজনেস জার্নাল’-এর অনুসন্ধানী দল। কোম্পানিটির ২০২৩-২৪ সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের প্রান্তিক প্রতিবেদনের চুল-চেড়া বিশ্লেষনে বেরিয়ে আসে কাগুজে মুনাফার প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি তারল্য সঙ্কট, অনিয়ন্ত্রিত পাওনা ও এর আদায়ে ধীরগতি, ডিভিডেন্ডের অযৌক্তিকতা ও আর্থিক অসঙ্গতিসহ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। ইতিমধ্যে গত ২১ সেপ্টেম্বর ‘আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ: কাগুজে মুনাফার আড়ালে নগদ প্রবাহের সংকট!’-শিরোনামে প্রথম পর্বের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানিটি নিয়ে বিজনেস জার্নালের করা পাঁচ পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।
কোম্পানির প্রতিবেদন বিশ্লেষনে দেখা যাচ্ছে, ট্রেড রিসিভেবলস বা পাওনা টাকার অংক অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। গত বছরের জুনে এ খাতে কোম্পানির পাওনা ছিল ৭৫ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৭ টাকা, অথচ চলতি বছরের মার্চ শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৯১ কোটি ৫ লাখ ৭০ হাজার ৪৯৯ টাকায়। মাত্র নয় মাসে ১৫ কোটির বেশি বৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এর মধ্যে ২৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা এমন পাওনা, যা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে আদায় হয়নি।
আন্তর্জাতিক হিসাব মান IFRS 9 অনুযায়ী এ ধরনের পাওনার জন্য আগেই “Expected Credit Loss” প্রভিশন রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ এই বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। ফলে কাগজে মুনাফার হিসাব ঠিকই ফুলে উঠছে, কিন্তু বাস্তবে টাকা আসবে কি না- সে নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এটি বিনিয়োগকারীদের চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রতিবেদনের আরেকটি অদ্ভুত দিক হলো এক্সপোর্ট ইনসেনটিভ রিসিভেবল নিয়ে। গত বছর কোম্পানির এক্সপোর্ট ইনসেনটিভ পাওনা ছিল ১৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। অথচ চলতি নয় মাসে ৮০ কোটিরও বেশি রপ্তানি করেছে কোম্পানি। বাংলাদেশে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা পাওয়া বাধ্যতামূলক। IFRS 15 এবং IAS 20 অনুযায়ী এই আয় আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানোও জরুরি। কিন্তু আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ এবার ইনসেনটিভ রিসিভেবলকে শূন্য দেখিয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে বিজনেস জার্নালের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি সচিব মাহফুজুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিমুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি বা তিনি মেসেজের উত্তর দেননি।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের টিঅ্যান্ডটি বা ল্যান্ডফোনে কথা বলেও কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন মান (IFRS) ও আন্তর্জাতিক হিসাব মানদণ্ড (IAS) স্পষ্টভাবে বলছে, কোনো কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ পাওনা ও নগদ প্রবাহের ক্ষেত্রে। IFRS 9 অনুযায়ী ১৮০ দিনের বেশি পুরনো পাওনাকে “উচ্চ ঝুঁকি” হিসেবে ধরা হয় এবং এর জন্য “Expected Credit Loss (ECL)” প্রভিশন রাখা বাধ্যতামূলক।
IFRS 7 আবার কোম্পানিকে এ ধরনের ঝুঁকি এবং প্রভিশনের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে বলে। কিন্তু আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ ২৬ কোটিরও বেশি পুরনো বকেয়ার কোনো প্রভিশন দেখায়নি।
একইভাবে IAS 1 নির্দেশ দেয় প্রতিটি আইটেম আলাদা করে দেখাতে—Collections, Exchange Gain, Write-off—কিন্তু কোম্পানি এগুলো net off করে একই অংক বসিয়েছে। একজন বাজার বিশ্লেষক বলেন, “এটা সংখ্যার ভেলকিবাজি ছাড়া কিছু নয়, বিনিয়োগকারীরা আসল নগদ প্রবাহ বুঝতেই পারছেন না।”
রপ্তানি প্রণোদনা নিয়ে অসঙ্গতিও গুরুতর। IAS 20 অনুযায়ী সরকারের যেকোনো নগদ প্রণোদনা বা গ্র্যান্ট যুক্তিযুক্তভাবে আদায়যোগ্য হলে তা আয়ের খাতায় বা নোট আকারে প্রকাশ করতে হবে। IFRS 15 অনুযায়ী, ব্যবসার কার্যক্রম থেকে সম্ভাব্য যে কোনো আয় হলে সেটি প্রকাশ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশের প্রচলিত নীতিতে রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা নিশ্চিত হওয়ায় এটি লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। অথচ আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ ৮০ কোটিরও বেশি রপ্তানি করার পরও ইনসেনটিভকে শূন্য দেখিয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি হয়তো আয় লুকানোর কৌশল, নয়তো বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করার একটি ফাঁদ। আর বিনিয়োগকারীরা বলছেন, আমরা জানি রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা আসে, কিন্তু তারা সেটা গোপন করছে। এটা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। এই ধরনের অসঙ্গতি এখন বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ইতোমধ্যেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কাগজে মুনাফা দেখে যাঁরা আশাবাদী হয়েছিলেন, তাঁরা এখন শঙ্কিত যে, আসল নগদ প্রবাহের দুর্বলতা এক সময় কোম্পানির শেয়ারদর ধসিয়ে দিতে পারে।
সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা এভাবে বারবার ক্ষুণ্ণ হলে গোটা শেয়ারবাজারই আস্থার সংকটে পড়বে। আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজে যা ঘটছে, এটা ধোঁকার খেলা। নগদ টাকা আসছে না, অথচ মুনাফা সাজানো হচ্ছে। এর ফলে শেয়ারদরে কৃত্রিম চাপ তৈরি হবে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে এখনই যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এ ধরনের অসঙ্গতি আরও বাড়বে। প্রয়োজন বিস্তারিত অডিট, প্রয়োজন সঠিক প্রভিশন প্রকাশ, প্রয়োজন রিসিভেবল রিকনসিলিয়েশন ও এক্সপোর্ট ইনসেনটিভ নিয়ে পূর্ণ স্বচ্ছতা। অন্যথায় শুধু আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ নয়, বরং গোটা বাজারে আস্থার সংকট দেখা দেবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আস্থা। কিন্তু কোম্পানিগুলো কাগুজে হিসাবের খেলায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে। ইপিএস ও এনএভি আর ডিভিডেন্ড দিয়ে শেয়ারের দাম বাড়ালেও বাস্তবতা হলো নগদ প্রবাহ সংকট। বিনিয়োগকারীরা একবার প্রতারিত হলে তারা পুরো বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাগজে মুনাফা দেখিয়ে কোম্পানি হয়তো শেয়ারদর সাময়িকভাবে ধরে রাখতে পারবে, কিন্তু নগদ প্রবাহ সংকট একদিন না একদিন ধরা পড়বেই। তখন শেয়ারদর ধসে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই।’
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো, তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি কাগজে মুনাফার জাদু দেখিয়ে শেয়ারদর টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নগদ প্রবাহ দুর্বল হলে সেই মুনাফার জাদু একদিন ধসে পড়বেই। তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা, যারা তাদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে শেয়ার কিনেছিলেন। এই কারণে বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন শুধু একটি কোম্পানির অসঙ্গতি নয়, বরং পুরো শেয়ারবাজারের জন্য একটি সতর্ক সংকেত।’ এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জকে (বিএসইসি) আরও কঠোর হতে হবে বলে তিনি মনে করেন। (চলবে…)