০৭:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
৬ মাসে ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস ১,৬৭১ শতাংশ বৃদ্ধি

লাভেলো আইসক্রিমের হিসাবের ফাঁদে শেয়ারবাজার! (পর্ব-৩)

বিশেষ প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৯:৫০:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১০২৬৩ বার দেখা হয়েছে

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহু কোম্পানি এখন এমন এক হিসাবের খেলায় মেতে উঠেছে, যেখানে প্রকৃত আয় বা নগদ প্রবাহ না বাড়লেও আর্থিক প্রতিবেদন দেখে মনে হয় কোম্পানিটি প্রচুর মুনাফা করছে। বিনিয়োগকারীরা এই কাগুজে মুনাফার ফাঁদে পড়ে বেশি দামে শেয়ার কিনে ফেলছেন, অথচ বাস্তবে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। এই প্রতারণার মূল অস্ত্র হচ্ছে ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস, ট্রেড রিসিভ্যাবলস এবং ইনকাম ট্যাক্স ও ডেফার্ড ট্যাক্স ক্যালকুলেশনের মতো জটিল হিসাবের অংশ, যা অনেক সময় সচেতন বিনিয়োগকারীর চোখেও ধরা পড়ে না। আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএস ও আইএফআরএস)-এর নিয়ম না মেনে এসব সংখ্যার খেলা দিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের আর্থিক প্রতিবেদনকে কৃত্রিমভাবে সাজিয়ে তোলে, যাতে মুনাফা অনেক বেশি দেখায় এবং বাজারে তাদের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসির অনিরীক্ষিত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন (৩০ জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) এই ধরনের ফ্যাব্রিকেটেড হিসাবের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কোম্পানির মুনাফা প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেলেও, তার পেছনে বিক্রির যৌক্তিক কারণ বা নগদ প্রবাহ বৃদ্ধির প্রমাণ নেই। বরং প্রতিবেদনের নানা জায়গায় দেখা গেছে আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে হিসাব কৌশলে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা।

ঠিক এ কারণেই প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষন শুরু করে ‘বিজনেস জার্নাল’-এর অনুসন্ধানী দল। কোম্পানিটির ২০২৩-২৪ সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের প্রান্তিক প্রতিবেদনের চুল-চেড়া বিশ্লেষনে বেরিয়ে আসে কাগুজে মুনাফার প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি তারল্য সঙ্কট, অনিয়ন্ত্রিত পাওনা ও এর আদায়ে ধীরগতি, ডিভিডেন্ডের অযৌক্তিকতা ও আর্থিক অসঙ্গতিসহ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। এরই ধারাবাহিকতায় লাভেলো আইসক্রিম নিয়ে বিজনেস জার্নালের করা আট পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতিটি দেখা যায় কোম্পানির ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলসে। অর্থ্যাৎ কোম্পানিটি যেসব রিলেটেড পার্টি বা সহযোগী কোম্পানির কাছে টাকা পাওনা দাবি করছে, ৩০ জুন ২০২৪-এ তার পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু মাত্র ছয় মাসে (৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৮ লাখ ৫১ হাজার টাকায়। অর্থ্যাৎ, শতাংশ হিসেবে মাত্র ৬ মাসে যার পরিমাণ বেড়েছে ১,৬৭১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে হঠাৎ করেই প্রায় ১৪ কোটি টাকার বেশি পাওনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি রিপোর্টের কোথাও বলেনি যে, এই টাকা কার কাছে, কেন, কিভাবে এবং কখন ফেরত আসবে।

আন্তর্জাতিক হিসাব মান IAS 24 (Related Party Disclosures) অনুযায়ী, এই তথ্যগুলো প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। কারণ, রিলেটেড পার্টির সঙ্গে কোনো লেনদেন মানেই সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত বা মুনাফা ফুলিয়ে দেখানোর ঝুঁকি। তবে এখানে এই নিয়ম মানা হয়নি।

বাস্তবে দেখা যায়, অনেক কোম্পানি তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে কাগুজে বিক্রির বিল তৈরি করে রাজস্ব বাড়িয়ে দেখায়। এতে আয় বাড়ে, কিন্তু নগদ টাকা আসে না। ফলে কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থার চেয়ে প্রতিবেদন অনেক শক্তিশালী মনে হয়। বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে শেয়ার কেনেন, আর কোম্পানির ভেতরের মালিকরা তখন নিজেদের শেয়ার বিক্রি করার সুযোগ নেন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ট্রেড রিসিভ্যাবলস দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা আগের সময়ের তুলনায় প্রায় ৬ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বকেয়া।

কিন্তু রিপোর্টে কোম্পানি বলছে, ‘সব আদায়যোগ্য’, তাই কোনো প্রভিশন রাখা হয়নি। অথচ আন্তর্জাতিক মান IFRS 9 (Financial Instruments) অনুযায়ী, ছয় মাসের বেশি পুরনো বকেয়া টাকার জন্য  প্রভিশন (‘Expected Credit Loss’) রাখা বাধ্যতামূলক। এই প্রভিশন রাখলে মুনাফা কমে যায়, কিন্তু না রাখলে কাগজে মুনাফা বেড়ে যায়। তাই অনেক কোম্পানি এই নিয়ম ইচ্ছে করে মানে না। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা ভেবে নেন কোম্পানি প্রচুর টাকা পাবে, অথচ সেই টাকা অনেক সময় আদায়ই হয় না। পরে এই পাওনাগুলো রাইট-অফ করতে হয়, তখন শেয়ারদর পড়ে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, কোম্পানি মাত্র ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা ইনকাম ট্যাক্স খরচ দেখিয়েছে, অথচ তাদের নিট মুনাফা ছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশের কর্পোরেট ট্যাক্স হার ২২.৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এই হারে ট্যাক্স হিসাব করলে ব্যয় আরও বেশি হওয়ার কথা। অর্থ্যাৎ কোম্পানি ট্যাক্স কম দেখিয়ে মুনাফা বাড়িয়ে তুলেছে। এছাড়া কোম্পানি ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ‘Current Tax Provision’ দেখিয়েছে, আবার একই সঙ্গে ৬ কোটি টাকার বেশি ‘Deferred Tax Liability’-ও দেখিয়েছে।

IAS 12 (Income Taxes) অনুযায়ী, Deferred Tax এবং Current Tax একত্রে দেখিয়ে Reconciliation Table দিতে হয়, যাতে বোঝা যায় কতো টাকার ট্যাক্স এখন পরিশোধ হয়েছে, আর কতো ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি এই তথ্য দেয়নি। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানতেই পারছেন না কোম্পানিটি আসলে কতো টাকা ট্যাক্স দিয়েছে। অনেক সময় Deferred Tax Liability আলাদা করে রেখে কোম্পানি মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখায়, কারণ স্থগিত ট্যাক্স ভবিষ্যতের দায়, কিন্তু এখনকার মুনাফায় তা গণনা করা হয়। এতে শেয়ারপ্রতি আয়ের হিসাব (ইপিএস) ফুলে ওঠে, যা শেয়ারদর বাড়ানোর বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন: এবি ব্যাংক ইস্যুতে স্টক এক্সচেঞ্জ যেন ‘নীরব দর্শক’!

অন্যদিকে, প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোম্পানি একসঙ্গে নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। মোট নিট মুনাফা ১২ কোটি ৯২ লাখ টাকা হলেও, তারা ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদ লভ্যাংশ এবং সমপরিমাণ বোনাস শেয়ার দিয়েছে। অর্থ্যাৎ, কোম্পানিটি যা আয় করেছে তার চেয়ে বেশি বণ্টন করছে।

IAS 1 (Presentation of Financial Statements) এবং IAS 10 (Events after Reporting Period) অনুযায়ী, নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করার আগে কোম্পানির পর্যাপ্ত নগদ অর্থ থাকতে হয় এবং ডিভিডেন্ডের উৎস ও সময়সীমা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু এখানে সেই স্বচ্ছতা নেই। এর ফলে প্রশ্ন ওঠে, কোম্পানি কি আসলেই এই টাকা আয় করেছে, নাকি পুরনো রিজার্ভ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের সন্তুষ্ট রাখতে অর্থ দিচ্ছে?

এসব বিষয়ে জানতে বিজনেস জার্নালের পক্ষ থেকে কোম্পানি সচিব মহিউদ্দিন সরদারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। এ সময় তিনি প্রশ্নগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলেন। তবে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রশ্ন পাঠানো হলেও দীর্ঘদিনেও তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৬১ কোটি টাকার পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা!

এদিকে ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারদরের ওঠানামাও সন্দেহজনক। গত ৭ মে ২০২৫ তারিখে শেয়ারের দাম ছিল ৭৪.৪০ টাকা। দেড় মাসের মধ্যে, ২৪ জুনে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০৮.৫০ টাকা- যা প্রায় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর তা নেমে আসে ৯৭.৮০ টাকায়। এ সময়ে শেয়ার দর কিছুটা কমলেও ৭ মে- এর তুলনায় শেয়ার দর বেড়েছে ৩১ শতাংশের বেশি। তবে গতকাল ৭ অক্টোবর শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেনে হয় ৯৯.৯০ টাকায়। এতো কম সময়ে এত বড় দামের পরিবর্তনকে বাজার বিশেষজ্ঞরা অস্বাভাবিক বলছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অনেক কোম্পানি বাজারে ভালো ভাবমূর্তি তৈরি করতে এবং শেয়ারদর বাড়াতে মুনাফা ফুলিয়ে দেখায়। কিন্তু এর ফলে যখন প্রকৃত আর্থিক অবস্থার অবনতি প্রকাশ পায়, তখন বাজার ধসে পড়ে। তৌফিকা ফুডসের রিপোর্টও সেই আশঙ্কা জাগাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত হবে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে এই ফ্যাব্রিকেশন বন্ধ হয়।

আরও পড়ুন: লাভোলো’র মুনাফা উড়ছে কাগজে, নগদ ডুবছে বাস্তবে!

তাদের মতে, শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনকে নিরীক্ষা করার প্রক্রিয়া আরও শক্ত করতে হবে। অডিটররা অনেক সময় এই ধরনের ফ্যাব্রিকেটেড রিপোর্টে চোখ বন্ধ করে স্বাক্ষর করে দেন, যা বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর সমান। বিএসইসি ও আইসিএবি’র কঠোর নজরদারি চালানোর এখন সময় এসেছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হোসেন নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ডেফার্ড ট্যাক্স হলো এখনকার মুনাফা বাড়ানোর একটি বৈধ উপায়, কিন্তু এটি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়। IAS 12 অনুযায়ী কোম্পানিকে বলতে হয় কতো টাকা ট্যাক্স এখন দিয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য কতো রেখেছে। অনেক কোম্পানি এই অংশে অস্পষ্ট তথ্য দেয়, যাতে বিনিয়োগকারীরা বুঝতেই না পারেন প্রকৃত ট্যাক্স দায় কতো। এটা ‘earnings manipulation’-এর একটা ক্লাসিক কৌশল।’

আরও পড়ুন: বেষ্ট হোল্ডিংসের আর্থিক প্রতিবেদনে অস্পষ্টতা: বিভ্রান্তিতে বিনিয়োগকারীরা!

শেয়ারবাজারের অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘তৌফিকা ফুডসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে মাত্র ছয় মাসে ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস বেড়ে গেছে ১৪ কোটি টাকার বেশি। অথচ কার কাছে এই টাকা, কেন, এবং কখন ফেরত আসবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। IAS ২৪ অনুযায়ী এই তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এখানে গোপনীয়তা মানে হচ্ছে- হয়তো অর্থ কাগুজে, না হয় রিলেটেড পার্টির কাছে আটকে আছে। দুটোই বিনিয়োগকারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কোম্পানি পুরনো পাওনা আদায় না করেও ট্রেড রিসিভ্যাবলসকে আয় হিসেবে দেখায়, কিন্তু IFRS ৯ অনুযায়ী এর জন্য ‘Expected Credit Loss’ প্রভিশন রাখতে হয়। এই নিয়ম না মানলে মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়ে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন কোম্পানির বিক্রি বেড়েছে, কিন্তু বাস্তবে নগদ প্রবাহ কমে যায়। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিপজ্জনক সংকেত।’

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানি প্রণোদনা উধাও: ফুলে ফেঁপে উঠছে ‘রিসিভ্যাবলস’

গোলাম মোস্তফা, দীর্ঘদিনের বিনিয়োগকারী ও ছোট উদ্যোক্তা, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিবেদনে দেখাচ্ছে কোম্পানি বিশাল মুনাফা করেছে, কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। আমরা যারা শেয়ার কিনেছি, তারা এখন ভাবছি- এই মুনাফা আসলেই কি নগদ আয় থেকে এসেছে, না কাগজে তৈরি? অনেক কোম্পানি এখন হিসাবের খেলায় মুনাফা বাড়িয়ে দেখায়, পরে দেখা যায় কিছুই নেই।’

সর্বোচ্চ দরে তৌফিকা ফুডসের শেয়ার কিনেছেন বিনিয়োগকারী সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বিক্রি বেড়েছে, কিন্তু নগদ টাকার প্রবাহ কমেছে। এটা তো অস্বাভাবিক। ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস ৮৫ লাখ থেকে বেড়ে ১৫ কোটি টাকা হয়েছে- মানে এই টাকা আসলে কোথাও আটকে আছে। আমরা জানতে চাই, এই টাকা কার কাছে গেল আর কবে ফেরত আসবে? বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এই তথ্য গোপন রাখা মানে আমাদের ঠকানো ।’

আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিম: ৬৯ বছর অপেক্ষার ফাঁদে বিনিয়োগকারীরা!

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘আমি ২৫ বছর ব্যাংকে কাজ করেছি, তাই জানি হিসাবের কৌশল ককিভাবে কাজ করে। অনেক কোম্পানি এখন Deferred Tax Liability কম দেখিয়ে মুনাফা ফুলিয়ে তোলে। সাধারণ বিনিয়োগকারী ভাবে, কোম্পানির আয় বেড়েছে, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের ট্যাক্স স্থগিত করে বানানো একটা ‘কাল্পনিক’ মুনাফা। এটা শেয়ারবাজারের জন্য ভয়ংকর ট্রেন্ড ‘

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক কোম্পানি এখন মুনাফা দেখাতে Deferred Tax Liability আলাদা করে রেখে Current Tax কম দেখায়। এতে মুনাফা কাগজে বেড়ে যায়, কিন্তু বাস্তবে তা টেকসই নয়। এছাড়া মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর প্রধান নিয়ামক-ই হচ্ছে রিলেটেড পার্টি ট্রানজেকশন আর রিসিভ্যাবলস। যা বাজারে কৃত্তিম মুনাফা বাড়ানোর মাধ্যমে শেয়ার কারসাজির সূক্ষ্ম রূপ, যা আইনগতভাবে ধরা কঠিন হলেও এটি বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর একটি পন্থা।’

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ: কাগুজে মুনাফার আড়ালে নগদ প্রবাহের সংকট!

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি কারসাজির প্রমাণ পাওয়ার পর বিএসইসি তিনটি বিও অ্যাকাউন্টে বিক্রি স্থগিত করেছে। এগুলোর একটি হলো তৌফিকা ইঞ্জিনিয়ারিং- যা লাভেলোর সিস্টার কনসার্ন। বাকি দু’টি হলো সিবিসি ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইক্যুইটি ম্যানেজম্যান্ট এবং এর চেয়ারম্যান জুয়াং লিফেংয়ের অ্যাকাউন্ট। অর্থ্যাৎ কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট পক্ষও কারসাজিতে জড়িত ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। এখন থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত তারা লাভেলো ও তৌফিকা ফুডসের শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না, যদিও কেনা চালিয়ে যেতে পারবে।

বিএসইসির এই সিদ্ধান্ত বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। সেদিনই লাভেলোর শেয়ারদর ৩.১৫ শতাংশ কমে যায়। এতে প্রমাণ হয়, আগের দাম বৃদ্ধির পেছনে আয়ের উন্নতি নয়, বরং কৃত্রিম কারসাজি কাজ করেছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টেই যদি কারসাজির প্রমাণ মেলে, তবে এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ বার্তা। (চলবে…)

বিজনেস জার্নাল/ঢাকা/এইচকে

শেয়ার করুন

error: Content is protected ! Please Don't Try!

৬ মাসে ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস ১,৬৭১ শতাংশ বৃদ্ধি

লাভেলো আইসক্রিমের হিসাবের ফাঁদে শেয়ারবাজার! (পর্ব-৩)

আপডেট: ০৯:৫০:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহু কোম্পানি এখন এমন এক হিসাবের খেলায় মেতে উঠেছে, যেখানে প্রকৃত আয় বা নগদ প্রবাহ না বাড়লেও আর্থিক প্রতিবেদন দেখে মনে হয় কোম্পানিটি প্রচুর মুনাফা করছে। বিনিয়োগকারীরা এই কাগুজে মুনাফার ফাঁদে পড়ে বেশি দামে শেয়ার কিনে ফেলছেন, অথচ বাস্তবে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। এই প্রতারণার মূল অস্ত্র হচ্ছে ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস, ট্রেড রিসিভ্যাবলস এবং ইনকাম ট্যাক্স ও ডেফার্ড ট্যাক্স ক্যালকুলেশনের মতো জটিল হিসাবের অংশ, যা অনেক সময় সচেতন বিনিয়োগকারীর চোখেও ধরা পড়ে না। আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএস ও আইএফআরএস)-এর নিয়ম না মেনে এসব সংখ্যার খেলা দিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের আর্থিক প্রতিবেদনকে কৃত্রিমভাবে সাজিয়ে তোলে, যাতে মুনাফা অনেক বেশি দেখায় এবং বাজারে তাদের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।

তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসির অনিরীক্ষিত অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন (৩০ জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) এই ধরনের ফ্যাব্রিকেটেড হিসাবের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কোম্পানির মুনাফা প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেলেও, তার পেছনে বিক্রির যৌক্তিক কারণ বা নগদ প্রবাহ বৃদ্ধির প্রমাণ নেই। বরং প্রতিবেদনের নানা জায়গায় দেখা গেছে আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে হিসাব কৌশলে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা।

ঠিক এ কারণেই প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষন শুরু করে ‘বিজনেস জার্নাল’-এর অনুসন্ধানী দল। কোম্পানিটির ২০২৩-২৪ সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের প্রান্তিক প্রতিবেদনের চুল-চেড়া বিশ্লেষনে বেরিয়ে আসে কাগুজে মুনাফার প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি তারল্য সঙ্কট, অনিয়ন্ত্রিত পাওনা ও এর আদায়ে ধীরগতি, ডিভিডেন্ডের অযৌক্তিকতা ও আর্থিক অসঙ্গতিসহ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। এরই ধারাবাহিকতায় লাভেলো আইসক্রিম নিয়ে বিজনেস জার্নালের করা আট পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশিত হলো।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতিটি দেখা যায় কোম্পানির ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলসে। অর্থ্যাৎ কোম্পানিটি যেসব রিলেটেড পার্টি বা সহযোগী কোম্পানির কাছে টাকা পাওনা দাবি করছে, ৩০ জুন ২০২৪-এ তার পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু মাত্র ছয় মাসে (৩১ ডিসেম্বর ২০২৪) তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৮ লাখ ৫১ হাজার টাকায়। অর্থ্যাৎ, শতাংশ হিসেবে মাত্র ৬ মাসে যার পরিমাণ বেড়েছে ১,৬৭১ শতাংশ। টাকার অঙ্কে হঠাৎ করেই প্রায় ১৪ কোটি টাকার বেশি পাওনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি রিপোর্টের কোথাও বলেনি যে, এই টাকা কার কাছে, কেন, কিভাবে এবং কখন ফেরত আসবে।

আন্তর্জাতিক হিসাব মান IAS 24 (Related Party Disclosures) অনুযায়ী, এই তথ্যগুলো প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। কারণ, রিলেটেড পার্টির সঙ্গে কোনো লেনদেন মানেই সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত বা মুনাফা ফুলিয়ে দেখানোর ঝুঁকি। তবে এখানে এই নিয়ম মানা হয়নি।

বাস্তবে দেখা যায়, অনেক কোম্পানি তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কাছে কাগুজে বিক্রির বিল তৈরি করে রাজস্ব বাড়িয়ে দেখায়। এতে আয় বাড়ে, কিন্তু নগদ টাকা আসে না। ফলে কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থার চেয়ে প্রতিবেদন অনেক শক্তিশালী মনে হয়। বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে শেয়ার কেনেন, আর কোম্পানির ভেতরের মালিকরা তখন নিজেদের শেয়ার বিক্রি করার সুযোগ নেন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ট্রেড রিসিভ্যাবলস দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা আগের সময়ের তুলনায় প্রায় ৬ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বকেয়া।

কিন্তু রিপোর্টে কোম্পানি বলছে, ‘সব আদায়যোগ্য’, তাই কোনো প্রভিশন রাখা হয়নি। অথচ আন্তর্জাতিক মান IFRS 9 (Financial Instruments) অনুযায়ী, ছয় মাসের বেশি পুরনো বকেয়া টাকার জন্য  প্রভিশন (‘Expected Credit Loss’) রাখা বাধ্যতামূলক। এই প্রভিশন রাখলে মুনাফা কমে যায়, কিন্তু না রাখলে কাগজে মুনাফা বেড়ে যায়। তাই অনেক কোম্পানি এই নিয়ম ইচ্ছে করে মানে না। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা ভেবে নেন কোম্পানি প্রচুর টাকা পাবে, অথচ সেই টাকা অনেক সময় আদায়ই হয় না। পরে এই পাওনাগুলো রাইট-অফ করতে হয়, তখন শেয়ারদর পড়ে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, কোম্পানি মাত্র ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা ইনকাম ট্যাক্স খরচ দেখিয়েছে, অথচ তাদের নিট মুনাফা ছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশের কর্পোরেট ট্যাক্স হার ২২.৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এই হারে ট্যাক্স হিসাব করলে ব্যয় আরও বেশি হওয়ার কথা। অর্থ্যাৎ কোম্পানি ট্যাক্স কম দেখিয়ে মুনাফা বাড়িয়ে তুলেছে। এছাড়া কোম্পানি ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ‘Current Tax Provision’ দেখিয়েছে, আবার একই সঙ্গে ৬ কোটি টাকার বেশি ‘Deferred Tax Liability’-ও দেখিয়েছে।

IAS 12 (Income Taxes) অনুযায়ী, Deferred Tax এবং Current Tax একত্রে দেখিয়ে Reconciliation Table দিতে হয়, যাতে বোঝা যায় কতো টাকার ট্যাক্স এখন পরিশোধ হয়েছে, আর কতো ভবিষ্যতের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি এই তথ্য দেয়নি। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানতেই পারছেন না কোম্পানিটি আসলে কতো টাকা ট্যাক্স দিয়েছে। অনেক সময় Deferred Tax Liability আলাদা করে রেখে কোম্পানি মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখায়, কারণ স্থগিত ট্যাক্স ভবিষ্যতের দায়, কিন্তু এখনকার মুনাফায় তা গণনা করা হয়। এতে শেয়ারপ্রতি আয়ের হিসাব (ইপিএস) ফুলে ওঠে, যা শেয়ারদর বাড়ানোর বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন: এবি ব্যাংক ইস্যুতে স্টক এক্সচেঞ্জ যেন ‘নীরব দর্শক’!

অন্যদিকে, প্রতিবেদনে দেখা যায়, কোম্পানি একসঙ্গে নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। মোট নিট মুনাফা ১২ কোটি ৯২ লাখ টাকা হলেও, তারা ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদ লভ্যাংশ এবং সমপরিমাণ বোনাস শেয়ার দিয়েছে। অর্থ্যাৎ, কোম্পানিটি যা আয় করেছে তার চেয়ে বেশি বণ্টন করছে।

IAS 1 (Presentation of Financial Statements) এবং IAS 10 (Events after Reporting Period) অনুযায়ী, নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করার আগে কোম্পানির পর্যাপ্ত নগদ অর্থ থাকতে হয় এবং ডিভিডেন্ডের উৎস ও সময়সীমা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু এখানে সেই স্বচ্ছতা নেই। এর ফলে প্রশ্ন ওঠে, কোম্পানি কি আসলেই এই টাকা আয় করেছে, নাকি পুরনো রিজার্ভ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের সন্তুষ্ট রাখতে অর্থ দিচ্ছে?

এসব বিষয়ে জানতে বিজনেস জার্নালের পক্ষ থেকে কোম্পানি সচিব মহিউদ্দিন সরদারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। এ সময় তিনি প্রশ্নগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলেন। তবে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রশ্ন পাঠানো হলেও দীর্ঘদিনেও তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৬১ কোটি টাকার পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা!

এদিকে ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারদরের ওঠানামাও সন্দেহজনক। গত ৭ মে ২০২৫ তারিখে শেয়ারের দাম ছিল ৭৪.৪০ টাকা। দেড় মাসের মধ্যে, ২৪ জুনে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০৮.৫০ টাকা- যা প্রায় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর তা নেমে আসে ৯৭.৮০ টাকায়। এ সময়ে শেয়ার দর কিছুটা কমলেও ৭ মে- এর তুলনায় শেয়ার দর বেড়েছে ৩১ শতাংশের বেশি। তবে গতকাল ৭ অক্টোবর শেয়ারটির সর্বশেষ লেনদেনে হয় ৯৯.৯০ টাকায়। এতো কম সময়ে এত বড় দামের পরিবর্তনকে বাজার বিশেষজ্ঞরা অস্বাভাবিক বলছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অনেক কোম্পানি বাজারে ভালো ভাবমূর্তি তৈরি করতে এবং শেয়ারদর বাড়াতে মুনাফা ফুলিয়ে দেখায়। কিন্তু এর ফলে যখন প্রকৃত আর্থিক অবস্থার অবনতি প্রকাশ পায়, তখন বাজার ধসে পড়ে। তৌফিকা ফুডসের রিপোর্টও সেই আশঙ্কা জাগাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত হবে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে এই ফ্যাব্রিকেশন বন্ধ হয়।

আরও পড়ুন: লাভোলো’র মুনাফা উড়ছে কাগজে, নগদ ডুবছে বাস্তবে!

তাদের মতে, শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনকে নিরীক্ষা করার প্রক্রিয়া আরও শক্ত করতে হবে। অডিটররা অনেক সময় এই ধরনের ফ্যাব্রিকেটেড রিপোর্টে চোখ বন্ধ করে স্বাক্ষর করে দেন, যা বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর সমান। বিএসইসি ও আইসিএবি’র কঠোর নজরদারি চালানোর এখন সময় এসেছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হোসেন নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ডেফার্ড ট্যাক্স হলো এখনকার মুনাফা বাড়ানোর একটি বৈধ উপায়, কিন্তু এটি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে হয়। IAS 12 অনুযায়ী কোম্পানিকে বলতে হয় কতো টাকা ট্যাক্স এখন দিয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য কতো রেখেছে। অনেক কোম্পানি এই অংশে অস্পষ্ট তথ্য দেয়, যাতে বিনিয়োগকারীরা বুঝতেই না পারেন প্রকৃত ট্যাক্স দায় কতো। এটা ‘earnings manipulation’-এর একটা ক্লাসিক কৌশল।’

আরও পড়ুন: বেষ্ট হোল্ডিংসের আর্থিক প্রতিবেদনে অস্পষ্টতা: বিভ্রান্তিতে বিনিয়োগকারীরা!

শেয়ারবাজারের অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘তৌফিকা ফুডসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে মাত্র ছয় মাসে ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস বেড়ে গেছে ১৪ কোটি টাকার বেশি। অথচ কার কাছে এই টাকা, কেন, এবং কখন ফেরত আসবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। IAS ২৪ অনুযায়ী এই তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এখানে গোপনীয়তা মানে হচ্ছে- হয়তো অর্থ কাগুজে, না হয় রিলেটেড পার্টির কাছে আটকে আছে। দুটোই বিনিয়োগকারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কোম্পানি পুরনো পাওনা আদায় না করেও ট্রেড রিসিভ্যাবলসকে আয় হিসেবে দেখায়, কিন্তু IFRS ৯ অনুযায়ী এর জন্য ‘Expected Credit Loss’ প্রভিশন রাখতে হয়। এই নিয়ম না মানলে মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়ে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন কোম্পানির বিক্রি বেড়েছে, কিন্তু বাস্তবে নগদ প্রবাহ কমে যায়। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিপজ্জনক সংকেত।’

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের রপ্তানি প্রণোদনা উধাও: ফুলে ফেঁপে উঠছে ‘রিসিভ্যাবলস’

গোলাম মোস্তফা, দীর্ঘদিনের বিনিয়োগকারী ও ছোট উদ্যোক্তা, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিবেদনে দেখাচ্ছে কোম্পানি বিশাল মুনাফা করেছে, কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। আমরা যারা শেয়ার কিনেছি, তারা এখন ভাবছি- এই মুনাফা আসলেই কি নগদ আয় থেকে এসেছে, না কাগজে তৈরি? অনেক কোম্পানি এখন হিসাবের খেলায় মুনাফা বাড়িয়ে দেখায়, পরে দেখা যায় কিছুই নেই।’

সর্বোচ্চ দরে তৌফিকা ফুডসের শেয়ার কিনেছেন বিনিয়োগকারী সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বিক্রি বেড়েছে, কিন্তু নগদ টাকার প্রবাহ কমেছে। এটা তো অস্বাভাবিক। ইন্টার-কোম্পানি রিসিভ্যাবলস ৮৫ লাখ থেকে বেড়ে ১৫ কোটি টাকা হয়েছে- মানে এই টাকা আসলে কোথাও আটকে আছে। আমরা জানতে চাই, এই টাকা কার কাছে গেল আর কবে ফেরত আসবে? বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এই তথ্য গোপন রাখা মানে আমাদের ঠকানো ।’

আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিম: ৬৯ বছর অপেক্ষার ফাঁদে বিনিয়োগকারীরা!

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘আমি ২৫ বছর ব্যাংকে কাজ করেছি, তাই জানি হিসাবের কৌশল ককিভাবে কাজ করে। অনেক কোম্পানি এখন Deferred Tax Liability কম দেখিয়ে মুনাফা ফুলিয়ে তোলে। সাধারণ বিনিয়োগকারী ভাবে, কোম্পানির আয় বেড়েছে, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের ট্যাক্স স্থগিত করে বানানো একটা ‘কাল্পনিক’ মুনাফা। এটা শেয়ারবাজারের জন্য ভয়ংকর ট্রেন্ড ‘

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক কোম্পানি এখন মুনাফা দেখাতে Deferred Tax Liability আলাদা করে রেখে Current Tax কম দেখায়। এতে মুনাফা কাগজে বেড়ে যায়, কিন্তু বাস্তবে তা টেকসই নয়। এছাড়া মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর প্রধান নিয়ামক-ই হচ্ছে রিলেটেড পার্টি ট্রানজেকশন আর রিসিভ্যাবলস। যা বাজারে কৃত্তিম মুনাফা বাড়ানোর মাধ্যমে শেয়ার কারসাজির সূক্ষ্ম রূপ, যা আইনগতভাবে ধরা কঠিন হলেও এটি বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর একটি পন্থা।’

আরও পড়ুন: আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ: কাগুজে মুনাফার আড়ালে নগদ প্রবাহের সংকট!

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি কারসাজির প্রমাণ পাওয়ার পর বিএসইসি তিনটি বিও অ্যাকাউন্টে বিক্রি স্থগিত করেছে। এগুলোর একটি হলো তৌফিকা ইঞ্জিনিয়ারিং- যা লাভেলোর সিস্টার কনসার্ন। বাকি দু’টি হলো সিবিসি ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইক্যুইটি ম্যানেজম্যান্ট এবং এর চেয়ারম্যান জুয়াং লিফেংয়ের অ্যাকাউন্ট। অর্থ্যাৎ কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট পক্ষও কারসাজিতে জড়িত ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। এখন থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত তারা লাভেলো ও তৌফিকা ফুডসের শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না, যদিও কেনা চালিয়ে যেতে পারবে।

বিএসইসির এই সিদ্ধান্ত বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। সেদিনই লাভেলোর শেয়ারদর ৩.১৫ শতাংশ কমে যায়। এতে প্রমাণ হয়, আগের দাম বৃদ্ধির পেছনে আয়ের উন্নতি নয়, বরং কৃত্রিম কারসাজি কাজ করেছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানি-সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টেই যদি কারসাজির প্রমাণ মেলে, তবে এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ বার্তা। (চলবে…)

বিজনেস জার্নাল/ঢাকা/এইচকে