সঞ্চয়পত্রের সুদহার আরও কমাবে সরকার

- আপডেট: ০৩:২৬:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
- / ১০২০৩ বার দেখা হয়েছে
সরকার ধীরে ধীরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমাচ্ছে। চড়া সুদের চাপ কমিয়ে তুলনামূলক সস্তা সুদের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের দিকেই বেশি ঝুঁকতে চাইছে। এরই অংশ হিসেবে আগামী জানুয়ারি থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আরও কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে আগামী বছরের শুরুতে এ খাতের সর্বোচ্চ সুদহার নেমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে যেসব অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়, তার মধ্যে সঞ্চয়পত্র অন্যতম। কিন্তু সেখানে সুদের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যা সরকারের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তুলনামূলক কম সুদের ট্রেজারি বন্ড-বিলকে মূল উৎসে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ, ট্রেজারিতে ভরসা
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বর্তমানে মোট ১১টি সঞ্চয় স্কিম চালু রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র, দুটি ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক হিসাব, একটি ডাক জীবনবীমা, একটি প্রাইজবন্ড এবং প্রবাসীদের জন্য তিনটি বিশেষ বন্ড। প্রতিটি স্কিমে বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার হার ভিন্ন।
সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে সর্বোচ্চ সুদহার ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ আর সর্বনিম্ন সুদ ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
চলতি বছরের জুলাইয়ে একাধিক স্কিমে সুদের হার ৪৭ থেকে ৫৭ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমানো হয়। জানুয়ারিতে তা আরও এক থেকে দেড় শতাংশ কমানো হলে সাধারণ মানুষের জন্য সঞ্চয়পত্র হবে আগের চেয়ে অনেক কম লাভজনক।
অন্যদিকে, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার গড়ে ৯.৫ শতাংশের কাছাকাছি থাকায় সরকার সেখান থেকে সস্তায় ঋণ নিতে পারছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ১৩ অক্টোবরের নিলাম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদ ৯.৫০ শতাংশ, ২ বছর মেয়াদি বন্ডের গড় সুদ ৯.৪৪ শতাংশ এবং ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদ ৯.৯০ শতাংশ।
বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত, সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক
সুদের হার কমানোর ফলে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ধারাবাহিকভাবে কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছয় হাজার ৬৩ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালে এটি ছিল ঋণাত্মক ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ প্রবণতা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরও কমবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো একদিকে যেমন সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক হতে পারে, অন্যদিকে এটি সঞ্চয়নির্ভর সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যারা নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয়পত্রে নির্ভর করে থাকেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সুদহার কমলে সরকারের লাভ, জনগণের ক্ষতি
অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত, যা বাজেট ঘাটতি পূরণে ঋণের ব্যয় কমাবে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।
সবশেষ চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমায় সরকার। নতুন এ হার আগামী ছয় মাস অর্থাৎ চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
এ ছাড়া নতুন নিয়মে বিনিয়োগের পরিমাণের ভিত্তিতে মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে। যাদের বিনিয়োগ কম, তারা তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা পাবেন। আর যাদের বিনিয়োগ বেশি, তাদের ক্ষেত্রে সুদের হার অপেক্ষাকৃত কম হবে।
এখন ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকে ‘ছোট বিনিয়োগ’ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ, কোনো বিনিয়োগকারীর সঞ্চয়পত্রে মোট বিনিয়োগ যদি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার কম হয়, তবে তিনি তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা পাবেন। অন্যদিকে, যাদের বিনিয়োগ এই সীমার বেশি, তাদের জন্য মুনাফার হার কিছুটা কম রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে উৎসে কর ৫ শতাংশ, তার বেশি বিনিয়োগ গুনতে হবে ১০ শতাংশ উৎসে কর।
১৯৭৭ সালে প্রথম পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন করে সরকার। পরে আরও তিনটি– তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন করা হয়। চার ধরনের সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি সুদ পেনশনার সঞ্চয়পত্রে। এরপর পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ ছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র
পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার কম বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যাবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ হারে। আর বেশি বিনিয়োগকারীরা পাবেন ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ হারে মুনাফা।
পেনশনার সঞ্চয়পত্রে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান এতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
পরিবার সঞ্চয়পত্র
সঞ্চয়পত্রের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। পেনশনার সঞ্চয়পত্রের পর বেশি সুদ পরিবার সঞ্চয়পত্রে। এই সঞ্চয়পত্রে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার কম বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যাবে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ হারে। আর বেশি বিনিয়োগকারীরা পাবেন ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ হারে মুনাফা।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার কম বিনিয়োগ করলে মুনাফা মিলবে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর বেশি বিনিয়োগে এই হার হবে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফা হবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর বেশি বিনিয়োগে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এ ছাড়া ডাকঘর সঞ্চয়ে ব্যাংকের তিন বছর মেয়াদি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার নিচে বিনিয়োগ করলে মুনাফা পাওয়া যাবে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে আর বেশি বিনিয়োগে পাওয়া যাবে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
সরকার নির্ধারিত এই নতুন হার আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনায় তা আবার পরিবর্তন করা হতে পারে।
এদিকে, সঞ্চয়পত্র ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য তিন ধরনের বন্ড রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ১২ শতাংশ মুনাফা ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে। এটি পাঁচ বছর মেয়াদি। ৬ মাস অন্তর মুনাফা তোলার সুযোগ রয়েছে। ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড তিন বছর মেয়াদি। এর মুনাফার হার সাড়ে ৬ শতাংশ। প্রবাসীদের জন্য আরেকটি বন্ড রয়েছে, যার নাম ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড। তিন বছর মেয়াদি এই বন্ডে মুনাফার হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তিনটিরই বিনিয়োগের বিপরীতে পাওয়া মুনাফা করমুক্ত।
ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাকি দুই বন্ডে অবশ্য কোনো সীমা নেই। অর্থাৎ যত খুশি অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবেন প্রবাসীরা। এসব বন্ড দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের এডি শাখা, বিদেশে থাকা বাংলাদেশের ব্যাংকের শাখা, এক্সচেঞ্জ হাউস ও এক্সচেঞ্জ কোম্পানি থেকে কেনা যায়।
ঢাকা/এসএইচ