শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন ও বাস্তবতায় বিস্তর ফারাক!

- আপডেট: ১০:০২:১৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫
- / ১০৫৪৪ বার দেখা হয়েছে
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ছিল এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছিল। ২০০৯-২০১০ সালের উত্থানের সময়কাল যেন মধ্যবিত্তের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। ক্ষুদ্র সঞ্চয় নিয়ে লাখো মানুষ ছুটে এসেছিল শেয়ারবাজারে। তাদের চোখে ছিল নিজের ঘর করার, সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার কিংবা সামাজিক মর্যাদা অর্জনের রঙিন স্বপ্ন।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
কিন্তু ২০১০ সালের ধস সেই সব স্বপ্ন মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। পুঁজিবাজার তখন পরিণত হয় এক নির্দয় প্রতারণার মঞ্চে। আজ ১৪ বছর পেরিয়ে এসেও সেই আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, বরং বর্তমান বাজার পরিস্থিতি আরও গভীর সংকটে পড়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পরিচালিত হচ্ছে নতুন নেতৃত্বের অধীনে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. রাশেদুল মাকসুদ, যিনি শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাজারের নাজুক অবস্থার পেছনে আগের কমিশনের যেমন অস্বচ্ছতা ছিল, বর্তমান কমিশনেরও দায় কোনো অংশে কম নয়। বরং বাজার ব্যবস্থাপনায় এখন যে অনিশ্চয়তা, দিশাহীনতা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তার বড় অংশই বর্তমান কমিশনের অদূরদর্শিতা ও কার্যকর নেতৃত্বের অভাবের ফল।
শেয়ারবাজারের দৈনিক লেনদেন কমে এসেছে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে, বহু কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের কাছাকাছি বা তার নিচে নেমে গেছে, বাজারে নতুন পুঁজি আসার প্রবণতা একেবারে স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তীব্র তারল্য সংকট, বিনিয়োগকারীদের হতাশা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আউটফ্লো মিলিয়ে বাজার আজ এক অদ্ভুত স্থবিরতার আবরণে ঢাকা।
পুঁজিবাজারের এ সংকটের গভীরে রয়েছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা, বিশেষ করে ২০২০-২০২৪ মেয়াদে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়কালে বাজার ব্যবস্থাপনায় স্ববিরোধিতা, পক্ষপাত এবং স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। বাজার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আইপিও অনুমোদনের হিড়িক ছিল বেশি।
ফলস্বরূপ, দুর্বল আর্থিক ভিত্তির কোম্পানি, প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগের জন্য অনুপযুক্ত কোম্পানিগুলোও বিনা বাধায় শেয়ারবাজারে প্রবেশ করে। এইসব কোম্পানি বাজার থেকে বিপুল অর্থ তুলে নিয়ে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে এবং বাজারে স্থিতিশীলতার বদলে গভীর আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে।
বর্তমানে রাশেদুল মাকসুদ নেতৃত্বাধীন কমিশন বাজার স্থিতিশীল করতে পারেনি। বরং নীতিনির্ধারণে দ্ব্যার্থতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং বাস্তব বাজার পরিস্থিতি না বোঝার প্রবণতা বাজারকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। আবার কখনো বাজারের মন্দা অবস্থা মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে পরিস্থিতিকে সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রেগুলেটরি ইনফোর্সমেন্ট দুর্বল থাকার ফলে কারসাজি চক্র, ইনসাইডার ট্রেডিং ও ম্যানিপুলেশন দমনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট এবং বিনিয়োগকারীদের অব্যাহত ক্ষতির একটি বড় কারণ হলো ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর এক ভয়াবহ খেলাপি সংস্কৃতির শিকারে পরিণত হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, পরিণতিতে তারা শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগে অমনোযোগী। অতীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারের বড় অংশীদার ছিল, কিন্তু বর্তমানে তারা তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে আনছে বা শুধুমাত্র ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বিক্রয় চাপে যুক্ত হচ্ছে। ফলে বাজারে অতিরিক্ত বিক্রয়ের চাপ তৈরি হয়েছে।
পুঁজিবাজারের সংকটে লভ্যাংশ নীতির অস্পষ্টতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশে কোনো বাধ্যতামূলক লভ্যাংশ নীতি না থাকায় বহু কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত করছে। আবার কিছু কোম্পানি আইনি ফাঁকফোকর দিয়ে সামান্য নগদ লভ্যাংশ দেখিয়ে বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে।
অথচ বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানির প্রকৃত আয় ও নগদ প্রবাহের অংশীদার হওয়ার আশায় বাজারে বিনিয়োগ করে। যখন এই প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাজারে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা তৈরি হয় না।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাজারের আরেকটি গোপন শত্রু। বিগত বছরগুলোতে বহুবার কারসাজির অভিযোগ উঠলেও নামমাত্র জরিমানা (অবশ্য নতুন কমিশন কর্তৃক জরিমানা বিশাল অঙ্কের) ছাড়া বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি। বড় বড় ম্যানিপুলেটর বা অবৈধ লেনদেনকারী চক্র বারবার রক্ষা পেয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা তছনছ হয়ে গেছে, যখন তারা দেখেছে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
বাজারে একটি প্রচলিত বাক্য হয়ে গেছে — “এখানে অপরাধ করলে পুরস্কার পাওয়া যায়, শাস্তি নয়।” এই মনস্তত্ত্ব বাজারে বিনিয়োগের স্বাভাবিক পরিবেশকেই ভেঙে দিয়েছে।
অপরদিকে, বাজারের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ও গুজব এখনো দমন করা যায়নি। কিছু তথাকথিত ‘বিশ্লেষক’, ইউটিউবার, ফেসবুক পেইজ বা গ্রুপ নির্দিষ্ট কোম্পানি বা বাজারের বিষয়ে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে। বাজারের দুর্বল মনিটরিং সিস্টেমের কারণে এসব প্রচারণা দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং বাজারের স্বাভাবিক প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আরও পড়ুন: রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবিতে প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি
বর্তমান পুঁজিবাজারের প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোও সন্তোষজনক নয়। আধুনিক ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম, রিয়েল টাইম মনিটরিং এবং সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে ডিএসই ও সিএসই এখনো আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক পিছিয়ে। লেনদেনের সময় সার্ভার ডাউন হওয়া, ডেটা আপডেট বিলম্ব হওয়া কিংবা অর্ডার প্লেসিংয়ে সমস্যা বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে এই অবস্থা বাংলাদেশি বাজারকে অনির্ভরযোগ্য করে তুলেছে।
আকর্ষণীয় নতুন কোম্পানির অভাবও বাজারের প্রাণশক্তি নিঃশেষ করছে। বড়, লাভজনক, বহুজাতিক বা নবীন প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকছে।
অন্যদিকে, দুর্বল কোম্পানিগুলো রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় বাজারে প্রবেশ করছে। বাজারে যখন গুণগত কোম্পানির সংখ্যা কমে যায়, তখন বিনিয়োগের বিকল্পও কমে আসে এবং বাজার স্থবির হয়ে পড়ে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখন এক ভয়াবহ সংকটে। অতীতের ব্যর্থতা, বিশেষ করে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সময়ে গড়ে ওঠা ভুল নীতিমালা ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতার ফল আজও আমরা ভুগছি। তার ওপর যোগ হয়েছে বর্তমান চেয়ারম্যান মো. রাশেদুল মাকসুদের সময়কার অদক্ষ ও অদূরদর্শি ব্যবস্থাপনা।
সবশেষে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বারবার বাজারে ধাক্কা দিয়েছে। নির্বাচনী বছর বা বিশেষ রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় পড়ে যান, বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, লেনদেন কমে আসে। আবার অনেক সময় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক প্রভাবে হয়ে থাকে, যা বাজারের প্রাকৃতিক প্রবণতা ব্যাহত করে।
তবে হতাশার মধ্যেও আলোর রেখা দেখা যায়। সঠিক ও সুসংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশ আবারও একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে পারে। তার জন্য প্রথম কাজ হবে বিএসইসিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে পেশাদার, দক্ষ ও স্বচ্ছ একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় রূপান্তর করা। বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মনিটরিং ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং যেকোনো ধরণের কারসাজির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বাজারকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য অত্যাধুনিক ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম চালু করা এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি।
সাথে বিনিয়োগ শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ পর্যায়ে বিনিয়োগ শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে হবে, যারা সচেতন এবং দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারী হবে। সেই সঙ্গে গুণগতমানসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে বাজারমুখী করার জন্য করছাড় ও প্রণোদনা দিতে হবে। নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক লভ্যাংশ নীতিমালা প্রণয়ন করে বিনিয়োগকারীদের আয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো — বাজারকে পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ বাজার ব্যবস্থা ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বাঁচাতে সময় এখন সীমিত। এখনই যদি সচেতন পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে এই বাজার ধস শুধু কয়েক লাখ বিনিয়োগকারীর ক্ষতি নয় — দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ ও গতিশীল বাজার নির্মাণ করাই এখন আমাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব।
পরিশেষে আবারও বলছি, আস্থা, স্বচ্ছতা এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়া এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়। এখনই সময় প্রয়োজন স্বাধীন, পেশাদার ও জবাবদিহিতামূলক একটি কমিশন গঠন করা; বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ট্রেডিং সিস্টেম চালু করা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য বাধ্যতামূলক সুরক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি বিনিয়োগ শিক্ষা বাড়ানো, গুণগত কোম্পানির তালিকাভুক্তি উৎসাহিত করা এবং রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত একটি বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলাই একমাত্র মুক্তির পথ।
✍লেখক: হাসান কবির জনি
সম্পাদক, বিজনেস জার্নাল
ইমেইল: hasankabirjony@gmail.com