১২:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট বন্ধে হাইকোর্টে নয় দফা সুপারিশ

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৮:৩৫:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৩
  • / ৪২১৬ বার দেখা হয়েছে

ফাইল ফটো

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট বন্ধ ও ভবিষ্যতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি কর্তৃক ৯ দফা সুপারিশ সম্পর্কে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

আজ শনিবার (৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে (কোম্পানি বেঞ্চে) দাখিল করা হয়েছে। আদালত প্রতিবেদনটি শুনানি ও পরবর্তী আদেশের জন্য নথিভুক্ত করে রেখেছেন।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

১. বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তাদেরও ভবিষ্যতে এরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব নিয়োগ লাভের অযোগ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে ও পাবলিক মানির ঝুঁকিবৃদ্ধি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ও একই ইনস্ট্রুমেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।

৩. আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লিখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (ক) নেওয়া আমানতের প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার (খ) কার কাছ থেকে কত ঋণ গৃহীতব্য হবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, (গ) প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময় সীমা, (ঘ) প্রদত্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ও হিসাবায়ন পদ্ধতি (ঙ) ঋণ দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (চ) বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিতব্য রিজার্ভ; এবং (ছ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইক্যুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতি বিধানকল্পে অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু তদারকির জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, বিএসইসির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন।

৫. বর্তমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এ কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণের বিধান নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো পরিচালক নিয়োগ করে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন/অনাপত্তি গ্রহণের শর্তারোপকরণ করা প্রয়োজন।

৬. বহির্নিরীক্ষক ফার্মের জরিমানা/দণ্ড হওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট ফার্মকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার যোগ্য ফার্মের তালিকা হতে বাদ দিতে হবে।

৭. বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, নথির নোটাংশে এবং পত্রাংশে পৃষ্ঠা নম্বর দেওয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে নোটাংশে অনুচ্ছেদ নম্বরও দেওয়া হয় না। ফলে নথির মধ্যে কোনও পৃষ্ঠা নিরুদ্দেশ (মিসিং) হয়েছে কি না তা বুঝার সুযোগ থাকে না। নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র স্বাক্ষর থাকে, তার নাম থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা কষ্টকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আধুনিকায়ন করতে নথির নোটাংশ, পত্রাংশ ও অনুচ্ছেদে নাম্বারিং করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে নথির নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার স্বাক্ষরের সঙ্গে তার নামের সিল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৮. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কার্যকর তদারকি রাখার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মধ্যে কার্যকর আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ ও তার তথ্য দ্রুত সিআইবিতে সংরক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার জন্য পরিদর্শন দলে সিআইবি সদস্য অন্তর্ভুক্ত রাখা প্রয়োজন।

 

৯. প্রতিবছর ভিজিলেন্স, অফসাইট সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে প্রাপ্ত/উদ্ঘাটিত তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রতিবছর কমপক্ষে একটিতে বিশেষ পরিদর্শন করতে হবে এবং উদ্ঘাটিত অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ৫০ হাজার সাধারণ শেয়ারে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে বিআইএফসি গঠন করা হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে (অনুচ্ছেদ-৪.২.১)। বর্তমান বিআইএফসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ৮২৭.২৯ কোটি টাকার বিপরীতে মোট দায় ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

বিআইএফসির মোট ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হওয়ায় বিআইএফসির এসব পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মেজর (অব.) মান্নান এককভাবে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা নিয়েছে। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে এসব টাকার দায় স্বীকার করেছেন।

সৃষ্ট অবস্থার জন্য বিআইএফসির পরিচালক পরিষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের দায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর (অব.) মান্নানের একক উদ্যোগেই বিআইএফসি গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে মেজর মান্নানের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছিল। শ্যান জিং হুং কন্টিনেন্ট ক্রেডিট লিমিটেড হংকংয়ের মনোনীত পরিচালক হিসেবে থাকলেও ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনও সভায় অংশগ্রহণ করেননি। মেরিল অ্যান্ড ফোর্বস নামে বিআইএফসির আরও একটি বিদেশি বড় অংকের শেয়ারের মালিক হলেও তাদের পক্ষে কেউ পর্ষদে ছিলেন না। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প পরিচালক হিসেবে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এবং তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান ছিলেন। অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে তানজিলা মান্নান, তাজরিনা মান্নান দুজনই মেজর মান্নানের মেয়ে। অর্থাৎ, বিআইএফসি গঠনের পর থেকে পরিচালনা পর্ষদে যারা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা সবাই মেজর মান্নানের আত্মীয় এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। অনেক পরিচালকের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত ছিল না। এ ছাড়াও নানা অনিয়ম করে পরিচালক পর্ষদ মেজর (অব.) মান্নানের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একাই ৫১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। বর্তমানে মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি হওয়ায় বিআইএফসির পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার ‘টিজমার্ট ইনকরপোরেটেড’ রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে পর্ষদ বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে আমানতকারীরা কোম্পানি আইনে মামলা দায়ের করেন। একই মামলায় বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান অপর একটি আবেদনে বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে তার এবং তার পরিবারের ও মালিকানাধীন কোম্পানির প্রকৃত দায়-দেনা নির্ধারণের জন্য বিআইএফসিতে অডিটর নিয়োগ করার নির্দেশনা প্রার্থনা করেন।

পরে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজের মতামতের ভিত্তিতে উচ্চ পর্যায়ের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে ৭ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সাবেক সচিব নুর উর রহমান, সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. কবির আহাম্মদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন, উপ-মহাব্যবস্থাপককে উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়।

 

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট বন্ধে ৯ দফা সুপারিশ:

১. বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তাদেরও ভবিষ্যতে এরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব নিয়োগ লাভের অযোগ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে ও পাবলিক মানির ঝুঁকিবৃদ্ধি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ও একই ইনস্ট্রুমেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।

৩. আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লিখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (ক) নেওয়া আমানতের প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার (খ) কার কাছ থেকে কত ঋণ গৃহীতব্য হবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, (গ) প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময় সীমা, (ঘ) প্রদত্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ও হিসাবায়ন পদ্ধতি (ঙ) ঋণ দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (চ) বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিতব্য রিজার্ভ; এবং (ছ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইক্যুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতি বিধানকল্পে অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু তদারকির জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, বিএসইসির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন।

৫. বর্তমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এ কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণের বিধান নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো পরিচালক নিয়োগ করে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন/অনাপত্তি গ্রহণের শর্তারোপকরণ করা প্রয়োজন।

৬. বহির্নিরীক্ষক ফার্মের জরিমানা/দণ্ড হওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট ফার্মকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার যোগ্য ফার্মের তালিকা হতে বাদ দিতে হবে।

৭. বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, নথির নোটাংশে এবং পত্রাংশে পৃষ্ঠা নম্বর দেওয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে নোটাংশে অনুচ্ছেদ নম্বরও দেওয়া হয় না। ফলে নথির মধ্যে কোনও পৃষ্ঠা নিরুদ্দেশ (মিসিং) হয়েছে কি না তা বুঝার সুযোগ থাকে না। নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র স্বাক্ষর থাকে, তার নাম থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা কষ্টকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আধুনিকায়ন করতে নথির নোটাংশ, পত্রাংশ ও অনুচ্ছেদে নাম্বারিং করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে নথির নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার স্বাক্ষরের সঙ্গে তার নামের সিল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৮. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কার্যকর তদারকি রাখার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মধ্যে কার্যকর আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ ও তার তথ্য দ্রুত সিআইবিতে সংরক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার জন্য পরিদর্শন দলে সিআইবি সদস্য অন্তর্ভুক্ত রাখা প্রয়োজন।

৯. প্রতিবছর ভিজিলেন্স, অফসাইট সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে প্রাপ্ত/উদ্ঘাটিত তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রতিবছর কমপক্ষে একটিতে বিশেষ পরিদর্শন করতে হবে এবং উদ্ঘাটিত অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ৫০ হাজার সাধারণ শেয়ারে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে বিআইএফসি গঠন করা হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে (অনুচ্ছেদ-৪.২.১)। বর্তমান বিআইএফসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ৮২৭.২৯ কোটি টাকার বিপরীতে মোট দায় ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

বিআইএফসির মোট ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হওয়ায় বিআইএফসির এসব পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মেজর (অব.) মান্নান এককভাবে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা নিয়েছে। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে এসব টাকার দায় স্বীকার করেছেন।

সৃষ্ট অবস্থার জন্য বিআইএফসির পরিচালক পরিষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের দায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর (অব.) মান্নানের একক উদ্যোগেই বিআইএফসি গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে মেজর মান্নানের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছিল। শ্যান জিং হুং কন্টিনেন্ট ক্রেডিট লিমিটেড হংকংয়ের মনোনীত পরিচালক হিসেবে থাকলেও ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনও সভায় অংশগ্রহণ করেননি। মেরিল অ্যান্ড ফোর্বস নামে বিআইএফসির আরও একটি বিদেশি বড় অংকের শেয়ারের মালিক হলেও তাদের পক্ষে কেউ পর্ষদে ছিলেন না। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প পরিচালক হিসেবে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এবং তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান ছিলেন। অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে তানজিলা মান্নান, তাজরিনা মান্নান দুজনই মেজর মান্নানের মেয়ে। অর্থাৎ, বিআইএফসি গঠনের পর থেকে পরিচালনা পর্ষদে যারা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা সবাই মেজর মান্নানের আত্মীয় এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। অনেক পরিচালকের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত ছিল না। এ ছাড়াও নানা অনিয়ম করে পরিচালক পর্ষদ মেজর (অব.) মান্নানের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

আরও পড়ুন: বিসিআইসির ৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎতের ব্যাখ্যা চেয়েছে হাইকোর্ট

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একাই ৫১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। বর্তমানে মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি হওয়ায় বিআইএফসির পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার ‘টিজমার্ট ইনকরপোরেটেড’ রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে পর্ষদ বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে আমানতকারীরা কোম্পানি আইনে মামলা দায়ের করেন। একই মামলায় বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান অপর একটি আবেদনে বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে তার এবং তার পরিবারের ও মালিকানাধীন কোম্পানির প্রকৃত দায়-দেনা নির্ধারণের জন্য বিআইএফসিতে অডিটর নিয়োগ করার নির্দেশনা প্রার্থনা করেন।

পরে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজের মতামতের ভিত্তিতে উচ্চ পর্যায়ের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে ৭ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সাবেক সচিব নুর উর রহমান, সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. কবির আহাম্মদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন, উপ-মহাব্যবস্থাপককে উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়।

ঢাকা/টিএ

শেয়ার করুন

x

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট বন্ধে হাইকোর্টে নয় দফা সুপারিশ

আপডেট: ০৮:৩৫:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৩

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট বন্ধ ও ভবিষ্যতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি কর্তৃক ৯ দফা সুপারিশ সম্পর্কে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

আজ শনিবার (৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে (কোম্পানি বেঞ্চে) দাখিল করা হয়েছে। আদালত প্রতিবেদনটি শুনানি ও পরবর্তী আদেশের জন্য নথিভুক্ত করে রেখেছেন।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

১. বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তাদেরও ভবিষ্যতে এরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব নিয়োগ লাভের অযোগ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে ও পাবলিক মানির ঝুঁকিবৃদ্ধি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ও একই ইনস্ট্রুমেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।

৩. আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লিখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (ক) নেওয়া আমানতের প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার (খ) কার কাছ থেকে কত ঋণ গৃহীতব্য হবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, (গ) প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময় সীমা, (ঘ) প্রদত্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ও হিসাবায়ন পদ্ধতি (ঙ) ঋণ দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (চ) বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিতব্য রিজার্ভ; এবং (ছ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইক্যুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতি বিধানকল্পে অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু তদারকির জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, বিএসইসির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন।

৫. বর্তমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এ কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণের বিধান নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো পরিচালক নিয়োগ করে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন/অনাপত্তি গ্রহণের শর্তারোপকরণ করা প্রয়োজন।

৬. বহির্নিরীক্ষক ফার্মের জরিমানা/দণ্ড হওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট ফার্মকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার যোগ্য ফার্মের তালিকা হতে বাদ দিতে হবে।

৭. বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, নথির নোটাংশে এবং পত্রাংশে পৃষ্ঠা নম্বর দেওয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে নোটাংশে অনুচ্ছেদ নম্বরও দেওয়া হয় না। ফলে নথির মধ্যে কোনও পৃষ্ঠা নিরুদ্দেশ (মিসিং) হয়েছে কি না তা বুঝার সুযোগ থাকে না। নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র স্বাক্ষর থাকে, তার নাম থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা কষ্টকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আধুনিকায়ন করতে নথির নোটাংশ, পত্রাংশ ও অনুচ্ছেদে নাম্বারিং করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে নথির নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার স্বাক্ষরের সঙ্গে তার নামের সিল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৮. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কার্যকর তদারকি রাখার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মধ্যে কার্যকর আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ ও তার তথ্য দ্রুত সিআইবিতে সংরক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার জন্য পরিদর্শন দলে সিআইবি সদস্য অন্তর্ভুক্ত রাখা প্রয়োজন।

 

৯. প্রতিবছর ভিজিলেন্স, অফসাইট সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে প্রাপ্ত/উদ্ঘাটিত তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রতিবছর কমপক্ষে একটিতে বিশেষ পরিদর্শন করতে হবে এবং উদ্ঘাটিত অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ৫০ হাজার সাধারণ শেয়ারে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে বিআইএফসি গঠন করা হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে (অনুচ্ছেদ-৪.২.১)। বর্তমান বিআইএফসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ৮২৭.২৯ কোটি টাকার বিপরীতে মোট দায় ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

বিআইএফসির মোট ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হওয়ায় বিআইএফসির এসব পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মেজর (অব.) মান্নান এককভাবে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা নিয়েছে। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে এসব টাকার দায় স্বীকার করেছেন।

সৃষ্ট অবস্থার জন্য বিআইএফসির পরিচালক পরিষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের দায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর (অব.) মান্নানের একক উদ্যোগেই বিআইএফসি গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে মেজর মান্নানের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছিল। শ্যান জিং হুং কন্টিনেন্ট ক্রেডিট লিমিটেড হংকংয়ের মনোনীত পরিচালক হিসেবে থাকলেও ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনও সভায় অংশগ্রহণ করেননি। মেরিল অ্যান্ড ফোর্বস নামে বিআইএফসির আরও একটি বিদেশি বড় অংকের শেয়ারের মালিক হলেও তাদের পক্ষে কেউ পর্ষদে ছিলেন না। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প পরিচালক হিসেবে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এবং তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান ছিলেন। অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে তানজিলা মান্নান, তাজরিনা মান্নান দুজনই মেজর মান্নানের মেয়ে। অর্থাৎ, বিআইএফসি গঠনের পর থেকে পরিচালনা পর্ষদে যারা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা সবাই মেজর মান্নানের আত্মীয় এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। অনেক পরিচালকের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত ছিল না। এ ছাড়াও নানা অনিয়ম করে পরিচালক পর্ষদ মেজর (অব.) মান্নানের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একাই ৫১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। বর্তমানে মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি হওয়ায় বিআইএফসির পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার ‘টিজমার্ট ইনকরপোরেটেড’ রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে পর্ষদ বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে আমানতকারীরা কোম্পানি আইনে মামলা দায়ের করেন। একই মামলায় বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান অপর একটি আবেদনে বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে তার এবং তার পরিবারের ও মালিকানাধীন কোম্পানির প্রকৃত দায়-দেনা নির্ধারণের জন্য বিআইএফসিতে অডিটর নিয়োগ করার নির্দেশনা প্রার্থনা করেন।

পরে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজের মতামতের ভিত্তিতে উচ্চ পর্যায়ের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে ৭ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সাবেক সচিব নুর উর রহমান, সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. কবির আহাম্মদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন, উপ-মহাব্যবস্থাপককে উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়।

 

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট বন্ধে ৯ দফা সুপারিশ:

১. বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ড সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তাদেরও ভবিষ্যতে এরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব নিয়োগ লাভের অযোগ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে ও পাবলিক মানির ঝুঁকিবৃদ্ধি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ও একই ইনস্ট্রুমেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।

৩. আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লিখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (ক) নেওয়া আমানতের প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার (খ) কার কাছ থেকে কত ঋণ গৃহীতব্য হবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, (গ) প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময় সীমা, (ঘ) প্রদত্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ও হিসাবায়ন পদ্ধতি (ঙ) ঋণ দেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (চ) বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিতব্য রিজার্ভ; এবং (ছ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইক্যুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতি বিধানকল্পে অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু তদারকির জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, বিএসইসির মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন।

৫. বর্তমান আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এ কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণের বিধান নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো পরিচালক নিয়োগ করে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরও নিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পর্ষদে পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন/অনাপত্তি গ্রহণের শর্তারোপকরণ করা প্রয়োজন।

৬. বহির্নিরীক্ষক ফার্মের জরিমানা/দণ্ড হওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট ফার্মকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার যোগ্য ফার্মের তালিকা হতে বাদ দিতে হবে।

৭. বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, নথির নোটাংশে এবং পত্রাংশে পৃষ্ঠা নম্বর দেওয়া হয় না, অনেক ক্ষেত্রে নোটাংশে অনুচ্ছেদ নম্বরও দেওয়া হয় না। ফলে নথির মধ্যে কোনও পৃষ্ঠা নিরুদ্দেশ (মিসিং) হয়েছে কি না তা বুঝার সুযোগ থাকে না। নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র স্বাক্ষর থাকে, তার নাম থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা কষ্টকর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ আধুনিকায়ন করতে নথির নোটাংশ, পত্রাংশ ও অনুচ্ছেদে নাম্বারিং করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে নথির নোট উপস্থাপনকারী হতে অনুমোদনকারী পর্যন্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার স্বাক্ষরের সঙ্গে তার নামের সিল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৮. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কার্যকর তদারকি রাখার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মধ্যে কার্যকর আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ ও তার তথ্য দ্রুত সিআইবিতে সংরক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার জন্য পরিদর্শন দলে সিআইবি সদস্য অন্তর্ভুক্ত রাখা প্রয়োজন।

৯. প্রতিবছর ভিজিলেন্স, অফসাইট সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে প্রাপ্ত/উদ্ঘাটিত তথ্য বিশ্লেষণে ঝুঁকি বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবশিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে প্রতিবছর কমপক্ষে একটিতে বিশেষ পরিদর্শন করতে হবে এবং উদ্ঘাটিত অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ৫০ হাজার সাধারণ শেয়ারে ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে বিআইএফসি গঠন করা হয়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে (অনুচ্ছেদ-৪.২.১)। বর্তমান বিআইএফসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ৮২৭.২৯ কোটি টাকার বিপরীতে মোট দায় ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

বিআইএফসির মোট ১৮৩৫.৯৬ কোটি টাকা দায় সৃষ্টি হয়েছে। মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি সৃষ্টি হওয়ায় বিআইএফসির এসব পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মেজর (অব.) মান্নান এককভাবে তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ঋণ হিসাবের বিপরীতে ৫১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা নিয়েছে। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে এসব টাকার দায় স্বীকার করেছেন।

সৃষ্ট অবস্থার জন্য বিআইএফসির পরিচালক পরিষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের দায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর (অব.) মান্নানের একক উদ্যোগেই বিআইএফসি গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে মেজর মান্নানের একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছিল। শ্যান জিং হুং কন্টিনেন্ট ক্রেডিট লিমিটেড হংকংয়ের মনোনীত পরিচালক হিসেবে থাকলেও ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোনও সভায় অংশগ্রহণ করেননি। মেরিল অ্যান্ড ফোর্বস নামে বিআইএফসির আরও একটি বিদেশি বড় অংকের শেয়ারের মালিক হলেও তাদের পক্ষে কেউ পর্ষদে ছিলেন না। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প পরিচালক হিসেবে মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এবং তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান ছিলেন। অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে তানজিলা মান্নান, তাজরিনা মান্নান দুজনই মেজর মান্নানের মেয়ে। অর্থাৎ, বিআইএফসি গঠনের পর থেকে পরিচালনা পর্ষদে যারা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা সবাই মেজর মান্নানের আত্মীয় এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। অনেক পরিচালকের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত ছিল না। এ ছাড়াও নানা অনিয়ম করে পরিচালক পর্ষদ মেজর (অব.) মান্নানের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

আরও পড়ুন: বিসিআইসির ৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎতের ব্যাখ্যা চেয়েছে হাইকোর্ট

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একাই ৫১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। বর্তমানে মোট সম্পদের চেয়ে দায় বেশি হওয়ায় বিআইএফসির পাওনাদার/আমানতকারীদের পাওনা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার ‘টিজমার্ট ইনকরপোরেটেড’ রুহুল আমিনের নেতৃত্বাধীন বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে পর্ষদ বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে আমানতকারীরা কোম্পানি আইনে মামলা দায়ের করেন। একই মামলায় বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান অপর একটি আবেদনে বিআইএফসির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম/আইনপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও বিআইএফসির ফান্ড আত্মসাতের অভিযোগ করে তার এবং তার পরিবারের ও মালিকানাধীন কোম্পানির প্রকৃত দায়-দেনা নির্ধারণের জন্য বিআইএফসিতে অডিটর নিয়োগ করার নির্দেশনা প্রার্থনা করেন।

পরে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার খান মোহাম্মদ শামীম আজিজের মতামতের ভিত্তিতে উচ্চ পর্যায়ের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে ৭ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সাবেক সচিব নুর উর রহমান, সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. কবির আহাম্মদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন, উপ-মহাব্যবস্থাপককে উচ্চ পর্যায়ের এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়।

ঢাকা/টিএ