০৮:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪

জিন্দাবাহারের গলিতে এক পথিকৃৎ প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমদ

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১২:৫৮:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০২২
  • / ৪২৮১ বার দেখা হয়েছে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বের সুবাদে প্রতিদিনই সেখানে যেতে হয়। গুলিস্তান পার হয়ে নর্থ সাউথ রোড, ইংলিশ রোড, জনসন রোড, ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রবেশ করলেই এক রাশ পুরানো স্মৃতি মনে ভর করে। মার্চের ১৫ তারিখ আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। জিন্দাবাহার লেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব দুরে নয়। এই জিন্দাবাহার লেনেই পথিকৃত প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমদের বসবাস ছিল। এখান থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসায়ীক সফলতার সবটুকুই অর্জন করেন। তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন সমাজের জন্য, জাতির জন্য সততার এক মহান আদর্শ। প্রমাণ করে গেছেন ব্যবসায় সততা একজন ব্যক্তিকে কত দ্রুত এবং নিয়মিতভাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এই মহাপুরুষ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার বিটেশ্বর গ্রামে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ পরলোকগমন করেন।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের পর পুরো পুরানো ঢাকাই ছিল মৃত্যুপুরী। ইংলিশ রোড, ইসলামপুর, শাঁখারী বাজার, তাঁতিবাজার পুরো এলাকাই ছিল আতঙ্কের ও ভয়ের স্থান। ২৬ মার্চে ইংলিশ রোডে আগুন দেয়ার পর আমাদের বাসার প্রতিবেশীরা সবাই ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আব্বা যেহেতু বঙ্গবন্ধুর সাহায্য তহবিলে অর্থ সাহায্য প্রদান করেছিলেন তখন অনেকেই বললেন যে সাহায্যকারীর তালিকা দেখে দেখে পাকিস্তানিরা বাড়িতে হানা দেবে। তাই এক পর্যায়ে তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন যে ঢাকা ত্যাগ করবেন। কিন্তু জিন্দাবাহারের বাড়িটি এবং ব্যবসা এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন সেটা ভাবতেই বাবা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। যতটুকু মনে পড়ে ছেড়ে যেতে একদমই চাচ্ছিলেন না। আশে পাশের প্রতিবেশী এবং আমার বড় বোনেরা এই ব্যপারে আব্বাকে রাজী করানোর জন্য ভ‚মিকা রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২৭ মার্চ দুপুর নাগাদ আমার এক মামার নিকট সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমরা সবাই দাউদকান্দিতে আমাদের গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। জিন্দাবাহার ছেড়ে না যাওয়ার এই ইচ্ছার হয়তো অনেক কারণ ছিল।

১৯৪৫ সালেই ঢাকার ইসলামপুর রোডের উপর দোতলায় মহিউদ্দীন আহমদ কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মুসলিম বেঙ্গল লাইব্রেরি’ নামে একটি বইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ‘ঢাকা বুক ডিপো’ নামে তিনি নিজেই প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান টেস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ৪৫ টি বই তিনি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে এ দেশে বইয়ের ব্যবসায় কিছুই মন্দাভাব দেখা দেয়। তখন পুস্তক প্রকাশকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে ছিল এবং বই প্রকাশের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় মহিউদ্দীন আহমদ বিকল্প চিন্তা শুরু করলেন। ঐ সময়ে পূর্ববাংলায় ভ‚চিত্রাবলী, দেয়ালমানচিত্র, গেøাব ইত্যাদির দারুণ অভাব ছিল। তখন ভারত থেকে এ ধরনের শিক্ষা উপকরণগুলো আমদানি হতো এবং এগুলোর চাহিদাও ছিল যথেষ্ট। দেয়াল মানচিত্রগুলো ছাপা হতো রাজার দেউড়ীস্থ আতা হোসেন খান লিঃ প্রেসে। এগুলো প্রচুর বিক্রি হলো। তখনো মহিউদ্দীন আহমদের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা সচ্ছল ছিল না। সেজন্য তিনি যৌথভাবে এ শিক্ষা উপকরণের ব্যবসাটি করার উদেশ্যে ঢাকার একজন বিখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ভদ্রলোক তাতে রাজী হননি। অধিকন্তু তিনি তাঁকে আরো নিরুৎসাহিত করলেন। এই অবস্থায় তিনি একটি ব্যবস্যায়ীক ঝুঁকি নিলেন। তিনি চিন্তা করলেন যে নিজের কেনা জিন্দাবাহারের বাড়িটি এক বন্ধুর কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার নেবেন এবং নিলেনও। পরবর্তী বছরে তিনি ভাবলেন গ্লোব পূর্ব বাংলায় তৈরি করা যায় কিনা। গ্লোব ডিজাইনের ব্যাপারে তৎকালীন সার্ভে অব পাকিস্তানের ড্রাফটম্যান আবদুল মালেক নামে এক ভদ্রলোকের ভারতীয় অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁর সাহায্যেই তিনি গ্লোব তৈরির মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে গ্লোব তৈরি করতে সক্ষম হন। কলকাতা চন্ডিচরণ এন্ড সন্স-এর যেসব লোক এটি তৈরির কাজ জানতেন আবদুল মালেক তাদেরকে যোগাড় করে এনে বাবাকে দিলেন। তাদের সহায়তায় বাবার নিজস্ব কয়েকজন লোক এই পদ্ধতিটি আয়ত্ব করেন।

তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বাজেটে প্রতিটি জেলাকে শিক্ষা উপকরণ কেনার একটি বরাদ্দ দেয়া হতো। সেই দায়িত্ব ছিলেন ডিসি/ডি আই প্রমুখ। তারা টেন্ডারের মারফতে এই শিক্ষা উপকরণগুলো কিনতেন এবং প্রাইমারী স্কুলগুলোতে বিনা পয়সায় বিতরণ করতেন। এভাবে যিনিই টেন্ডার পেতেন তিনিই মহিউদ্দীন আহমদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উপকরণগুলো কিনতেন। তখন এ ব্যবসায় মহিউদ্দীন আহমদ একচেটিয়া আধিপত্য লাভ করেন।

তবে প্রথম দিকে এগুলো তৈরি করার পর বাজারজাতের একটি সমস্যা দেখা দেয়। তখন ভারতের তৈরি ভূ-চিত্রাবলী, দেয়াল মানচিত্র, চার্ট ইত্যাদি প্রচুর পরিমানে এ দেশে আসতো। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সে এগুলো ভারত থেকে আমদানি বন্ধ করতে হবে। তিনি সাহস নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত সামরিক শাসক মেজর জেনারেল ওমরাওখানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। জেনারেল খান ধৈর্য্য সহকারে বাবার বক্তব্য শুনলেন এবং এ ব্যাপারে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা নিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। জেনারেল খানের প্রতিশ্রæতি মোতাবেক কিছুুদিন পর ভারতের তৈরি এসব শিক্ষা উপকরণ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাবা এ ব্যবসায় যথেষ্ঠ লাভবান হন এবং তিনি দেশের আনাচে কানাচে একজন আলোচিত ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। উল্লেখ্য যে, তিনিই একমাত্র সফল পুস্তক ব্যবসায়ী মিনি মাতৃভাষায় প্রথম মানচিত্র, বই, ওয়ালম্যাপ ইত্যাদি তৈরি করে দেশসেবার প্রধান দায়িত্বকে কর্তব্য বলে মনে করেছেন। এইজন্য অবশ্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এই ত্যাগ বৃথা যায়নি।

এর ফলে দেশের বহু বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে গিয়েছিল এবং শিক্ষিত সমাজও উপকৃত হয়েছে। ম্যাপ এর ব্যবসায় সাফল্য লাভের পর বাবা‘ঢাকা বুক ডিপোর নাম পরিবর্তন করে ১৯৫৬ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউজ নামকরণ করেন। রবীন্দ্র, নজরুল যুগে কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে বহুল প্রচারিত ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে ব্যবসায়ী প্রকাশক সংস্থাগুলোর অধিকাংশই লেখকের দারিদ্রের সুযোগে সামান্য মুল্যে বইয়ের স্বত্ব কিনে নিতেন, বই ছেপে বিক্রি করার ব্যাপারে বহু কারসাজি করতেন। মহিউদ্দীন আহমদ ছিলেন এক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী ব্যক্তি। তার সমগ্র ব্যবসায়ী জীবনে লেখকদের ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার লেশমাত্র ছিল না।

হয়ত বা জিন্দাবাহারের এই সফলতা, এই অর্জন বাবাকে ৭১-এর ২৬ মার্চে ভাবিয়ে ভুলেছিল এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে। হয়ত বা ভেবেছিলেন ফিরে এসে যদি জিন্দাবাহারকে আবার অক্ষত না পান। যেভাবে পাক বাহিনী এবং তাদের দোসররা চারিদিকে ধবংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তাতে এমনটা ভাব অযৌক্তিক কিছু ছিল না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই স্মৃতিগুলো বারবার উঁকি দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বেকে যার জন্য প্রতি মুহুর্তে গর্ব করি।

লেখক: অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ
ট্রেজারার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

x

জিন্দাবাহারের গলিতে এক পথিকৃৎ প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমদ

আপডেট: ১২:৫৮:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০২২

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বের সুবাদে প্রতিদিনই সেখানে যেতে হয়। গুলিস্তান পার হয়ে নর্থ সাউথ রোড, ইংলিশ রোড, জনসন রোড, ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রবেশ করলেই এক রাশ পুরানো স্মৃতি মনে ভর করে। মার্চের ১৫ তারিখ আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। জিন্দাবাহার লেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব দুরে নয়। এই জিন্দাবাহার লেনেই পথিকৃত প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমদের বসবাস ছিল। এখান থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসায়ীক সফলতার সবটুকুই অর্জন করেন। তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন সমাজের জন্য, জাতির জন্য সততার এক মহান আদর্শ। প্রমাণ করে গেছেন ব্যবসায় সততা একজন ব্যক্তিকে কত দ্রুত এবং নিয়মিতভাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এই মহাপুরুষ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার বিটেশ্বর গ্রামে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯০ সালের ১৫ মার্চ পরলোকগমন করেন।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের পর পুরো পুরানো ঢাকাই ছিল মৃত্যুপুরী। ইংলিশ রোড, ইসলামপুর, শাঁখারী বাজার, তাঁতিবাজার পুরো এলাকাই ছিল আতঙ্কের ও ভয়ের স্থান। ২৬ মার্চে ইংলিশ রোডে আগুন দেয়ার পর আমাদের বাসার প্রতিবেশীরা সবাই ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আব্বা যেহেতু বঙ্গবন্ধুর সাহায্য তহবিলে অর্থ সাহায্য প্রদান করেছিলেন তখন অনেকেই বললেন যে সাহায্যকারীর তালিকা দেখে দেখে পাকিস্তানিরা বাড়িতে হানা দেবে। তাই এক পর্যায়ে তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন যে ঢাকা ত্যাগ করবেন। কিন্তু জিন্দাবাহারের বাড়িটি এবং ব্যবসা এভাবে ছেড়ে চলে যাবেন সেটা ভাবতেই বাবা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। যতটুকু মনে পড়ে ছেড়ে যেতে একদমই চাচ্ছিলেন না। আশে পাশের প্রতিবেশী এবং আমার বড় বোনেরা এই ব্যপারে আব্বাকে রাজী করানোর জন্য ভ‚মিকা রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২৭ মার্চ দুপুর নাগাদ আমার এক মামার নিকট সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমরা সবাই দাউদকান্দিতে আমাদের গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। জিন্দাবাহার ছেড়ে না যাওয়ার এই ইচ্ছার হয়তো অনেক কারণ ছিল।

১৯৪৫ সালেই ঢাকার ইসলামপুর রোডের উপর দোতলায় মহিউদ্দীন আহমদ কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে মুসলিম বেঙ্গল লাইব্রেরি’ নামে একটি বইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ‘ঢাকা বুক ডিপো’ নামে তিনি নিজেই প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান টেস্ট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ৪৫ টি বই তিনি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে এ দেশে বইয়ের ব্যবসায় কিছুই মন্দাভাব দেখা দেয়। তখন পুস্তক প্রকাশকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে ছিল এবং বই প্রকাশের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় মহিউদ্দীন আহমদ বিকল্প চিন্তা শুরু করলেন। ঐ সময়ে পূর্ববাংলায় ভ‚চিত্রাবলী, দেয়ালমানচিত্র, গেøাব ইত্যাদির দারুণ অভাব ছিল। তখন ভারত থেকে এ ধরনের শিক্ষা উপকরণগুলো আমদানি হতো এবং এগুলোর চাহিদাও ছিল যথেষ্ট। দেয়াল মানচিত্রগুলো ছাপা হতো রাজার দেউড়ীস্থ আতা হোসেন খান লিঃ প্রেসে। এগুলো প্রচুর বিক্রি হলো। তখনো মহিউদ্দীন আহমদের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা সচ্ছল ছিল না। সেজন্য তিনি যৌথভাবে এ শিক্ষা উপকরণের ব্যবসাটি করার উদেশ্যে ঢাকার একজন বিখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ভদ্রলোক তাতে রাজী হননি। অধিকন্তু তিনি তাঁকে আরো নিরুৎসাহিত করলেন। এই অবস্থায় তিনি একটি ব্যবস্যায়ীক ঝুঁকি নিলেন। তিনি চিন্তা করলেন যে নিজের কেনা জিন্দাবাহারের বাড়িটি এক বন্ধুর কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার নেবেন এবং নিলেনও। পরবর্তী বছরে তিনি ভাবলেন গ্লোব পূর্ব বাংলায় তৈরি করা যায় কিনা। গ্লোব ডিজাইনের ব্যাপারে তৎকালীন সার্ভে অব পাকিস্তানের ড্রাফটম্যান আবদুল মালেক নামে এক ভদ্রলোকের ভারতীয় অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁর সাহায্যেই তিনি গ্লোব তৈরির মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে গ্লোব তৈরি করতে সক্ষম হন। কলকাতা চন্ডিচরণ এন্ড সন্স-এর যেসব লোক এটি তৈরির কাজ জানতেন আবদুল মালেক তাদেরকে যোগাড় করে এনে বাবাকে দিলেন। তাদের সহায়তায় বাবার নিজস্ব কয়েকজন লোক এই পদ্ধতিটি আয়ত্ব করেন।

তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বাজেটে প্রতিটি জেলাকে শিক্ষা উপকরণ কেনার একটি বরাদ্দ দেয়া হতো। সেই দায়িত্ব ছিলেন ডিসি/ডি আই প্রমুখ। তারা টেন্ডারের মারফতে এই শিক্ষা উপকরণগুলো কিনতেন এবং প্রাইমারী স্কুলগুলোতে বিনা পয়সায় বিতরণ করতেন। এভাবে যিনিই টেন্ডার পেতেন তিনিই মহিউদ্দীন আহমদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উপকরণগুলো কিনতেন। তখন এ ব্যবসায় মহিউদ্দীন আহমদ একচেটিয়া আধিপত্য লাভ করেন।

তবে প্রথম দিকে এগুলো তৈরি করার পর বাজারজাতের একটি সমস্যা দেখা দেয়। তখন ভারতের তৈরি ভূ-চিত্রাবলী, দেয়াল মানচিত্র, চার্ট ইত্যাদি প্রচুর পরিমানে এ দেশে আসতো। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সে এগুলো ভারত থেকে আমদানি বন্ধ করতে হবে। তিনি সাহস নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত সামরিক শাসক মেজর জেনারেল ওমরাওখানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। জেনারেল খান ধৈর্য্য সহকারে বাবার বক্তব্য শুনলেন এবং এ ব্যাপারে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা নিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। জেনারেল খানের প্রতিশ্রæতি মোতাবেক কিছুুদিন পর ভারতের তৈরি এসব শিক্ষা উপকরণ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাবা এ ব্যবসায় যথেষ্ঠ লাভবান হন এবং তিনি দেশের আনাচে কানাচে একজন আলোচিত ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। উল্লেখ্য যে, তিনিই একমাত্র সফল পুস্তক ব্যবসায়ী মিনি মাতৃভাষায় প্রথম মানচিত্র, বই, ওয়ালম্যাপ ইত্যাদি তৈরি করে দেশসেবার প্রধান দায়িত্বকে কর্তব্য বলে মনে করেছেন। এইজন্য অবশ্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এই ত্যাগ বৃথা যায়নি।

এর ফলে দেশের বহু বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে গিয়েছিল এবং শিক্ষিত সমাজও উপকৃত হয়েছে। ম্যাপ এর ব্যবসায় সাফল্য লাভের পর বাবা‘ঢাকা বুক ডিপোর নাম পরিবর্তন করে ১৯৫৬ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউজ নামকরণ করেন। রবীন্দ্র, নজরুল যুগে কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে বহুল প্রচারিত ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে ব্যবসায়ী প্রকাশক সংস্থাগুলোর অধিকাংশই লেখকের দারিদ্রের সুযোগে সামান্য মুল্যে বইয়ের স্বত্ব কিনে নিতেন, বই ছেপে বিক্রি করার ব্যাপারে বহু কারসাজি করতেন। মহিউদ্দীন আহমদ ছিলেন এক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী ব্যক্তি। তার সমগ্র ব্যবসায়ী জীবনে লেখকদের ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার লেশমাত্র ছিল না।

হয়ত বা জিন্দাবাহারের এই সফলতা, এই অর্জন বাবাকে ৭১-এর ২৬ মার্চে ভাবিয়ে ভুলেছিল এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে। হয়ত বা ভেবেছিলেন ফিরে এসে যদি জিন্দাবাহারকে আবার অক্ষত না পান। যেভাবে পাক বাহিনী এবং তাদের দোসররা চারিদিকে ধবংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তাতে এমনটা ভাব অযৌক্তিক কিছু ছিল না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই স্মৃতিগুলো বারবার উঁকি দেয়, স্মরণ করিয়ে দেয় একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বেকে যার জন্য প্রতি মুহুর্তে গর্ব করি।

লেখক: অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ
ট্রেজারার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়