০৬:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
স্বাধীনতার ৫১ বছর পর

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশ

এইচ কে জনি
  • আপডেট: ১২:৫১:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৪৪২০ বার দেখা হয়েছে

স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গত ৫১ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী দিনেও উন্নয়নের হাতছানি রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

পাকিস্তানি শাসকদের শোষণে-নিপীড়নে নিষ্পেষিত ও বিধ্বস্ত এক অর্থনীতি নিয়ে দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বহু চড়াই-উৎরাই পার করে সেই দেশটি এখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হতো যে বাংলাদেশকে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর সেই দেশটিই এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

স্বাধীনতার ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. আর. পারকিনসন ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যদি এই দেশটি উন্নতি করতে পারে, তা হলে নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীর যে কোন দেশ উন্নতি করতে পারবে।’

সেসব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন অনেক বিবেচনাতেই বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়গান শোনা যায়। সমৃদ্ধির বহু নামে বাংলাদেশকে পরিচিতি দেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে।

বিশ্বের নানা প্রান্তের গবেষক-বিশ্লেষকদের পাশাপাশি অর্থনৈতিক চালচিত্র পর্যবেক্ষণকারী নানা প্রতিষ্ঠানের অভিমত, জন্মের ৫২ বছরের মধ্যেই উন্নয়নের দুর্বার গতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সামাজিক উন্নয়ন- যে কোনও সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অভূতপূর্ব। সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রই বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক বিস্ময়ের নাম। বাংলাদেশেই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প। বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পগুলো।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ এখন দ্রুত উন্নয়নশীল প্রথম পাঁচটি দেশের একটি।

প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল-২০২১’ এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক অগ্রগতি এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫টি বড় অর্থনীতির একটি হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। উন্নয়ন গবেষকরা আজকের বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল, ‘এমার্জিং টাইগার’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’এরকম নানা অভিধায় ভূষিত করছেন।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকবে না। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে প্রত্যাশিত অবস্থানে যেতে পারেনি বাংলাদেশ।

আরও পড়ুনঃ বিজয় দিবসে দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষি, গার্মেন্টস এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স থেকে। আর মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে খাতগুলো। দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টিহীনতা দূর, শিক্ষা, চিকিৎসা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ, বিভিন্ন অপরাধ কমানো এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে খাতগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশকে আরও এগিয়ে নিতে সময়ের সঙ্গে মিল রেখে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে। এছাড়া পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফলে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর কৃষিতে এ অর্জনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির হাত ধরে গত ১৫ বছরে পোলট্রি, গবাদিপশু এবং মাছ চাষে বিপ্লব হয়েছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ সময় পাট রপ্তানি করে দেশটি অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। বিশ্বে পলিপ্রোপাইলিন যুগ আসার পর পাটপণ্যের চাহিদা দ্রুত হ্রাস পায়, কিন্তু সেই শূন্যস্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নেয় তৈরি পোশাক খাত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সব চাইতে বেশি অবদান এই তৈরি পোশাক খাতেরই। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের এই শিল্পকে বর্তমানে উন্নত বিশ্বসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুকরণ করছে। স্বাধীনতার পরে যে শিল্প আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছে তার একমাত্র মাধ্যম কিন্তু এই পোশাক শিল্পই। বিশ্বের বুকে নিজেদের কঠোর শ্রম ও উৎপাদন দক্ষতা দেখাতে পারার প্রমাণ মেলে এই শিল্পের মাধ্যমে। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)।

স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশার কথাই ছিল বেশি। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। একটি অতি জনবহুল দেশ (প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার ৪০০) এবং জনসংখ্যা আরও বাড়ছে (বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি) এবং দেশটির মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশের কম)।’

বিশ্বব্যাংকের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ’-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২১ সালে প্রবাস আয় প্রাপ্তিতে বিশ্বের ১০টি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে ছিল। ২০২০ সালেও বাংলাদেশ একই অবস্থানে ছিল। তবে ২০২১ সালে প্রাপ্ত প্রবাস আয় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার থেকে ২ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ২২০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, ১৯৭৬ থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীর মোট সংখ্যা এক কোটি ৪১ লাখ ৩৮ হাজার ১৪০। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ সৌদি আরব, ১৭ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ ওমান, ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মালয়েশিয়া, ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ সিঙ্গাপুর, ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কাতার, ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ কুয়েত এবং বাকিরা অন্যান্য দেশে গেছেন।  ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পেশাজীবী শ্রেণিতে বিদেশে গেছেন দুই লাখ ৭৮ হাজার ৯৭৮ জন।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সরকারের ‘দিন বদলের রূপকল্প-২০২১’ এ উল্লেখ ছিল বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার অঙ্গীকার। ২০১৮ সালেই বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত’ দেশের ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হওয়ার ‍সুপারিশ পেয়েছে। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যেই এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে পারবে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গত ১৩ বছরের গড় অর্জন, এর আগের অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। ২০০১-০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় ২০২২ সালের মে মাসে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। ১৯৭৫ থেকে এ পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৭৩ শতাংশই ঘটেছে গত ১২ বছরে।

আইএমএফের হিসাব মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও ২০১৫ সালেই আমাদের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২১ সালে মোট জিডিপি ৪০৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নানা সামাজিক সূচকে, যেমন গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির শতকরা হার, টিকাদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশ।  দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ দশমিক ৮ বছর। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর। নারীর গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ৫ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।  জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার এখন ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১ দশমিক ৩২ শতাংশ। তার আগের বছর ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে রাজস্ব আয় ছিল ১৬৬ কোটি টাকা, সেখানে ২০২০-২১ সালে রাজস্ব আয় হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ রাজস্ব বেড়েছে এক হাজার ৫৬৬ গুণ। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটিতে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৮ গুণ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আয় আসবে মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি ও রফতানি শুল্ক থেকে। বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ৬৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

ঈর্ষণীয় এসব অর্জনের উচ্চতার সবচেয়ে বড় পরিমাপের পরিষ্কার ধারণা উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। বিশ্বের নীতিনির্ধারণী এই আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ।

বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেছে। স্বাধীনতার সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি খাদ্যশস্য এখন উৎপাদন করতে পারছে দেশ।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অর্থনীতির পালা বদলের চিত্র সহজেই বোঝা যায় দেশটির অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ সব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৬২৯ কোটি ডলার, মাথাপিছু আয় ছিল ৮৮ ডলার, রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। সে সময় রিজার্ভ ছিল ১১০ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২২৬ কোটি ডলার, রাজস্ব আয় ছিল ২৮৫ কোটি টাকা আর দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। ১৯৭৬ সালে রেমিট্যান্স ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

৫১ বছর রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২১-২২ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮ কেটি ডলারে, আর রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় অবদান রেখে চলেছে। গত ৫১ বছরে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গত ৫০ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে। যে পাকিস্তানকে আমরা পরাজিত করেছি সেই পাকিস্তান এখন অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। তবে দেশে ৭৫ পরবর্তী অর্থনীতির যত পরিবর্তন ঘটেছে তার ৭৩ শতাংশ হয়েছে গত ১৩ বছরে। এরই মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের সক্ষমতার একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বিশ্বের বুকে। এছাড়া মেট্রোরেলসহ বাকী মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে দেশের চেহারা আরও পাল্টে যাবে।

ঢাকা/এইচকে

ট্যাগঃ

শেয়ার করুন

x
English Version

স্বাধীনতার ৫১ বছর পর

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশ

আপডেট: ১২:৫১:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২

স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গত ৫১ বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী দিনেও উন্নয়নের হাতছানি রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

পাকিস্তানি শাসকদের শোষণে-নিপীড়নে নিষ্পেষিত ও বিধ্বস্ত এক অর্থনীতি নিয়ে দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বহু চড়াই-উৎরাই পার করে সেই দেশটি এখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হতো যে বাংলাদেশকে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর সেই দেশটিই এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

স্বাধীনতার ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. আর. পারকিনসন ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যদি এই দেশটি উন্নতি করতে পারে, তা হলে নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীর যে কোন দেশ উন্নতি করতে পারবে।’

সেসব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন অনেক বিবেচনাতেই বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিবিদ ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়গান শোনা যায়। সমৃদ্ধির বহু নামে বাংলাদেশকে পরিচিতি দেওয়া হয় বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে।

বিশ্বের নানা প্রান্তের গবেষক-বিশ্লেষকদের পাশাপাশি অর্থনৈতিক চালচিত্র পর্যবেক্ষণকারী নানা প্রতিষ্ঠানের অভিমত, জন্মের ৫২ বছরের মধ্যেই উন্নয়নের দুর্বার গতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সামাজিক উন্নয়ন- যে কোনও সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অভূতপূর্ব। সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রই বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক বিস্ময়ের নাম। বাংলাদেশেই নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প। বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পগুলো।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের রোল মডেল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ এখন দ্রুত উন্নয়নশীল প্রথম পাঁচটি দেশের একটি।

প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ’ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল-২০২১’ এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক অগ্রগতি এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫টি বড় অর্থনীতির একটি হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। উন্নয়ন গবেষকরা আজকের বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল, ‘এমার্জিং টাইগার’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’এরকম নানা অভিধায় ভূষিত করছেন।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের তালিকায় আর স্বল্পোন্নত দেশ থাকবে না। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে প্রত্যাশিত অবস্থানে যেতে পারেনি বাংলাদেশ।

আরও পড়ুনঃ বিজয় দিবসে দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কৃষি, গার্মেন্টস এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স থেকে। আর মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে খাতগুলো। দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টিহীনতা দূর, শিক্ষা, চিকিৎসা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ, বিভিন্ন অপরাধ কমানো এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে খাতগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশকে আরও এগিয়ে নিতে সময়ের সঙ্গে মিল রেখে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন জরুরি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে। এছাড়া পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফলে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর কৃষিতে এ অর্জনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির হাত ধরে গত ১৫ বছরে পোলট্রি, গবাদিপশু এবং মাছ চাষে বিপ্লব হয়েছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ সময় পাট রপ্তানি করে দেশটি অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। বিশ্বে পলিপ্রোপাইলিন যুগ আসার পর পাটপণ্যের চাহিদা দ্রুত হ্রাস পায়, কিন্তু সেই শূন্যস্থান ক্রমান্বয়ে দখল করে নেয় তৈরি পোশাক খাত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সব চাইতে বেশি অবদান এই তৈরি পোশাক খাতেরই। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশই আসছে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশের এই শিল্পকে বর্তমানে উন্নত বিশ্বসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুকরণ করছে। স্বাধীনতার পরে যে শিল্প আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করিয়েছে তার একমাত্র মাধ্যম কিন্তু এই পোশাক শিল্পই। বিশ্বের বুকে নিজেদের কঠোর শ্রম ও উৎপাদন দক্ষতা দেখাতে পারার প্রমাণ মেলে এই শিল্পের মাধ্যমে। ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)।

স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশার কথাই ছিল বেশি। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। একটি অতি জনবহুল দেশ (প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার ৪০০) এবং জনসংখ্যা আরও বাড়ছে (বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি) এবং দেশটির মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশের কম)।’

বিশ্বব্যাংকের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ’-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০২১ সালে প্রবাস আয় প্রাপ্তিতে বিশ্বের ১০টি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে ছিল। ২০২০ সালেও বাংলাদেশ একই অবস্থানে ছিল। তবে ২০২১ সালে প্রাপ্ত প্রবাস আয় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার থেকে ২ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ২২০ কোটি ডলারে। বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, ১৯৭৬ থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীর মোট সংখ্যা এক কোটি ৪১ লাখ ৩৮ হাজার ১৪০। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ সৌদি আরব, ১৭ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ ওমান, ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মালয়েশিয়া, ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ সিঙ্গাপুর, ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কাতার, ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ কুয়েত এবং বাকিরা অন্যান্য দেশে গেছেন।  ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পেশাজীবী শ্রেণিতে বিদেশে গেছেন দুই লাখ ৭৮ হাজার ৯৭৮ জন।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সরকারের ‘দিন বদলের রূপকল্প-২০২১’ এ উল্লেখ ছিল বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার অঙ্গীকার। ২০১৮ সালেই বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত’ দেশের ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হওয়ার ‍সুপারিশ পেয়েছে। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যেই এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে পারবে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গত ১৩ বছরের গড় অর্জন, এর আগের অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। ২০০১-০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় ২০২২ সালের মে মাসে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। ১৯৭৫ থেকে এ পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৭৩ শতাংশই ঘটেছে গত ১২ বছরে।

আইএমএফের হিসাব মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও ২০১৫ সালেই আমাদের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে জিডিপির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২১ সালে মোট জিডিপি ৪০৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নানা সামাজিক সূচকে, যেমন গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির শতকরা হার, টিকাদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশ।  দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ দশমিক ৮ বছর। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর। নারীর গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ৫ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।  জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার এখন ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১ দশমিক ৩২ শতাংশ। তার আগের বছর ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে রাজস্ব আয় ছিল ১৬৬ কোটি টাকা, সেখানে ২০২০-২১ সালে রাজস্ব আয় হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ রাজস্ব বেড়েছে এক হাজার ৫৬৬ গুণ। ১৯৭২-৭৩ সালে বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটিতে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৬৮ গুণ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আয় আসবে মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি ও রফতানি শুল্ক থেকে। বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে ৬৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

ঈর্ষণীয় এসব অর্জনের উচ্চতার সবচেয়ে বড় পরিমাপের পরিষ্কার ধারণা উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। বিশ্বের নীতিনির্ধারণী এই আন্তর্জাতিক সংস্থার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশ।

বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেছে। স্বাধীনতার সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি খাদ্যশস্য এখন উৎপাদন করতে পারছে দেশ।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অর্থনীতির পালা বদলের চিত্র সহজেই বোঝা যায় দেশটির অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ সব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৬২৯ কোটি ডলার, মাথাপিছু আয় ছিল ৮৮ ডলার, রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। সে সময় রিজার্ভ ছিল ১১০ কোটি টাকা, আমদানি ব্যয় ছিল ২২৬ কোটি ডলার, রাজস্ব আয় ছিল ২৮৫ কোটি টাকা আর দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। ১৯৭৬ সালে রেমিট্যান্স ছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

৫১ বছর রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২১-২২ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৮ কেটি ডলারে, আর রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় অবদান রেখে চলেছে। গত ৫১ বছরে দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ থেকে কমে ২০.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, গত ৫০ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে। যে পাকিস্তানকে আমরা পরাজিত করেছি সেই পাকিস্তান এখন অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। তবে দেশে ৭৫ পরবর্তী অর্থনীতির যত পরিবর্তন ঘটেছে তার ৭৩ শতাংশ হয়েছে গত ১৩ বছরে। এরই মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের সক্ষমতার একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বিশ্বের বুকে। এছাড়া মেট্রোরেলসহ বাকী মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে দেশের চেহারা আরও পাল্টে যাবে।

ঢাকা/এইচকে