ব্যাংককে ক্রিমিনাল ইনস্টিটিউট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

- আপডেট: ০২:১২:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / ১০৪১০ বার দেখা হয়েছে
ব্যাংককে গত ১৫ বছরে ক্রিমিনাল ইনস্টিটিউট হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংককে পুরোপুরি ধ্বংশ করা হয়েছে। এই ব্যাংকটির আইনে দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বণিক বার্তা আয়োজিত পলিসি কনক্লেভ ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ কর্মশালায় তিনি এ কথা বলেন।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) এবং (সচিবের রুটিন দায়িত্ব) মো. আবদুর রহিম খান।
এছাড়া প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন এ এইচ এম আহসান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, জাতীয় ভোক্তা-অধিকারের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও এমডি মোস্তফা কামাল, টি, কে, গ্রুপের গ্রুপ ডিরেক্টর মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, আমার মনে হয় শেখ হাসিনার নামে একটা পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া দরকার। কারণ বায়তুল মোকাররমের খতিব যদি পালিয়ে যাওয়া লাগে, তাহলে বুঝতে হবে কি পরিমাণ ধংস করা হয়েছে সবগুলো খাত। একাডেমি থেকে শুরু করে সব খাত কিভাবে ধংস করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের যে দাম দেখছি, তাতে ত দেশে দাম কমার কথা। বাড়ার কোন কারণ ত দেখি না। আমি আশা করব আমি এ কাজটা করতে পারব। আমরা প্রতিযোগিতা কমিশনকে পুরোপুরি স্বাধীন করে দিতে চাই। বাজারে যাতে প্রতিযোগিতা বিরোধী কোন কর্মকান্ড না ঘটে। মন্ত্রণালয়ের সেখানে কোন হস্তক্ষেপ যেন না থাকে, সেদিকে আগাতে চাই।
তিনি আরো বলেন, ধান সংগ্রহে সরকারি সংগ্রহটা সীমিত করতে চাই। সরকারি সংগ্রহটা আমদানি নির্ভর হওয়া উচিত। তাহলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ সাভাবিক হবে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আমাদের নীতিগুলো ধনিক শেণিকে সুবিধা দেয়ার জন্য হয়েছে। ভোক্তা বা সাধারণ মানুষকে সুবিধা দেয়ার জন্য এসব নীতি গ্রহণ হয় না। বিগত ১৫ বছর দেশে উল্লেখযোগ্য কোন বিনিয়োগ হয়নি। যদি সেটি না হয় তাহলে কর্মসংস্থান কিভাবে হবে? কিভানে আমরা কার কাছে কর আদায় করব?
আরও পড়ুন: এডিবি থেকে সর্বোচ্চ ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ
বশির উদ্দিন বলেন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) ধংস করা হয়েছে ১৫ বছর ধরে। ১২ হাজার কোটি টাকার একটা অপারেশন করে মাত্র ১৪২ জন। উপকার ভোগীদের সং্খ্যা ১ কোটি। শুনতে ভালোই লাগছে। কিন্তু আমরা যখন প্রাথমিকভাবে যাচাই করেছি, দেখলাম ৪৩ লাখ ভুয়া। আমার ধারণা এটি এক্সট লেভেলে যাচাই করলে আরো ২০-২৫ লাখ ভুয়া পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরা টিসিবির টেন্ডারে অংশ নেন না। আমি অনুরোধ করছি আপনারা অংশ নিন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, যারা রিটার্ন দাখিল করছেন না, তাদের কোনো সমস্যায়ও পড়তে হচ্ছে না। তাই আমরা এ বিষয়ে এনফোর্সমেন্টে যাচ্ছি। অনেক ব্যবসায়ীই ভ্যাট চালান দিতে চান না। আমাদের নাগরিকরা বিদেশে গিয়ে আইন ভঙ্গ করছেন না। কিন্তু, দেশে আমরা আইন মানি না। তার মানে, এ সমস্যার সমাধান করতে আইনের প্রয়োগ করা হয় না, এটাই সমস্যা।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন,বাস্তবে মুক্তবাজার অর্থনীতি বলতে কিছু নেই, যা আছে তা অলিগোপলি। বেশিরভাগ বাজার ও পণ্য উৎপাদন কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূলনীতি অনুযায়ী বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবে, ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা বেশি হবে এবং তথ্য উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বাজার কয়েকটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, প্রতিযোগিতাও নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশন ও সরকারেরও দায় আছে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে উৎপাদক ও ভোক্তারা কেউই যৌক্তিক দামে পণ্য কিনতে পারছে না। এর সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বড় অংশ কৃষক। এর মানে উৎপাদনে এমন কিছু উপাদান ব্যবহার হচ্ছে, যা কৃষকদের ক্ষতি করছে। অথচ তারা সঠিক দামও পাচ্ছে না।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, একসময় গবেষণা ও সরকারি নীতিমালায় কৃষি ও খাদ্য খাত গুরুত্ব পেত। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে কৃষি খাত গুরুত্ব হারাতে থাকে। একই সঙ্গে গত দেড় দশকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) কার্যকরভাবে কাজ করছে না, মন্ত্রণালয়গুলোর নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে গেছে, সবকিছু একক কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এমনকি আদালতও ওপরের নির্দেশনা অনুযায়ী চলে, যা গত দেড় দশকে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়াটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,সরকারের কাছে বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।রকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বড় কারণ হলো, বাজারের পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে নেই। বার্ষিক উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য হয়তো জানা আছে, কিন্তু প্রাত্যহিক উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য সরকারের জানা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশক ও সরবরাহের তথ্য স্থানীয় পর্যায়ে না থাকলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীদের কাছেও এ তথ্য থাকে। এরকম একটা পরিস্থিতি দিয়ে সরকারের পক্ষে কখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, খাদ্যস্ফীতি রোগের উপসর্গ মাত্র, সমস্যা নয়। অনেক সময় উৎপাদন পর্যাপ্ত থাকার পরও বাজারে সংকট থাকে। চাহিদার হিসাবটাও আমাদের ঠিকঠাক হয় না। সরকারের কাঠামোর ভেতরে তা থাকতে হবে। সরকারের কাছে ব্যাপক ও সমন্বিত তথ্য-উপাত্ত থাকা দরকার।বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু আইনি সংস্কার করা দরকার। একজন পরিবেশক শুধুমাত্র একজনের পণ্য সরবরাহ করবে, এ সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে।
সারজিস আলম বলেছেন, সকল রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র এখানে থাকা দরকার ছিল। তাদের সদিচ্ছা ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। এটা আমাদের রাজনৈতিক কালচার। নতুন বাংলাদেশে হাসিনাকে খুনী হাসিনা বলতে পারি আমরা। সে সৎসাহস আমাদের আছে। বাজার সিন্ডিকেটের কুশীলবদের বিরুদ্ধেও আমাদের আঙুল তুলতে হবে। আগের মতো চাঁদাবাজি এখনো চলছে। কারওয়ান বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন বাজারে কয়েকটা স্টোকহোল্ডারকে চাঁদা দিতে হয়। যে কারণে দাম অনেকগুণ বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: বিশ্ববাজারে লাফিয়ে বাড়ছে স্বর্ণের দাম, বাড়তে পারে দেশেও
তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি আমাদের মধ্যে জেনেটিকালি ঢুকে গেছে। সেজন্য রাতারাতি এটা বদলানো যাবে না। ১৪ জন উপদেষ্টা যদি ২৪টা সংস্কার করেন তাহলেই অনেক বড় পরিবর্তন হবে। এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। শুধু সবার সদিচ্ছা দরকার।
তিনি আরো বলেন, আমদানিকরণ প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি। কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানি সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়। সেক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক বাজার থেকে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের দিকে যেতে হবে। সর্বোপরি সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই বাজারে ভারসাম্য আনা যাবে।
সারজিস আলম বলেন, তারা হাসপাতাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন কিছু করতে পারলে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ আপনাদের স্মরণ রাখবে। একইভাবে ব্যক্তিগতভাবে সৎ হতে হবে। ব্যক্তিগত লোভই সকল অনিয়মের কারণ। এর থেকে বের হতে না পারলে আমরা একই চক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকবে। সেক্ষেত্রে আমরা যে যেই মতাদর্শের আছি তারা মেডিটেশনসহ বিভিন্ন সেশনের আয়োজন করতে পারি।
উমামা ফাতেমা বলেন, আগামী রমজানকে কেন্দ্র করে দ্রব্যের মূল্য কোন অবস্থায় যাবে আমরা জানি না। বিগত সময়ে দেখেছি, রোজাকে সামনে রেখে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়। সেখানে সরকারকে যথাযথ তদারকি করতে হবে। সে জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে সঠিক একটি পরিকল্পনা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বাজারে গত ১৫ বছর ধরে একটি সিস্টেম চলে আসছিল। এখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। বলা হয়েছে, আগামী এক বছর তারা থাকবে। তাদেরকে স্পষ্ট করতে হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণে কী পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি, রমজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ফল। এবারও ফলের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। রমজানে ফল প্রয়োজনীয় জিনিস। এখন ফলের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করলে ফলের দাম বাড়বে এবং সে চাপটা পড়বে ভোক্তাদের ওপর।
কৃষিতে ভর্তুকির বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষকদের ভর্তুকির বিষয়টি কৃষকদের কাছে যায় না। এটা শুধুমাত্র কৃষি উপকরণ ক্রয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কৃষকদের কাজে ভর্তুকি সেভাবে পাচ্ছেন না তারা। তাই বলব, সরকারকে একটি সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। আগের সরকারের মত ব্যবসায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে খুচরা বিক্রেতার ওপর নিয়ন্ত্রণ করলে হবে না। সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
ঢাকা/এসএইচ