লবন এর ৯ উপকারিতা ও গ্রহনের দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী প্রভাব

- আপডেট: ০২:৪৯:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ জুলাই ২০২২
- / ১২৭৮৬ বার দেখা হয়েছে
বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: খাবার মুখে দেওয়ার সাথে সাথে যদি স্বাদ পাই নোনতা, ব্যাস হয়ে গেল! মাথা টাই যেন গরম হয়ে যায় আর খেতেও ইচ্ছে করে না। আবার লবন এর পরিমাণ কম হলেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে থাকে। অবশ্য লবণের পরিমাণ কম হলে একটু কাঁচা লবণ ব্যবহার করে আমরা খাবারটিকে সুস্বাদু করে নেই। কারণ আমাদের কারোই বিস্বাদ খাবার খেতে ইচ্ছে করে না।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
শুধু খেতে বসলেই নয় যেকোনো টক ফল থেকে শুরু করে কিছু মিষ্টি জাতীয় ফলও আমরা লবণ মাখিয়ে না খেলে যেন তা কিছুতেই মুখে রোচে না।
“এক চিমটি লবন – আহা,
স্বাদ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ!”
একটু কাব্যিক হবার চেষ্টা করছিলাম! সে যাই হোক। লবন নিয়ে কাব্য রচনা পরে হবে। তার আগে জানা দরকার এই যে নানা অজুহাতে লবণ খেয়ে নিচ্ছেন তা শরীরের জন্যে ভালো হচ্ছে নাকি মন্দ।
লবন কি?
মূলত লবণ হলো খাদ্যের এমন এক ধরনের খনিজ উপাদান যেটা বেশি খেলেও আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর আবার কম খেলেও ক্ষতিকর । তাই প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় সঠিক পরিমাণে লবণ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ভীষণ প্রয়োজন।
এখন আপনি কীভাবে বুঝবেন যে আপনার জন্য লবন গ্রহণের সঠিক মাত্রা কোনটি?
আসলে আমাদের প্রত্যেকের শরীরের জন্য দৈনিক লবণের চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
বয়সভেদে এ মাত্রা কীরূপ হবে তা তুলে ধরছি –
- বয়স(১-৩) বছর – ২ গ্রাম/দিন
- বয়স(৪-৬) বছর – ৩ গ্রাম/দিন
- বয়স(৭-১০) বছর – ৫ গ্রাম /দিন
- বয়স (১১ বছর – প্রাপ্তবয়স্ক)- ৫ গ্রাম/দিন বা ১ চা চামচের একটু কম।
- তবে ১বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের ১ গ্রাম/দিন হলেও যথেষ্ট।
ছয় মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেই সোডিয়ামের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে লবন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
তবে আজকাল ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখা যায় লবণদানি থেকে চিমটি চিমটি লবণ অনায়াসে খেয়ে ফেলতে। কিন্তু এটা বাচ্চাদের জন্য একটি বদঅভ্যাস যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই তাদের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেনো বাচ্চারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত লবন কোনভাবেই না খায়।
লবন এ বিদ্যমান উপাদান সমূহঃ
আজ আপনাদের লবণ নিয়ে কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করবো। তবে প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার লবণে কি কি আছে।
১০০ গ্রাম খাবার লবনে যা যা থাকে,
- সোডিয়াম – 38758 mg
- ক্যালসিয়াম – 24 mg
- আয়রন – 0.3 mg
- পটাশিয়াম – 8 mg
- ম্যাগনেশিয়াম – 1 mg
- জিঙ্ক – 0.1 mg
- ম্যাঙ্গানিজ – 0.1 mg
- সেলেনিয়াম – 0.1 microgram
লবন এর স্বাস্থ্যউপকারীতাঃ
১. আয়োডিনের ঘাটতি পূরন করেঃ
আয়োডিন যুক্ত লবন আয়োডিনের অন্যতম একটি উৎস। এছাড়া এটি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন,আমাদের শরীর প্রাকৃতিকভাবে আয়োডিন উৎপন্ন করতে পারে না। আয়োডিনের অভাবে শরীরে হাইপোথাইরয়েডিজম এর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমঃ
লবন শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলে যা স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাক এর সাথে সম্পর্কিত। কম রক্তচাপ থাকলে লবন খেলে রক্তচাপ বৃদ্ধিতে তা কাজ করে।
৩. ডায়াবেটিসঃ
সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে হলে দেহে ইনসুলিনের পরিমান ও স্বাভাবিক মাত্রায় থাকা উচিত। লো-সোডিয়াম ডায়েট শরীরে ইনসুলিন এর প্রতি সংবেদনশীলতা দুর্বল করে দেয়।
৪. স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থাঃ
গর্ভবতী মায়েদের নিজের সুস্থতার জন্য এবং তার গর্ভের সন্তান এর সুস্থ স্বাভাবিক জন্মের জন্য প্রয়োজন হয় স্বাস্থ্যকর একটি ডায়েটের, যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে লবন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
৫. Hyponatremia প্রতিরোধ করেঃ
এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে কোষের বাইরে অবস্থিত ফ্লুইড সোডিয়ামের ঘাটতিতে ভোগে। অতিরিক্ত ঘাম, পানির অভাব অথবা ডায়রিয়ার কারনে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
৬. ভারসাম্য রক্ষা করেঃ
লবণ আমাদের শরীরের ইলেক্ট্রো-লাইট হিসেবে কাজ করে শরীরে তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে।
৭. রক্তচাপঃ
স্বাস্থ্যকর রক্তচাপ বজায় রাখতেও সাহায্য করে লবন।
৮. সহায়ক ভূমিকা পালনঃ
লবন স্নায়ু সংক্রমণ ও পেশীর কার্যকারিতায় সহায়তা করে।
৯. আর্থাইটিসঃ
যারা আর্থাইটিসের সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত পরিমাণমতো লবন খেতে পারেন।
খাবারেই নয় শুধু দাঁতের ব্যথা উপশমে, ঠোঁটের নিচে ঘা ও মুখের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে লবণ পানির উপকারিতা অনেক। রান্নার সময় হাতে ছ্যাঁকা লাগলে লবণ ব্যবহারে কিছুটা উপশম হয়।
লবন এর ক্ষতিকারক দিকঃ
লবণের উপকারিতা তো জানলেন কিন্তু আমরা যারা অতিরিক্ত লবণ খাই তারা কি জানেন অতিরিক্ত লবণ খেলে কি কি শারীরিক ক্ষতি হতে পারে?
চলুন জেনে নেই –
উচ্চ রক্তচাপ আজ যেন প্রতিটি ঘরেই লক্ষ্য করা যায়। শরীরের রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর বেশি বা কম থাকলে কিডনির সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যেহেতু বেশির ভাগ সময় অতিরিক্ত লবন খেলেই উচ্চ রক্তচাপ হয় তাই খাদ্য তালিকায় অতিরিক্ত লবন এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত লবন যেমন হৃদপিণ্ডের জন্যে ক্ষতিকর তেমনি তা কিডনির উপর চাপ বাড়ায়।
আবার এ ধরনের উচ্চ রক্তচাপে সাধারণত তেমন কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। এছাড়াও লবন খাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পমেয়াদি কিছু লক্ষন আছে।
লবন খাওয়ার স্বল্পমেয়াদী প্রভাবের মধ্যে রয়েছে
Water Retention, রক্তচাপ বৃদ্ধি, তীব্র তৃষ্ণা। লবন জাতীয় খাবার বেশি খেলে দেখবেন আপনার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে এবং খুব ঘন ঘন পানি পিপাসা অনুভূত হচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব গুলোর মধ্যে রয়েছে
রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি, পেটে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ লবণযুক্ত খাবার পেটে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
উচ্চ রক্তচাপ ও লবন এর মধ্যে সম্পর্কঃ
উচ্চ রক্তচাপ আছে– লবন কম খাবেন। এমন কথা আমরা সবাই শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু আপনি কি জানেন??
আসলে ঠিক কি কারনে লবন খেতে নিষেধ করা হয়??
আমরা জানি, লবণ বৃক্কে বেশি পানি ধরে রাখতে সহায়তা করে। আর,আমাদের বৃক্কের কাজ হলো আমাদের রক্তে থাকা অপ্রয়োজনীয় পানি ছেঁকে মূত্রথলিতে পাঠানো এবং মূত্রের মাধ্যমে তা দেহ থেকে বের করে দেওয়া। এই প্রক্রিয়া চলার সময়ে অতিরিক্ত পানি দেহ থেকে বের করার জন্য শরীরের পটাসিয়াম ও সোডিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখে বৃক্ক।
লবণ হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড যা আপনার শরীরের সোডিয়ামের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিবে এবং বৃক্কের পানি অপসারণ ক্ষমতা কমাবে। আর রক্ত প্রবাহী নালীতে পানির পরিমান বেশি হলে, নালীর ওপর অতিরিক্ত চাপ পরে। এই চাপকে ভারসাম্যে আনার জন্য রক্তবাহী নালী আগের তুলনায় পুরু হতে শুরু করে। এতে করে নালীর ভিতরে রক্ত প্রবাহের জায়গা কমতে থাকে।
যার ফলে রক্ত চাপ বেড়ে যায়। তাই এই অবস্থায় লবণ খাওয়া একদমই ঠিক না। কারন,এতে রক্তনালী ফেটে যাওয়ারও সম্ভবনা থাকে। রক্তনালী দিয়ে সাধারণত আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় রক্ত এবং অক্সিজেন প্রবাহিত হয়। লবন বেশি খেলে রক্তনালীতে চাপ পড়ার কারনে রক্তনালী শক্ত ও সংকুচিত হয়ে যায়।
রান্নায় লবন ব্যবহার কি কমাবো?
এত সব অপকরিতা দেখে আপনি হয়ত ভাবছেন তাহলে কি রান্নাতেও লবণের পরিমাণ কমিয়ে দিবেন কি না।
এক্ষেত্রে বলবো যে, অতিরিক্ত কাঁচা লবণ এড়িয়ে চলতে পারলে আর রান্নায় অতিরিক্ত লবন না দিয়ে পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করার অভ্যাস করাটাই শ্রেয়।
কিছু খাবার আছে যা আমরা ত্যাগ করলেই অতিরিক্ত লবন এড়িয়ে চলতে পারব।যেমন:ফাস্টফুড জাতীয় খাবার, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার ইত্যাদি।
কারণ এ ধরনের খাবারকে মুখরোচক করতে শুধু অতিরিক্ত লবন নয় বিভিন্ন ধরণের টেস্টিংসল্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর।
আজকাল আমরা ঘরে তৈরি খাবারকেও সুস্বাদু করতে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু টেস্টিং সল্ট ব্যবহার না করে বিভিন্ন ভেষজ মশলা দিয়েও কিন্তু খাবারকে সুস্বাদু করা যায়।
উচ্চ সোডিয়াম যুক্ত খাবারঃ
- বনরুটি ,
- পাউরুটি,
- খিচুরি,
- পপকর্ণ (লবন সহ) ,
- মুড়ি,
- রুটি,
- করলা ভাজি,
- ঢেঁড়স
- টমেটো ভুনা,
- বীট শাক,
- পালং শাক,
- কলমি শাক,
- আলু ভর্তা,
- নোনা ইলিশ
- লইট্টা,
- চাপিলা,
- আচার (মিক্সড),
- আলুর চিপ্স,
- সয়াসস,
- বিস্কুট (বেকিং পাউডার দিয়ে তৈরি) ,
- পাবদা মাছ,
- মার্জারিন,
- মেয়োনেজ,
- চিজ কটেজ ,
- গুড়া দুধ,
- বেকিং পাউডার,
- বার্গার,
- ফ্রাই,
- পিজ্জা।
নিম্ন সোডিয়াম যুক্ত খাবারঃ
- বার্লি,
- ভূট্টা,
- চিড়া,
- চাল,
- খই,
- গম,
- আটা,
- ময়দা,
- ছোলার ডাল,
- ডাটা,
- সিম,
- বেগুন,
- বাঁধাকপি,
- গাজর,
- ফুলকপি,
- বরবটি ,
- ব্রকলি,শসা,
- সজনে,
- চালকুমড়া,
- করলা,
- দই,
- ঘোল,
- পেঁপে,
- মটরশুঁটি,
- পটল,
- লাউ
- কাঁচাকলা,
- মিষ্টিকুমড়া,
- লাল শাক,
- ডাটা শাক,
- কচু শাক।
যেহেতু লবন দেহের জন্য উপকারী হবে না অপকারী তা আমাদের গ্রহণ মাত্রার উপর নির্ভর করছে, তাই আমাদের উচিত প্রতিদিন পরিমাণমতো লবণ গ্রহণ করা ও বাইরের খাবার কিনে খাওয়ার আগে অবশ্যই সর্তক থাকা।
ঢাকা/এসএম