১১:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

সাশ্রয়ে লোডশেডিং, ব্যবহারে রিজার্ভে টান!

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ জুলাই ২০২২
  • / ৪১৯১ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: সোমবার (১৮ জুলাই) বিকেলে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহ সারা দেশের সব এলাকায় বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অন্তত এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে পরের সপ্তাহে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানো হবে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ থাকবে, ফিলিং স্টেশন সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকবে, বন্ধ থাকবে রাত আটটার পরে সব শপিংমল। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অফিসের সভাগুলো ভার্চুয়ালি করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, অফিসের কর্মঘণ্টা কমানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, মসজিদ-মন্দিরে নামাজ ও প্রার্থনার সময় ছাড়া বাকি সময় এসি বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হয়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিদ্যুৎ সংকটের নেপথ্যে কী?
 
মূলত শুরু থেকেই উচ্চ মূল্যের তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করায় এ খাতে লোকসানের বোঝা ভারি হচ্ছে। সরকার এ খাতে ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে  বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেড়ে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে বাড়তে শুরু করেছে তেলের দাম। বেশি দাম দিয়ে তেল কেনার জন্য বিদ্যুতখাতে বাড়াতে হয়েছে ভর্তুকির পরিমাণ।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসেই ভর্তুকি দেয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে বিদ্যুতখাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। ভর্তুকি না দেয়ায় পিডিপি বেসরকারি বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে বিল পরিশোধ করতে পারছে না। চলতি বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত বকেয়া পড়ে আছে বিদ্যুতবিল। এদিকে দেশে কমে গেছে জ্বালানি তেলের মজুত।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জানিয়েছে, তাদের কাছে এখন ৪০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুত রয়েছে, যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অপ্রতুল। তেলের মজুত বাড়াতে বিপিসির কাছে আমদানি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। বিপিসির তথ্য মোতাবেক, সারা দেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। এখন সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে ১৫২টি। জ্বালানির অভাবে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট কমে গেছে। অতিমাত্রায় গ্যাসনির্ভর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুসারে, দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতো। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে আসে ২২০-২৩০ ঘনফুট। ৭০ থেকে ৮০ ঘনফুট আমদানি করা হয় এলএনজি হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে ২৭০ থেকে ২৮০ ঘনফুটের বেশি সরকার দিতে পারছে না।

এদিকে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস দুটির দামই আকাশচুম্বী। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪১ ডলারের কাছাকাছি। আগে এই দাম ছিল মাত্র ৪ ডলার। অন্যদিকে ৭৭ ডলারের তেল কিনতে হচ্ছে ১২০ ডলার দিয়ে। অর্থাৎ সরকারকে আমদানিখাতে ব্যয় করতে হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি টাকা।

আমদানি কেন করছে না সরকার?
 

আমদানির জন্য সরকারকে গুণতে হবে বড় অঙ্কের ডলার। কিন্তু রিজার্ভের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যাবে, যথেষ্ট পরিমাণ আমদানি করার মতো নিরাপদ ডলার সরকারের হাতে নেই। বিগত দু’বছরের রেকর্ড ভেঙে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। আপতত দৃষ্টিতে ত্রিশের ঘরে রিজার্ভ থাকা নিরাপদ মনে হলেও, মূল্যস্ফীতির বাজারে তা যথেষ্ট নয়। এতে করে সরকারকে যেতে হচ্ছে কড়া হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করার মতো অবস্থাও সরকারের নেই। তাই জ্বালানি আমদানিতে ভাটা পড়েছে। ফলে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি দিতে পারছে না। অথচ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গত ১০ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে সরকার। অপখরচ, পাচার এবং অপরিকল্পিত উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব বিদ্যুৎ খাতের ওপরে কিছুটা পড়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে, ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টন জ্বালানি পোড়ায়, এসময়  দেশে ডিজেলের মোট ব্যবহার ছিল ৪৫ লাখ ৯৭ হাজার টন। বাংলাদেশ বর্তমানে জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৯১ থেকে ৯২ শতাংশ আমদানি করছে। বাকিটা স্থানীয়  গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যায়। বিপিসির তথ্য মতে, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে প্রতি মাসে তাদের প্রায় ৫৬০-৬৯৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৬-১৭টি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে।

বিপিডির তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের প্রায় ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে গ্যাস থেকে, ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল থেকে, ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ কয়লা থেকে, শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ জলবিদ্যুৎ থেকে, শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এবং ১০ শতাংশ আমদানি করা হয়।

সংকট কি কেবল বাংলাদেশেই?

সম্প্রতি জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় জানায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানী টোকিও ও এর আশপাশের এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়তে পারে। টোকিও এবং এর আশপাশের এলাকার লোকজনকে অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রয়োজন না হলে লাইট বন্ধ রাখা উচিত। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

ফ্রান্সের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীরা বলছেন, খরচ কমাতে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে তারা। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি ইলেকট্রিকিট ডি ফ্রান্স (ইডিএফ), ইউটিলিটি কোম্পানি ও পেট্রোলিয়াম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টোটাল এনার্জির প্রধান নির্বাহীরা শীতকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ ব্যয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানান। এক চিঠিতে কোম্পানিগুলো রাশিয়ান গ্যাসের চালান কমে আসার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্রান্সের লক্ষ্য শরতের শুরুতেই গ্যাস স্টোরেজ পূরণ করা। ফ্রান্সের গ্যাস স্টোরেজের বর্তমানে ৫৯ শতাংশ গ্যাস রয়েছে।

একই দশা অস্ট্রেলিয়ায়। ১৬ জুন জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলায় নিউ সাউথ ওয়েলসের বাসিন্দাদের সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাতি বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী ক্রিস বোয়েন। যতটা সম্ভব বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের অন্যতম কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানিকারক দেশ অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু গত মাস থেকে দেশটি ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। সেখানকার তিন-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ এখনো কয়লা ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে কয়লা সরবরাহে ব্যাঘাত, বেশ কয়েকটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিভ্রাট এবং বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশটি বেশ সংকটে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস স্থাপনা বন্ধ হওয়ার পরের সপ্তাহগুলোয়  ইউরোপ এবং এশিয়ায় গ্যাসের দাম ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত বছরের শুরু থেকে গ্যাসের দাম বাড়ছে, ইউরোপে তা ৭০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। জার্মান সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, গ্যাসের ঘাটতি লেহম্যান ব্রাদার্সের মতো বিপর্যয় ঘটাতে পারে। ব্যবসা এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ ঘাটতির অভাবনীয় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রটি। জার্মানিতে রাশিয়ান গ্যাস বহনকারী প্রধান উৎস নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন। গত ১১ জুলাই থেকে এটি সারাই কাজের জন্য ১০ দিন বন্ধ রাখা হয়েছে। মস্কো এটিকে আবার নাও খুলতে পারে এমন আশঙ্কা করছে জার্মানি।

দক্ষিণ এশিয়ায় সংকটের শুরুটা হয়েছে শ্রীলঙ্কার হাত ধরে। বর্তমানে দেশটিতে চলছে ভয়াবহ লোডশেডিং। দিনের সিংহভাগ সময় অন্ধকারে কাটাতে হচ্ছে দেশটির সাধারণ জনগণকে। সম্প্রতি দেশটির জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রী কাঞ্চনা উইজেসেকারা বলেন, শ্রীলঙ্কায় এখন প্রায় ৯ হাজার টন ডিজেল ও ৬ হাজার টন পেট্রোলের মজুত রয়েছে। আপাতত জ্বালানির কোনো চালান আসার কথা নেই। মজুত জ্বালানি দিয়ে কতদিন চলা যাবে, তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়া শ্রীলংকায় চলছে ব্যাপক জ্বালানি সংকট। কলম্বোয় স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘরে বসে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের।

সমাধান কী?

এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশু কোনো সমাধান দেয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। বিভ্রাট কমাতে ও সরবরাহ স্বাভাবিক করতে নির্ভর করতে হচ্ছে বিশ্ববাজারের ওপরে। যতদিন না জ্বালানিখাতে অস্থিরতা কমছে, ততদিন অবধি লোডশেডিংয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে দেশবাসীকে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান জ্বালানি সরবরাহের একটি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত লোড ব্যবস্থাপনা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারে। কর্তৃপক্ষের অন্য কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায়, লোড ব্যবস্থাপনাকেই গ্যাস ও বিদ্যুতের চলমান সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলার একমাত্র উপায় বলছেন তারা।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে, কেবল তখনই প্রকৃত চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নেয়া একমাত্র সমাধান।

কেবল জ্বালানি তেলের দাম কমা নয়, দেশের বিদ্যুতখাতে আনতে হবে বিপুল পরিবর্তন। পরিকল্পনাগুলোকে আরও গুছিয়ে আনতে হবে, কমাতে হবে আরাজকতা, দুর্নীতি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে ও সর্বোপরি দেশের জনগণকে হতে হবে সাশ্রয়ী- এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

চলতি বছরের মে মাসের হিসাব মতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ৮৯ হাজার ৪৮ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা হলেও, জ্বালানির অভাবে কমে যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে আপাতত বন্ধ রাখা হবে ডিজেল-চালিত কেন্দ্রগুলি। এতে করে দেশে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেবে। ঘাটতি সামাল দিতে দেশের জনগণকে সহ্য করতে হবে ১-২ ঘণ্টার প্রতিদিনকার লোডশেডিং।

ঢাকা/এসএ

শেয়ার করুন

x

সাশ্রয়ে লোডশেডিং, ব্যবহারে রিজার্ভে টান!

আপডেট: ১১:০০:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ জুলাই ২০২২

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: সোমবার (১৮ জুলাই) বিকেলে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহ সারা দেশের সব এলাকায় বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অন্তত এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে পরের সপ্তাহে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়ানো বা কমানো হবে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ থাকবে, ফিলিং স্টেশন সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকবে, বন্ধ থাকবে রাত আটটার পরে সব শপিংমল। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অফিসের সভাগুলো ভার্চুয়ালি করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, অফিসের কর্মঘণ্টা কমানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, মসজিদ-মন্দিরে নামাজ ও প্রার্থনার সময় ছাড়া বাকি সময় এসি বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হয়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিদ্যুৎ সংকটের নেপথ্যে কী?
 
মূলত শুরু থেকেই উচ্চ মূল্যের তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করায় এ খাতে লোকসানের বোঝা ভারি হচ্ছে। সরকার এ খাতে ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে  বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেড়ে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে বাড়তে শুরু করেছে তেলের দাম। বেশি দাম দিয়ে তেল কেনার জন্য বিদ্যুতখাতে বাড়াতে হয়েছে ভর্তুকির পরিমাণ।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। তবে ২০২১-২২ অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসেই ভর্তুকি দেয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে বিদ্যুতখাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। ভর্তুকি না দেয়ায় পিডিপি বেসরকারি বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে বিল পরিশোধ করতে পারছে না। চলতি বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত বকেয়া পড়ে আছে বিদ্যুতবিল। এদিকে দেশে কমে গেছে জ্বালানি তেলের মজুত।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জানিয়েছে, তাদের কাছে এখন ৪০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুত রয়েছে, যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অপ্রতুল। তেলের মজুত বাড়াতে বিপিসির কাছে আমদানি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। বিপিসির তথ্য মোতাবেক, সারা দেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। এখন সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে ১৫২টি। জ্বালানির অভাবে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট কমে গেছে। অতিমাত্রায় গ্যাসনির্ভর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুসারে, দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতো। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে আসে ২২০-২৩০ ঘনফুট। ৭০ থেকে ৮০ ঘনফুট আমদানি করা হয় এলএনজি হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে ২৭০ থেকে ২৮০ ঘনফুটের বেশি সরকার দিতে পারছে না।

এদিকে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস দুটির দামই আকাশচুম্বী। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৪১ ডলারের কাছাকাছি। আগে এই দাম ছিল মাত্র ৪ ডলার। অন্যদিকে ৭৭ ডলারের তেল কিনতে হচ্ছে ১২০ ডলার দিয়ে। অর্থাৎ সরকারকে আমদানিখাতে ব্যয় করতে হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি টাকা।

আমদানি কেন করছে না সরকার?
 

আমদানির জন্য সরকারকে গুণতে হবে বড় অঙ্কের ডলার। কিন্তু রিজার্ভের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যাবে, যথেষ্ট পরিমাণ আমদানি করার মতো নিরাপদ ডলার সরকারের হাতে নেই। বিগত দু’বছরের রেকর্ড ভেঙে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। আপতত দৃষ্টিতে ত্রিশের ঘরে রিজার্ভ থাকা নিরাপদ মনে হলেও, মূল্যস্ফীতির বাজারে তা যথেষ্ট নয়। এতে করে সরকারকে যেতে হচ্ছে কড়া হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করার মতো অবস্থাও সরকারের নেই। তাই জ্বালানি আমদানিতে ভাটা পড়েছে। ফলে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে জ্বালানি দিতে পারছে না। অথচ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গত ১০ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে সরকার। অপখরচ, পাচার এবং অপরিকল্পিত উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব বিদ্যুৎ খাতের ওপরে কিছুটা পড়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে, ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টন জ্বালানি পোড়ায়, এসময়  দেশে ডিজেলের মোট ব্যবহার ছিল ৪৫ লাখ ৯৭ হাজার টন। বাংলাদেশ বর্তমানে জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৯১ থেকে ৯২ শতাংশ আমদানি করছে। বাকিটা স্থানীয়  গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যায়। বিপিসির তথ্য মতে, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে প্রতি মাসে তাদের প্রায় ৫৬০-৬৯৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৬-১৭টি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে।

বিপিডির তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের প্রায় ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে গ্যাস থেকে, ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল থেকে, ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ কয়লা থেকে, শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ জলবিদ্যুৎ থেকে, শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এবং ১০ শতাংশ আমদানি করা হয়।

সংকট কি কেবল বাংলাদেশেই?

সম্প্রতি জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় জানায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানী টোকিও ও এর আশপাশের এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়তে পারে। টোকিও এবং এর আশপাশের এলাকার লোকজনকে অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রয়োজন না হলে লাইট বন্ধ রাখা উচিত। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

ফ্রান্সের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীরা বলছেন, খরচ কমাতে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে তারা। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি ইলেকট্রিকিট ডি ফ্রান্স (ইডিএফ), ইউটিলিটি কোম্পানি ও পেট্রোলিয়াম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টোটাল এনার্জির প্রধান নির্বাহীরা শীতকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ ব্যয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানান। এক চিঠিতে কোম্পানিগুলো রাশিয়ান গ্যাসের চালান কমে আসার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্রান্সের লক্ষ্য শরতের শুরুতেই গ্যাস স্টোরেজ পূরণ করা। ফ্রান্সের গ্যাস স্টোরেজের বর্তমানে ৫৯ শতাংশ গ্যাস রয়েছে।

একই দশা অস্ট্রেলিয়ায়। ১৬ জুন জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলায় নিউ সাউথ ওয়েলসের বাসিন্দাদের সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাতি বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী ক্রিস বোয়েন। যতটা সম্ভব বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশ্বের অন্যতম কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানিকারক দেশ অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু গত মাস থেকে দেশটি ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। সেখানকার তিন-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ এখনো কয়লা ব্যবহার করে উৎপাদিত হয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে কয়লা সরবরাহে ব্যাঘাত, বেশ কয়েকটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিভ্রাট এবং বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে দেশটি বেশ সংকটে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস স্থাপনা বন্ধ হওয়ার পরের সপ্তাহগুলোয়  ইউরোপ এবং এশিয়ায় গ্যাসের দাম ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত বছরের শুরু থেকে গ্যাসের দাম বাড়ছে, ইউরোপে তা ৭০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। জার্মান সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, গ্যাসের ঘাটতি লেহম্যান ব্রাদার্সের মতো বিপর্যয় ঘটাতে পারে। ব্যবসা এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ ঘাটতির অভাবনীয় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রটি। জার্মানিতে রাশিয়ান গ্যাস বহনকারী প্রধান উৎস নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন। গত ১১ জুলাই থেকে এটি সারাই কাজের জন্য ১০ দিন বন্ধ রাখা হয়েছে। মস্কো এটিকে আবার নাও খুলতে পারে এমন আশঙ্কা করছে জার্মানি।

দক্ষিণ এশিয়ায় সংকটের শুরুটা হয়েছে শ্রীলঙ্কার হাত ধরে। বর্তমানে দেশটিতে চলছে ভয়াবহ লোডশেডিং। দিনের সিংহভাগ সময় অন্ধকারে কাটাতে হচ্ছে দেশটির সাধারণ জনগণকে। সম্প্রতি দেশটির জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রী কাঞ্চনা উইজেসেকারা বলেন, শ্রীলঙ্কায় এখন প্রায় ৯ হাজার টন ডিজেল ও ৬ হাজার টন পেট্রোলের মজুত রয়েছে। আপাতত জ্বালানির কোনো চালান আসার কথা নেই। মজুত জ্বালানি দিয়ে কতদিন চলা যাবে, তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়া শ্রীলংকায় চলছে ব্যাপক জ্বালানি সংকট। কলম্বোয় স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘরে বসে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের।

সমাধান কী?

এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশু কোনো সমাধান দেয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। বিভ্রাট কমাতে ও সরবরাহ স্বাভাবিক করতে নির্ভর করতে হচ্ছে বিশ্ববাজারের ওপরে। যতদিন না জ্বালানিখাতে অস্থিরতা কমছে, ততদিন অবধি লোডশেডিংয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে দেশবাসীকে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান জ্বালানি সরবরাহের একটি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত লোড ব্যবস্থাপনা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পারে। কর্তৃপক্ষের অন্য কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায়, লোড ব্যবস্থাপনাকেই গ্যাস ও বিদ্যুতের চলমান সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা মোকাবিলার একমাত্র উপায় বলছেন তারা।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমলে, কেবল তখনই প্রকৃত চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নেয়া একমাত্র সমাধান।

কেবল জ্বালানি তেলের দাম কমা নয়, দেশের বিদ্যুতখাতে আনতে হবে বিপুল পরিবর্তন। পরিকল্পনাগুলোকে আরও গুছিয়ে আনতে হবে, কমাতে হবে আরাজকতা, দুর্নীতি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে ও সর্বোপরি দেশের জনগণকে হতে হবে সাশ্রয়ী- এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

চলতি বছরের মে মাসের হিসাব মতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ৮৯ হাজার ৪৮ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা হলেও, জ্বালানির অভাবে কমে যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে আপাতত বন্ধ রাখা হবে ডিজেল-চালিত কেন্দ্রগুলি। এতে করে দেশে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেবে। ঘাটতি সামাল দিতে দেশের জনগণকে সহ্য করতে হবে ১-২ ঘণ্টার প্রতিদিনকার লোডশেডিং।

ঢাকা/এসএ