০৫:১৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

সুদহারের সিলিং নির্ধারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্তরায়: এবিবি

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৩:৫১:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অগাস্ট ২০২১
  • / ১০৩৭৬ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকঋণ ও আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া যায় না। এর আগে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এবার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে আমানতের সুদহার সমন্বয়ের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে মেয়াদি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির হারের নিচে নামানো যাবে না বলে নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। নির্দেশনাটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) পক্ষ থেকে গতকাল এ বক্তব্য তুলে ধরা হয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আমানতের সুদের যে সর্বনিম্ন হার বেঁধে দেয়া হয়েছে, আপাতত সেটি পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

অলস তারল্যের জোয়ারে ব্যাংক আমানতের সুদহার নেমে এসেছিল ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বেশির ভাগ বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংক মেয়াদি আমানতের সুদহার নামিয়ে এনেছিল ১-৪ শতাংশের ঘরে। এ অবস্থায় মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দিয়ে গত ৮ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদহার তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হতে পারবে না।

গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) দেশে মূল্যস্ফীতির গড় ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সে হিসেবে দেশের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংককে মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমানতের সুদহার বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে বলে মনে করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা। নিজেদের সেই শঙ্কার কথাই গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় তুলে ধরেছেন তারা।

প্রতি তিন মাস পর দেশের সবক’টি তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বা এমডির সঙ্গে বৈঠকে বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে চলমান মহামারীর কারণে এবার ছয় মাস পর গতকাল ভার্চুয়াল মাধ্যমে এ সভার আয়োজন করা হয়। এর আগে সর্বশেষ সভা হয়েছিল চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি। সভায় ব্যাংক খাতের সুশাসন, চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি, দ্বিতীয় দফায় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ, নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে স্টার্টআপ তহবিল গঠন, ল্যাপটপ-মোবাইল-কম্পিউটার কিনতে ঋণের শর্ত শিথিল, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিটের সর্বোচ্চ ব্যবহার, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অর্থ পৌঁছানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন নিয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ ডেপুটি গভর্নর, সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকরা সভায় অংশ নেন। এবিবির চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার এবং এবিবির সাধারণ সম্পাদক ও দ্য সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন সভায় নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রায় সব ব্যাংকেরই শীর্ষ নির্বাহীরা সভায় অংশ নিলেও নিজেদের মতামত জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন সাত-আটজন।

যদিও আমানতের সর্বনিম্ন সুদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের মূল্যস্ফীতি, মুদ্রানীতিসহ অর্থনীতির নানা দিক পর্যালোচনা করে আমানতের সুদহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমানতকারীদের অর্থ থেকেই ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা চরমভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এজন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আপাতত এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, মুদ্রাবাজারে অতিরিক্ত তারল্যের যে সংকট আছে, এটি কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর ও এসএলআর বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারত। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও বাড়ালে মুদ্রাবাজারে তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেত। ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কাটাতে এর আগে সিআরআর, এসএলআর ও এডিআরে বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছিল। আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে না দিয়ে ছাড়গুলো তুলে নেয়া ছিল উৎকৃষ্ট বিকল্প। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ করে কেন আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়ার পথে গেল, সেটি বোধগম্য নয়।

দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের উচ্চপ্রবৃদ্ধি হচ্ছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। বিপরীতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্নে। এতে মুদ্রাবাজারে সৃষ্টি হয়েছে অলস তারল্যের পাহাড়। গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে একেবারে অলস পড়ে ছিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ অলস তারল্যের নেতিবাচক নানা প্রভাব এরই মধ্যে অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমেছে বেসরকারি ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার। কলমানির সুদহারও নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। এ অবস্থায় বিনিয়োগের বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা ঢালতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। মুদ্রাবাজারে সৃষ্ট এ অভূতপূর্ব পরিস্থিতি সামাল দিতে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩১ মার্চ (বার্ষিক ভিত্তিতে) পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত আমানতে সবচেয়ে বেশি ২২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। যদিও আমানতের এ উচ্চপ্রবৃদ্ধির বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে এ ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ১ শতাংশের বেশি হয়নি।

আমানতে উচ্চপ্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে দেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংকগুলোও। যদিও এসব ব্যাংকের ঋণে প্রবৃদ্ধির বদলে উল্টো সংকোচন হয়েছে। তথ্য অনুয়ায়ী, মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিদেশী ব্যাংকগুলোর আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে এ শ্রেণীর ব্যাংকগুলোর ঋণ সংকুচিত হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১১ দশমিক ৫ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আমানত ও ঋণ প্রবৃদ্ধির এ অসামঞ্জস্যতাই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের স্তূপ তৈরিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অতিরিক্ত তারল্যের কুফল থেকে মুদ্রাবাজারকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দুই হাতিয়ার রিভার্স রেপো ও স্বল্পমেয়াদি বিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে রিভার্স রেপোর বিকল্প হাতিয়ার হিসেবে স্বল্পমেয়াদি বিলকে কাজে লাগাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাসব্যাপী নিলামসূচি ঘোষণা করেছে। ৯ আগস্ট ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি বিলের নিলাম আয়োজনের পর গতকাল ৩০ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে অলস তারল্য তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ট্যাগঃ

শেয়ার করুন

x

সুদহারের সিলিং নির্ধারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্তরায়: এবিবি

আপডেট: ০৩:৫১:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অগাস্ট ২০২১

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকঋণ ও আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া যায় না। এর আগে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এবার মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে আমানতের সুদহার সমন্বয়ের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে মেয়াদি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির হারের নিচে নামানো যাবে না বলে নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। নির্দেশনাটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) পক্ষ থেকে গতকাল এ বক্তব্য তুলে ধরা হয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আমানতের সুদের যে সর্বনিম্ন হার বেঁধে দেয়া হয়েছে, আপাতত সেটি পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

অলস তারল্যের জোয়ারে ব্যাংক আমানতের সুদহার নেমে এসেছিল ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। বেশির ভাগ বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংক মেয়াদি আমানতের সুদহার নামিয়ে এনেছিল ১-৪ শতাংশের ঘরে। এ অবস্থায় মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দিয়ে গত ৮ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদহার তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হতে পারবে না।

গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) দেশে মূল্যস্ফীতির গড় ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সে হিসেবে দেশের অর্ধেকের বেশি বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংককে মেয়াদি আমানতের সুদহার বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমানতের সুদহার বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে বলে মনে করছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা। নিজেদের সেই শঙ্কার কথাই গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সভায় তুলে ধরেছেন তারা।

প্রতি তিন মাস পর দেশের সবক’টি তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বা এমডির সঙ্গে বৈঠকে বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে চলমান মহামারীর কারণে এবার ছয় মাস পর গতকাল ভার্চুয়াল মাধ্যমে এ সভার আয়োজন করা হয়। এর আগে সর্বশেষ সভা হয়েছিল চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি। সভায় ব্যাংক খাতের সুশাসন, চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি, দ্বিতীয় দফায় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ, নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে স্টার্টআপ তহবিল গঠন, ল্যাপটপ-মোবাইল-কম্পিউটার কিনতে ঋণের শর্ত শিথিল, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিটের সর্বোচ্চ ব্যবহার, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অর্থ পৌঁছানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়া সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন নিয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ ডেপুটি গভর্নর, সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকরা সভায় অংশ নেন। এবিবির চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার এবং এবিবির সাধারণ সম্পাদক ও দ্য সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন সভায় নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রায় সব ব্যাংকেরই শীর্ষ নির্বাহীরা সভায় অংশ নিলেও নিজেদের মতামত জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন সাত-আটজন।

যদিও আমানতের সর্বনিম্ন সুদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের মূল্যস্ফীতি, মুদ্রানীতিসহ অর্থনীতির নানা দিক পর্যালোচনা করে আমানতের সুদহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমানতকারীদের অর্থ থেকেই ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা চরমভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এজন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আপাতত এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, মুদ্রাবাজারে অতিরিক্ত তারল্যের যে সংকট আছে, এটি কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর ও এসএলআর বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারত। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও বাড়ালে মুদ্রাবাজারে তারল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেত। ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কাটাতে এর আগে সিআরআর, এসএলআর ও এডিআরে বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছিল। আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে না দিয়ে ছাড়গুলো তুলে নেয়া ছিল উৎকৃষ্ট বিকল্প। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ করে কেন আমানতের সুদহার বেঁধে দেয়ার পথে গেল, সেটি বোধগম্য নয়।

দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের উচ্চপ্রবৃদ্ধি হচ্ছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। বিপরীতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্নে। এতে মুদ্রাবাজারে সৃষ্টি হয়েছে অলস তারল্যের পাহাড়। গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে একেবারে অলস পড়ে ছিল প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ অলস তারল্যের নেতিবাচক নানা প্রভাব এরই মধ্যে অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ইতিহাসের সর্বনিম্নে নেমেছে বেসরকারি ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার। কলমানির সুদহারও নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। এ অবস্থায় বিনিয়োগের বিকল্প উৎস খুঁজতে গিয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা ঢালতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। মুদ্রাবাজারে সৃষ্ট এ অভূতপূর্ব পরিস্থিতি সামাল দিতে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩১ মার্চ (বার্ষিক ভিত্তিতে) পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত আমানতে সবচেয়ে বেশি ২২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। যদিও আমানতের এ উচ্চপ্রবৃদ্ধির বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে এ ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ১ শতাংশের বেশি হয়নি।

আমানতে উচ্চপ্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে দেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংকগুলোও। যদিও এসব ব্যাংকের ঋণে প্রবৃদ্ধির বদলে উল্টো সংকোচন হয়েছে। তথ্য অনুয়ায়ী, মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বিদেশী ব্যাংকগুলোর আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে এ শ্রেণীর ব্যাংকগুলোর ঋণ সংকুচিত হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১১ দশমিক ৫ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আমানত ও ঋণ প্রবৃদ্ধির এ অসামঞ্জস্যতাই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের স্তূপ তৈরিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অতিরিক্ত তারল্যের কুফল থেকে মুদ্রাবাজারকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দুই হাতিয়ার রিভার্স রেপো ও স্বল্পমেয়াদি বিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে রিভার্স রেপোর বিকল্প হাতিয়ার হিসেবে স্বল্পমেয়াদি বিলকে কাজে লাগাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাসব্যাপী নিলামসূচি ঘোষণা করেছে। ৯ আগস্ট ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি বিলের নিলাম আয়োজনের পর গতকাল ৩০ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে অলস তারল্য তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।