০৭:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
বাড়ছে গুজব, কমছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা

সুশাসনের অভাবে পুঁজিবাজারে প্রকট হচ্ছে তারল্য সঙ্কট

বিশেষ প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০১:১৪:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
  • / ৪২৮১ বার দেখা হয়েছে

পুঁজিবাজারে প্রকট আকার ধারণ করেছে তারল্য সঙ্কট। পরিণতিতে মাসের পর মাস টানা দরপতনের বৃত্তে আটকে গেছে র। ফলে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বাড়ছে আহাজারী। ঈদের আগে প্রায় আড়াই মাসের লাগাতার দরপতনে লাখ কোটি টাকার বেশি বাজার মূলধন কমে যায়। ফলে পুঁজিবাজারের এমন দীর্ঘ পতনের প্রধান কারণ চরম পর্যায়ের তারল্য সংকট।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেশ কয়েকটি কারণে বাজারের এ মন্দাবস্থা। চলতি মাসের জানুয়ারিতে ‘ফ্লোরপ্রাইস’ প্রত্যাহারের পর বাজারে সূচক ও লেনদেন দুই-ই বাড়তে থাকে। কিন্তু এ সময়ে ভালো কোম্পানির চেয়ে মন্দ কোম্পানির শেয়ারদরই বেশি বেড়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এমনকি কারসাজি করে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদরও বাড়ানো হয়েছে। এখন এসব কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হচ্ছে। এছাড়া বাজারে তারল্যসংকট রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা গুজব। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে একটি চক্র বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এসব কারণে অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন।

তারা আরও বলেছেন, আমরা শুধু বাজারের সূচক নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমাদের বাজারের লং টার্ম (দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা) প্রবলেম কী? এটা নিয়ে কি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে? শেয়ার বাজারে ২০১০-এ বড় ধসের পর এখন ২০২৪ সাল। দীর্ঘ এ সময়ে বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে উল্লেখযোগ্য কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? গত এক যুগে কয়টা ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। ভালো কোম্পানি বাজারে না থাকলে বাজার টিকে থাকবে কীভাবে?

অবশ্য কীভাবে চলতি দর পতন বন্ধ করে শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী করা যাবে এবং কীভাবে বিনিয়োগকারীদের আবার ফিরিয়ে আনা যাবে– এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শেয়ারবাজারের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের ডেকে গতকাল বৈঠক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে স্টেকহোল্ডারদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, দর পতন রুখতে সহজ কোনো সমাধান তাদের জানা নেই।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক স্টেকহোল্ডার জানান, শুরুতেই বিএসইসির কমিশনার জানতে চান– দরপতন কেন হচ্ছে এবং কীভাবে দরপতন বন্ধ করা যাবে। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডিবিএ নেতারা স্পষ্ট করে বলেন, একক কোনো কারণ দিয়ে দর পতনকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ বাজারে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ আসছে না, বরং লোকসান দিয়ে হলেও অনেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: এক্সিম ব্যাংকের ডিভিডেন্ড ঘোষণা

জবাবে নেতৃবৃন্দ বলেন, বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে ভালো কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠছে। শেয়ারবাজারে কারসাজি হচ্ছে এবং দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কারসাজি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি কোম্পানিগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো শেয়ার হিসেবে বিবেচিত হলেও গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি সরকারি কোম্পানিতে সরকারের ঋণকে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই শেয়ারে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে এসব কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় কমেছে। সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগকারীরা এ বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন এবং তারা বাজার ছাড়ছেন।

তারা আরও বলেন, যথেচ্ছ মার্জিন ঋণও শেয়ারবাজারে বড় সংকট তৈরি করছে। শেয়ারবাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন মার্জিন ঋণ ওই ঊর্ধ্বমুখী ধারাকে যতটা বাড়িয়ে দেয়, পতনের সময় এর বিরূপ প্রভাব ফেলে আরও বেশি। দর পতনের সময় মার্জিন ঋণে শেয়ার কেনা বিনিয়োগকারীরা ‘ফোর্স সেল’-এ পড়ে বিনিয়োগের পুরোটাই হারিয়ে ফেলেন। বহু বছর ধরে মার্জিন ঋণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্টেকহোল্ডাররা  বলেন, বর্তমান কমিশনের চার বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। দীর্ঘ এই চার বছরে এ কমিশন এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, যার কারণে বিনিয়োগকারীরা এ বাজারে বিনিয়োগে আস্থা পান। উল্টো অনেকে মনে করেন, তাদের বাজারের ভবিষ্যৎ বিষয়ে উচ্চাশা দিয়ে ডেকে এনে প্রতারণা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে ৩৫ কোম্পানি

বিএসইসির পক্ষ থেকে সমাধানের পথ কী জানতে চাইলে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, চলতি সংকটের রাতারাতি সমাধান নেই। বললেই কেউ বিনিয়োগ নিয়ে আসবে না। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি আনতে হবে এবং শেয়ারবাজারে কারসাজি প্রতিরোধে কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এমন আস্থা পাবেন যে, কেউ কারসাজি বা প্রতারণা করে তাদের টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে না।

স্টেকহোল্ডারদের এমন অভিমতের পর বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত ব্রোকার ডিলারদের বিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানান বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

তিনি জানান, দর পতন রুখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও অনেক ব্যাংক এখনও তা নেয়নি। আবার কোনো কোনো ব্যাংক আংশিক সুবিধা নিলেও পুরোপুরি বিনিয়োগ করেনি। এসব ব্যাংককে প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিয়ে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবস্থাপনাধীন মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাজারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) একাধিক নেতৃবৃন্দ জানান, সুদ হার বেড়েছে, ফলে মানুষ শেয়ার বাজারে না এসে ব্যাংকে যাচ্ছে। তারা বলেন, ট্রেজারি বিল, বন্ডে বিনিয়োগ করলে ১১-১২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। তাহলে ২-৩ শতাংশ রিটার্নের জন্য কেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবে মানুষ?  এছাড়া আমাদের বাজারে ভালো কোম্পানি খুবই কম। ৪০-৫০টা ভালো স্টক দিয়ে তো বাজার সাসটেইন করা মুশকিল। রেগুলেটর যদি ইনডেক্স (সূচক) নিয়ে থাকে তাহলে তো হবে না। আমাদের মার্কেটের লং টার্ম প্রবলেম কী? এ বিষয়ে রেগুলেটরকে নজর দিতে হবে।

তারা জানান, দেশে ভালো কোম্পানির ১০ শতাংশও বাজারে তালিকাভুক্ত নেই। আবার তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির আয় ভালো কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের সেভাবে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এছাড়া, আইপিওতে আসার সময় একটি কোম্পানি যে আয় দেখায়, বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর তার সেই আয় কমে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা হতাশ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বিশিষ্ট পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, গত কিছু দিনে অনেক মন্দ কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। এমনকি বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ারদর এখন কমছে। ফলে বাজারে এ দরপতন। এছাড়া তারল্যসংকট রয়েছে বাজারে। তবে বাজার নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সূচক কমেছে, আবার বাড়বেও।

অবশ্য বিএসইসির কর্তা-ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে বলে আসছে, আমাদের শেয়ার বাজারে কোনো সমস্যা নেই। মানি মার্কেটে এফডিআরের সুদের হার বেড়েছে। ফলে কিছু টাকা শেয়ার বাজার থেকে মানি মার্কেটে চলে যাচ্ছে। তবে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়লেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন প্ল্যাটফরমে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কিছু ভিত্তিহীন গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়িয়ে কারসাজি চক্র বিনিয়োগকারীদের ভয় দেখাচ্ছে। তাদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হবে।

ঢাকা/এইচকে

 

শেয়ার করুন

x
English Version

বাড়ছে গুজব, কমছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা

সুশাসনের অভাবে পুঁজিবাজারে প্রকট হচ্ছে তারল্য সঙ্কট

আপডেট: ০১:১৪:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

পুঁজিবাজারে প্রকট আকার ধারণ করেছে তারল্য সঙ্কট। পরিণতিতে মাসের পর মাস টানা দরপতনের বৃত্তে আটকে গেছে র। ফলে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বাড়ছে আহাজারী। ঈদের আগে প্রায় আড়াই মাসের লাগাতার দরপতনে লাখ কোটি টাকার বেশি বাজার মূলধন কমে যায়। ফলে পুঁজিবাজারের এমন দীর্ঘ পতনের প্রধান কারণ চরম পর্যায়ের তারল্য সংকট।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেশ কয়েকটি কারণে বাজারের এ মন্দাবস্থা। চলতি মাসের জানুয়ারিতে ‘ফ্লোরপ্রাইস’ প্রত্যাহারের পর বাজারে সূচক ও লেনদেন দুই-ই বাড়তে থাকে। কিন্তু এ সময়ে ভালো কোম্পানির চেয়ে মন্দ কোম্পানির শেয়ারদরই বেশি বেড়েছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এমনকি কারসাজি করে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারদরও বাড়ানো হয়েছে। এখন এসব কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হচ্ছে। এছাড়া বাজারে তারল্যসংকট রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা গুজব। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে একটি চক্র বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এসব কারণে অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন।

তারা আরও বলেছেন, আমরা শুধু বাজারের সূচক নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমাদের বাজারের লং টার্ম (দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা) প্রবলেম কী? এটা নিয়ে কি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে? শেয়ার বাজারে ২০১০-এ বড় ধসের পর এখন ২০২৪ সাল। দীর্ঘ এ সময়ে বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে উল্লেখযোগ্য কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? গত এক যুগে কয়টা ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। ভালো কোম্পানি বাজারে না থাকলে বাজার টিকে থাকবে কীভাবে?

অবশ্য কীভাবে চলতি দর পতন বন্ধ করে শেয়ারদর ঊর্ধ্বমুখী করা যাবে এবং কীভাবে বিনিয়োগকারীদের আবার ফিরিয়ে আনা যাবে– এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শেয়ারবাজারের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের ডেকে গতকাল বৈঠক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে স্টেকহোল্ডারদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, দর পতন রুখতে সহজ কোনো সমাধান তাদের জানা নেই।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক স্টেকহোল্ডার জানান, শুরুতেই বিএসইসির কমিশনার জানতে চান– দরপতন কেন হচ্ছে এবং কীভাবে দরপতন বন্ধ করা যাবে। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডিবিএ নেতারা স্পষ্ট করে বলেন, একক কোনো কারণ দিয়ে দর পতনকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ বাজারে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ আসছে না, বরং লোকসান দিয়ে হলেও অনেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: এক্সিম ব্যাংকের ডিভিডেন্ড ঘোষণা

জবাবে নেতৃবৃন্দ বলেন, বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে ভালো কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে, সেগুলোর মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠছে। শেয়ারবাজারে কারসাজি হচ্ছে এবং দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কারসাজি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকারি কোম্পানিগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো শেয়ার হিসেবে বিবেচিত হলেও গত দুই বছরে বেশ কয়েকটি সরকারি কোম্পানিতে সরকারের ঋণকে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই শেয়ারে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে এসব কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় কমেছে। সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগকারীরা এ বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন এবং তারা বাজার ছাড়ছেন।

তারা আরও বলেন, যথেচ্ছ মার্জিন ঋণও শেয়ারবাজারে বড় সংকট তৈরি করছে। শেয়ারবাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন মার্জিন ঋণ ওই ঊর্ধ্বমুখী ধারাকে যতটা বাড়িয়ে দেয়, পতনের সময় এর বিরূপ প্রভাব ফেলে আরও বেশি। দর পতনের সময় মার্জিন ঋণে শেয়ার কেনা বিনিয়োগকারীরা ‘ফোর্স সেল’-এ পড়ে বিনিয়োগের পুরোটাই হারিয়ে ফেলেন। বহু বছর ধরে মার্জিন ঋণকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্টেকহোল্ডাররা  বলেন, বর্তমান কমিশনের চার বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। দীর্ঘ এই চার বছরে এ কমিশন এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি, যার কারণে বিনিয়োগকারীরা এ বাজারে বিনিয়োগে আস্থা পান। উল্টো অনেকে মনে করেন, তাদের বাজারের ভবিষ্যৎ বিষয়ে উচ্চাশা দিয়ে ডেকে এনে প্রতারণা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে ৩৫ কোম্পানি

বিএসইসির পক্ষ থেকে সমাধানের পথ কী জানতে চাইলে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, চলতি সংকটের রাতারাতি সমাধান নেই। বললেই কেউ বিনিয়োগ নিয়ে আসবে না। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি আনতে হবে এবং শেয়ারবাজারে কারসাজি প্রতিরোধে কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা এমন আস্থা পাবেন যে, কেউ কারসাজি বা প্রতারণা করে তাদের টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে না।

স্টেকহোল্ডারদের এমন অভিমতের পর বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত ব্রোকার ডিলারদের বিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানান বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

তিনি জানান, দর পতন রুখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিশেষ তারল্য সহায়তা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলেও অনেক ব্যাংক এখনও তা নেয়নি। আবার কোনো কোনো ব্যাংক আংশিক সুবিধা নিলেও পুরোপুরি বিনিয়োগ করেনি। এসব ব্যাংককে প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিয়ে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবস্থাপনাধীন মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাজারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) একাধিক নেতৃবৃন্দ জানান, সুদ হার বেড়েছে, ফলে মানুষ শেয়ার বাজারে না এসে ব্যাংকে যাচ্ছে। তারা বলেন, ট্রেজারি বিল, বন্ডে বিনিয়োগ করলে ১১-১২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। তাহলে ২-৩ শতাংশ রিটার্নের জন্য কেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবে মানুষ?  এছাড়া আমাদের বাজারে ভালো কোম্পানি খুবই কম। ৪০-৫০টা ভালো স্টক দিয়ে তো বাজার সাসটেইন করা মুশকিল। রেগুলেটর যদি ইনডেক্স (সূচক) নিয়ে থাকে তাহলে তো হবে না। আমাদের মার্কেটের লং টার্ম প্রবলেম কী? এ বিষয়ে রেগুলেটরকে নজর দিতে হবে।

তারা জানান, দেশে ভালো কোম্পানির ১০ শতাংশও বাজারে তালিকাভুক্ত নেই। আবার তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির আয় ভালো কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের সেভাবে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এছাড়া, আইপিওতে আসার সময় একটি কোম্পানি যে আয় দেখায়, বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর তার সেই আয় কমে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা হতাশ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বিশিষ্ট পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, গত কিছু দিনে অনেক মন্দ কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। এমনকি বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ারদর এখন কমছে। ফলে বাজারে এ দরপতন। এছাড়া তারল্যসংকট রয়েছে বাজারে। তবে বাজার নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সূচক কমেছে, আবার বাড়বেও।

অবশ্য বিএসইসির কর্তা-ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে বলে আসছে, আমাদের শেয়ার বাজারে কোনো সমস্যা নেই। মানি মার্কেটে এফডিআরের সুদের হার বেড়েছে। ফলে কিছু টাকা শেয়ার বাজার থেকে মানি মার্কেটে চলে যাচ্ছে। তবে রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়লেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন প্ল্যাটফরমে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন বিষয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কিছু ভিত্তিহীন গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়িয়ে কারসাজি চক্র বিনিয়োগকারীদের ভয় দেখাচ্ছে। তাদেরকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হবে।

ঢাকা/এইচকে