২০২৩-২৪ বাজেটে আয়করে আসতে পারে যেসব প্রস্তাব

- আপডেট: ১১:২৯:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩১ মে ২০২৩
- / ১০৫৫৮ বার দেখা হয়েছে
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১ জুন) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন। আগামী ২৫ জুন সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পাস হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে সম্ভাব্য বাজেটের আয়কর হবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা আর কর বহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক থেকে এ রাজস্ব আদায় হবে। জানা গেছে, নতুন বাজেটে দেড় লাখ কোটি টাকা আয়কর হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করছে রাজস্ব বোর্ড। এরই ধারাবাহিকতা করমুক্ত আয়সীমা ও কর জাল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বাড়তে পারে করমুক্ত আয়সীমা। সেটা সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। চলতি অর্থবছর করমুক্ত আয়সীমা ছিল তিন লাখ টাকা। তিন লাখের বেশি থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে পাঁচ শতাংশ কর রয়েছে। ১০ লাখের বেশি থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে ১০ শতাংশ, ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে ১৫ শতাংশ, ৫০ লাখ টাকা আয়ে ২০ শতাংশ এবং ৫০ লাখের বেশি টাকা আয়ে ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। নারী ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। প্রতিবন্ধী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এ সীমা যথাক্রমে সাড়ে ৪ লাখ ও ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, করজাল বাড়ানো ও করের আওতা বাড়ানোয় বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে এবারের বাজেটে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ালে রাজস্ব কিছুটা কমবে, তবে অন্য খাত থেকে ঘাটতি পূরণে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে রাজস্ব বোর্ড।
এছাড়া ধনী করদাতাদের আয়করের ওপর এখন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ বিদ্যমান। ব্যক্তি করদাতার সম্পদসীমা ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে থাকলে তাকে ২০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। আর ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদের ওপর ৩০ শতাংশ এবং ৫০ কোটি টাকার ওপরে সম্পদের জন্য সারচার্জ দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। এছাড়া তিন থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ থাকলে, নিজ নামে একাধিক গাড়ি থাকলে বা সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮ হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনের আবাসিক সম্পত্তি থাকলে ন্যূনতম ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। বাজেটে বিদ্যমান সারচার্জ ৫ থেকে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ লাইনের ওপর জোর দিয়ে সরকার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত- উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য করপোরেট করের হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য করপোরেট করের হার নামতে পারে ২৫ শতাংশে।
এছাড়া ব্যাংক ও মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে করপোরেট করের হার অপরিবর্তিত থাকবে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ উদ্যোগের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করপোরেট করহার ২০ শতাংশ, অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য তা ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির জন্য ২২ দশমিক ৫ শতাংশ।
দেশের কর জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। দেশে প্রদেয় করদাতার অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। শর্তস্বরূপ রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, বাড়াতে হবে কর জিডিপি। আইএমএফের আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এজন্য আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: ঋণ বিতরণে নিয়মের তোয়াক্কা করছে না অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান
জানা যায়, আগামী অর্থবছর গ্রামাঞ্চল থেকে কর সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগের কথা ভাবছে সরকার।
রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গ্রামের মানুষকে করজালের আওতায় আনতে উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন জেলায় কর এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদের সাহায্য করবে। ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনো রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সহায়তা করবে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটের অর্থ বিলে ‘ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি)’ নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যার খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।
কোনো ব্যক্তি শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দিলে স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেতে তাকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। অন্যদিকে আয় ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে শূন্য রিটার্ন জমা দিলেও দুই হাজার টাকা আয়কর দেওয়ার বিধান রাখছে রাজস্ব বোর্ড। রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে ৩৮ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা পাওয়া যাবে না। এমনকি ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে শূন্য রিটার্ন জমা (করযোগ্য আয় না দেখিয়ে রিটার্ন জমা) দিলেও দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। কর আদায় বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণিতে পুরুষ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা রয়েছে। নারী বা ৬৫ বছর বয়সী পুরুষ করদাতাদের জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতাদের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকা ও মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহতদের জন্য তা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ৩২ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দেন। তার মধ্যে ৮ লাখেরই নেই করযোগ্য আয়। অন্যদিকে ব্যক্তিশ্রেণিতে টিআইএনধারীর সংখ্যা মাত্র ৮৬ লাখ। এছাড়া দেশের কর জিডিপি ৭ দশমিক ৮, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আইএমএফের শর্ত পূরণে কর জিডিপি ও কর জাল বাড়ানোর শর্তও রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদের ওপরও ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর ধার্যের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
আগামী বাজেটে জল, স্থল ও আকাশ- তিন পথেই ভ্রমণ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য ৮০০ টাকা ও সার্ক বহির্ভূত দেশের জন্য তা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশে যেতে বর্তমানে ১২০০ টাকা ভ্রমণ কর দিতে হচ্ছে। অন্যান্য দেশে এ করের পরিমাণ ২ হাজার টাকা। আকাশপথে অন্য কোনো দেশে যেতে ভ্রমণকর দিতে হবে ৪ হাজার টাকা, যা এখন তিন হাজার টাকা। স্থলপথে কোনো দেশে যেতে দিতে হবে দ্বিগুণ ভ্রমণকর। বর্তমানে এ কর ৫০০ টাকা, তবে নতুন হার চালু হলে দিতে হবে ১ হাজার টাকা। পাশাপাশি জলপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও ভ্রমণকর ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কর দিতে হবে ২০০ টাকা।
আরও পড়ুন: ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন মেহেরিয়ার হাসান
করদাতারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে না পারলেও পরে বছরের যে কোনো সময়ে জরিমানা ও সুদ পরিশোধ করে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য ডিসিটির (ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস) কাছে সময় বাড়ানোর আবেদনও করা লাগবে না। তবে এক্ষেত্রে জরিমানা ও সুদের হারে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
একাধিক গাড়ি আছে এমন করদাতাদের দ্বিতীয় গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও নবায়নের সময় ২৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি কর দিতে হবে। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, রাজধানীর যানজট সমস্যার নিরসন এবং গণপরিবহনের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো কার্বন কর চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, কার্বন করের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে সর্বোচ্চ ইঞ্জিন সক্ষমতার গাড়ির ভিত্তিতে। অর্থাৎ একাধিক গাড়ি থাকলে যে গাড়ির সিসি ক্ষমতা বেশি হবে সেটির ওপর কার্বন কর ধার্য করা হবে। ৩৫০০ সিসির বেশি ইঞ্জিন ক্ষমতার গাড়ির নবায়নের সময় ২ লাখ টাকা দিতে হবে, যা আগে ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আয়কর আইন অনুসারে, মালিকের কাছে দুই বা ততোধিক মোটরগাড়ি থাকলে প্রত্যেক বাড়তি মোটরগাড়ির জন্য করের হার ৫০ শতাংশ বাড়বে।
পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাজেটে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসছে না। নতুন আয়কর আইনে পুঁজিবাজারে বিদ্যমান কর অবকাশ এবং রেয়াতি সুবিধা বহাল থাকছে। নতুন অর্থবছরে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগে দুই ধরনের কর সুবিধা পাবেন বিনিয়োগকারীরা। একদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ওপর পাবেন কর রেয়াত, অন্যদিকে বিনিয়োগের ওপর অর্জিত মুনাফা থাকবে করমুক্ত। নতুন আয়কর আইনে বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা/এসএ