১০:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

সুকুক কি? সুকুক নিয়ে কিছু কথা!

বর্তমান সময়ে বিশ্বময় সবচেয়ে আলোচিত ইসলামিক প্রডাক্টগুলোর একটি হলো ‘সুকুক’। বিশেষত বাংলাদেশে এর আলোচনা এখন তুঙ্গে। বছর দুয়েক আগেও এর তেমন আলোচনা ছিল না। সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ২৯ মে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সুকুক বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করে। এরপর গত ৮ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে সরকার কর্তৃক সুকুক ইস্যু ও ব্যবস্থাপনা সম্পৃক্ত গাইডলাইন প্রকাশিত হয়। সব শেষে গত ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় প্রত্যাশিত বাংলাদেশ সরকারের ইনভেস্টমেন্ট সুকুকের প্রসপেক্টাস। ওই প্রসপেক্টাস অনুযায়ী গত ২৮ ডিসেম্বর দেশে প্রথম সুকুক অকশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকসহ ৩৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশগ্রহণ করে। অকশনের প্রথম ধাপে ৪ হাজার কোটি টাকার সুকুকের জন্য আবেদন পড়েছে ১৫ হাজার ১৫৩ কোটি ১০ লাখ টাকার। অর্থাৎ প্রায় চার গুণ বেশি আবেদন। এ থেকে বাংলাদেশে এর তুমুল জনপ্রিয়তা অনুমান করা যায়। জানা গেছে, সুকুকের মাধ্যমে অর্থায়নের জন্য সরকার মোট ৬৮টি প্রকল্পের তালিকা করেছে। এসব প্রকল্পের টাকার পরিমাণও নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে আরো সুকুক ইস্যু হবে। সরকার কেন এই সুকুকে আগ্রহী হলো, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘দেশের ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্যের প্রায় ৪৫ শতাংশের বেশি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রয়েছে। কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টে বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তেমন কোনো বিনিয়োগের সুযোগ ছিল না। এতে তাদের অধিকাংশ তারল্যই অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে। সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে এই ধারার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য একদিকে যেমন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ব্যয় করা যাবে, তেমনি শরিয়াহভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের বিকল্প সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আলোচ্য সুকুক তারা এসএলআর হিসাবেও ব্যবহার করতে পারবে।’ ১. গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারিত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে এদের ভূমিকা নেই (প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট, ২০২০)। মোট কথা, সরকার অর্থ সংগ্রহের জন্য নতুন করে সুকুক ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করছে। সামনেও হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুকুক প্রকারান্তরে সরকারের দায় বাড়িয়ে দেবে। দেশের চলমান অর্থনীতিতে সরকারের দায় বৃদ্ধি কতটা উপকারী, সেটি একটি আলোচনা হতে পারে। প্রবন্ধের শেষে এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হবে। সুকুক কী? সুকুক আমাদের দেশে একেবারেই নতুন একটি ইসলামী বিনিয়োগ প্রডাক্ট। শব্দ যেমন নতুন, পাবলিক প্রডাক্ট হিসেবেও নতুন। সুকুক শব্দটি মূলত বহুবচন। এর একবচন ‘ছক্ক’। মূল শব্দটি ফার্সি। সেখান থেকে আরবি ‘ছাক্কুন’। এরপর এর বহুবচন ‘সুকুক’। এর শাব্দিক অর্থ সার্টিফিকেট। দলিল-দস্তাবেজ, যা কোনো সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন জমির দলিল (আল-মিসবাহুল মুনীর, পৃ. ১৮০)। সুকুকের প্রায়োগিক ব্যবহার প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিকভাবে সুকুকের তিনটি অর্থ ও প্রয়োগ দেখা যায়। যথা: ক. কোনো সম্পদের ডুকুমেন্টস/সার্টিফিকেট। যেমন ওয়াকফ সম্পদের দলিল। হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে এর ব্যবহার পাওয়া যায় (রদ্দুল মুহতার, ১৩/৫৯২)। খ. রাষ্ট্রীয় ভাতা প্রাপ্তির সার্টিফিকেট। এই ব্যবহারটি ৬৫ হিজরিতে উমাইয়্যাহ শাসনামলে পাওয়া যায়। মদিনার গভর্নর তখন মারওয়ান ইবনে হাকাম (২-৬৫হি./৬২৩-৬৮ঈ.)। ওই সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাতা প্রদান করা হতো। সেই ভাতা প্রাপ্তির জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছিল, যা ‘সুকুক’ নামে পরিচিত ছিল। এই সুকুক দিয়ে নির্ধারিত স্থান থেকে রাষ্ট্রীয় ভাতা হিসেবে খাদ্যলাভ করা যেত। এই সুকুক আবার সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন হতো। যিনি এই সুকুক লাভ করতেন, তিনি সেটি দিয়ে ভাতা উত্তোলন না করে অন্যত্র বিক্রয় করে দিতেন। এতে যে সমস্যা হতো তা হলো, পণ্য হস্তগত করার আগেই তা বিক্রয় করা হয়। হাদিসে তা স্পষ্ট নিষিদ্ধ। তাই তত্কালীন সাহাবায়ে কেরাম এর বিরোধিতা করেছেন। ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে হাদিসের কিতাবগুলোয় উল্লেখ হয়েছে (সহিহ মুসলিম, ৩৭৩৯)। গ. সুদি বন্ডের বিকল্প হিসেবে ‘বিশেষ সার্টিফিকেট’ এ অর্থেই বর্তমানে ব্যবহূত হয়। লক্ষ করুন, পূর্বোক্ত দুটি প্রয়োগ ও বর্তমান প্রয়োগে একটি বিশেষ মিল হলো, সুকুক সবসময় সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে। এর আন্ডারলায়িং অ্যাসেট থাকে। এটিই সুকুকের মূলকথা। ২. প্রচলিত বন্ড যেখানে হয় সুদভিত্তিক, সুকুক সেখানে সুদমুক্ত প্রডাক্ট। বন্ড একটি সুদভিত্তিক ফান্ড সংগ্রহের মাধ্যম। অন্যদিকে সুকুক সুদমুক্ত ফান্ড সংগ্রহের ইসলামী মাধ্যম। প্রকৃত অর্থে সুকুক সুনির্দিষ্ট কোনো আর্থিক চুক্তির নাম নয়। এর প্রকৃতি নির্ণীত হয় এর স্ট্রাকচারিংয়ের মাধ্যমে। কখনো এর অবকাঠামো তৈরি হয় মুরাবাহা ভিত্তিতে। কখনো ইস্তেসনা। কখনো ইজারা ভিত্তিতে। এসব অবকাঠামো প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। যথা—অ্যাসেট বেজড ও অ্যাসেট ব্যাকড। সাধারণত ইজারা বা লিজভিত্তিক সুকুক হলো অ্যাসেট বেজড। আর বাকিগুলো অ্যাসেট ব্যাকড। সুকুকের বৈশিষ্ট্য সুকুকের মূল বৈশিষ্ট্য তিনটি। যথা—(১) এটি বিশেষ প্রজেক্টে হয়ে থাকে; (২) এর বিপরীতে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেট থাকে। পরিভাষায় একে ‘আন্ডারলায়িং অ্যাসেট’ বলা হয়। সুকুক হোল্ডারদের মূলত সেই অ্যাসেট থেকে প্রফিট জেনারেট হয়। দেখুন সাধারণ ব্যাংক লোনের বিপরীতেও বন্ধকি হিসেবে অ্যাসেট রাখতে হয়। তবে সেটি ব্যবহূত হয় না। সেখান থেকে প্রফিট আসে না; (৩) এর অবকাঠামো গঠন হয় শরিয়াহর সুনির্দিষ্ট কোনো কন্ট্রাক্টের অধীনে। প্রচলিত সুকুকের সূচনা প্রচলিত সুকুকের সূচনা হয় ১৯৭৮ সালে জর্ডানে ‘সকুকুল মুকারাযা’/মুদারাবা’ দিয়ে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে তুরস্কে ‘মুশারাকা সুকুক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ‘তার্কিশ রেভিনিউ শেয়ারিং সার্টিফিকেট’ নামে পরিচিতি ছিল। এটি ছিল সে দেশের প্রথম সরকারি সুদমুক্ত বন্ড। এরপর ১৯৯০-এ মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম করপোরেট সুকুক ইস্যু করে (সুকুক প্রিন্সিপল অ্যান্ড প্র্যাকটিস, ইসরা, পৃ. ৬১)। এরপর বিভিন্ন দেশে সুকুক ইস্যু হয়।
x
English Version