০৪:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ মে ২০২৪

অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়বে এক ডজন ব্যাংক

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:০৬:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মে ২০২১
  • / ৪২৩৯ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: দুর্বল বা সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনরুদ্ধারের বিস্তৃত রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব এরই মধ্যে মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। কারণ মূলধনের পাশাপাশি সঞ্চিতি ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের উচ্চহারে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের প্রায় এক ডজন ব্যাংক। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে কেউ কেউ। তবে প্রস্তাবিত এ সংশোধনীর কিছু ধারা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তারা বলছেন, বাস্তবায়ন হলে এ ধারাগুলোর কারণে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়ে যেতে পারে।

যেকোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার মৌলিক ভিত্তি ধরা হয় তারল্য ব্যবস্থাপনা, সম্পদের গুণগতমান ও মূলধন পরিস্থিতিকে। মৌলিক এ সূচকগুলোর বিচারে দেশের অনেক ব্যাংকের পরিস্থিতিই নাজুক। করোনাকালে বিভিন্নমুখী নীতি ছাড়ের পরও দেশের ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির চক্র থেকে বেরোতে পারেনি। নির্ধারিত হারে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারেনি ১১টি ব্যাংক। আবার অন্তত ১৫টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি। মৌলিক সবক’টি সূচকেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিটি ব্যাংক নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। সন্তোষজনক অবস্থানে নেই বেসরকারি ও বিদেশী খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকও।

মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে দুই বছর মৌলিক সূচক পরিপালনে ব্যর্থ হলে তাকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ধরনের ব্যাংককে ৪৫ দিনের মধ্যে পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এর বিষয়বস্তু হবে তারল্য পরিস্থিতির পুনরুদ্ধার, খেলাপি ঋণ আদায় পরিকল্পনা, মূলধন ঘাটতি পূরণ পরিকল্পনা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে হবে এক বছরের মধ্যে। নির্ধারিত সময়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবসায়ন বা পুনর্গঠন-সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে। বছরের পর বছর এসব ব্যাংক নির্ধারিত হারে ঋণ-আমানতের অনুপাত অনুসরণ, মূলধন ও সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ অবস্থায় ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলে অন্তত এক ডজন ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় বিলুপ্তি বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পথে হাঁটতে হবে।

ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবটি পাস হলে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে বলে জানালেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক আছে যাদের তারল্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। আবার কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের উচ্চহার, মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতিসহ পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় সংকট দৃশ্যমান। এ পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস হলে ব্যাংকগুলোকে ঘাটতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দিয়ে উন্নতির সুযোগ দেয়া হবে। যেসব ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে উন্নতি করতে পারবে না, সেসব ব্যাংকের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংক-কোম্পানি আইনের প্রতিটি ধারা বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ ভূমিকা রাখবে।

সংশোধনী প্রস্তাবে দুর্বল ব্যাংকের সংজ্ঞায়ন করে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত পরিমাণে-হারে-পন্থায় তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন সংরক্ষণ এবং আয় অর্জনে পর পর দুই বছর ব্যর্থ হলে সেটিকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এছাড়া যেসব ব্যাংকের জন্য দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে কিংবা অচিরেই অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি বা আশঙ্কা রয়েছে, সেগুলোও দুর্বল ব্যাংকের কাতারে পড়বে।

প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় দুর্বল ব্যাংকের করণীয় সম্পর্কেও বিধিনিষেধ দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন ছাড়া দুর্বল ব্যাংক নতুন কোনো ব্যবসায় নিয়োজিত হতে বা ব্যাংকের সম্প্রসারণ করতে পারবে না। নগদ মুনাফাও বণ্টন করতে পারবে না। তবে ব্যাংক চাইলে স্টক ডিভিডেন্ড বা রাইট শেয়ার ইস্যু করতে পারবে।

অন্যদিকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে বিদ্যমান বিধিবিধান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘনের মাধ্যমে যদি আমানতকারী, শেয়ারহোল্ডার ও অন্যান্য অংশীজনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করা হয়, সেক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের বিধান রাখা হয়েছে সংশোধনীতে।

ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে অতি দুর্বল বা সংকটাপন্ন ব্যাংক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের তারল্য, সম্পদ ও মূলধন পরিস্থিতি ও গভর্ন্যান্স সংকটাপন্ন হলে অনতিবিলম্বে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের আলোকে কোম্পানির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

ব্যাংকের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে ব্যর্থ ব্যাংকের করণীয় সম্পর্কে আদেশ দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব আদেশের মধ্যে থাকবে তারল্য পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার বা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করা, অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ, ব্যাংক কোম্পানির ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম পরিবর্তন, হ্রাস বা বন্ধ করা ইত্যাদি।

দেশের ব্যাংক খাতের ভিত শক্তিশালী করতে একীভূতকরণ-অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের দাবিটি দীর্ঘদিনের। পরিস্থিতির বিচারে ১৯৯১ সালের ব্যাংক-কোম্পানি আইনে আবারো সংশোধনীর উদ্যোগ নেয় সরকার। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ১৭ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়। সংশোধনী প্রস্তাবে আইনটিতে অন্যান্য বিধানের পাশাপাশি ‘ষষ্ঠ-ক’ খণ্ড নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়। ‘দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এ অধ্যায়ে দুর্বল ও সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনরুদ্ধার বা বিলুপ্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান তুলে ধরা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যমান ব্যাংক-কোম্পানি আইনে ব্যাংক অবসায়নের বিষয়ে বিধান থাকলেও মার্জার-অ্যাকুইজিশনের বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান ছিল না। আইনটির সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলে আইনের এ সীমাবদ্ধতা কাটবে। তবে সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলেই শুধু হবে না, সেটির বাস্তবায়নও হতে হবে। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা কথা শুনছি। বাজারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যাংক আসছে। আবার নতুন-পুরনো অনেক ব্যাংক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব গ্রাহকদের আমানতের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় যেন না হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, গুরুতর সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনর্গঠন বা একত্রীকরণ কিংবা অধিগ্রহণ অথবা অবসায়ন অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা ও কর্মপন্থার বিষয়ে সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা, ব্যাংক পুনর্গঠন, অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ, বেইল ইন, অন্য ব্যাংক কোম্পানির কাছে সম্পদ বিক্রি, লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে মার্জার-অ্যাকুইজিশন সংক্রান্ত অধ্যায় সংযুক্তিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, সংশোধনী প্রস্তাবে ‘দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক যে অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে, সেটি ভালো সংযোজন। প্রস্তাবটি আইনে রূপান্তর হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হবে সেটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন। তবে কোনো ব্যাংককেই অবসায়নের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে টেনে ধরা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে অবসায়নের ফলাফল ভালো হয় না। পিপলস লিজিং থেকে সে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। দুর্বল ও সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে ঠিক না হলে প্রশাসক বসিয়ে কিংবা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিয়ে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে।

সূত্র: বনিকবার্তা 

শেয়ার করুন

x

অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়বে এক ডজন ব্যাংক

আপডেট: ১১:০৬:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মে ২০২১

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: দুর্বল বা সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনরুদ্ধারের বিস্তৃত রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব এরই মধ্যে মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। কারণ মূলধনের পাশাপাশি সঞ্চিতি ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের উচ্চহারে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের প্রায় এক ডজন ব্যাংক। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে কেউ কেউ। তবে প্রস্তাবিত এ সংশোধনীর কিছু ধারা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তারা বলছেন, বাস্তবায়ন হলে এ ধারাগুলোর কারণে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যাংক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়ে যেতে পারে।

যেকোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার মৌলিক ভিত্তি ধরা হয় তারল্য ব্যবস্থাপনা, সম্পদের গুণগতমান ও মূলধন পরিস্থিতিকে। মৌলিক এ সূচকগুলোর বিচারে দেশের অনেক ব্যাংকের পরিস্থিতিই নাজুক। করোনাকালে বিভিন্নমুখী নীতি ছাড়ের পরও দেশের ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির চক্র থেকে বেরোতে পারেনি। নির্ধারিত হারে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারেনি ১১টি ব্যাংক। আবার অন্তত ১৫টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি। মৌলিক সবক’টি সূচকেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিটি ব্যাংক নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। সন্তোষজনক অবস্থানে নেই বেসরকারি ও বিদেশী খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকও।

মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে দুই বছর মৌলিক সূচক পরিপালনে ব্যর্থ হলে তাকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ধরনের ব্যাংককে ৪৫ দিনের মধ্যে পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এর বিষয়বস্তু হবে তারল্য পরিস্থিতির পুনরুদ্ধার, খেলাপি ঋণ আদায় পরিকল্পনা, মূলধন ঘাটতি পূরণ পরিকল্পনা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে হবে এক বছরের মধ্যে। নির্ধারিত সময়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবসায়ন বা পুনর্গঠন-সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে। বছরের পর বছর এসব ব্যাংক নির্ধারিত হারে ঋণ-আমানতের অনুপাত অনুসরণ, মূলধন ও সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ অবস্থায় ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলে অন্তত এক ডজন ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় বিলুপ্তি বা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পথে হাঁটতে হবে।

ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবটি পাস হলে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় বেঁধে দেয়া হবে বলে জানালেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক আছে যাদের তারল্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। আবার কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের উচ্চহার, মূলধন ও সঞ্চিতি ঘাটতিসহ পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় সংকট দৃশ্যমান। এ পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত সংশোধনী পাস হলে ব্যাংকগুলোকে ঘাটতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দিয়ে উন্নতির সুযোগ দেয়া হবে। যেসব ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে উন্নতি করতে পারবে না, সেসব ব্যাংকের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংক-কোম্পানি আইনের প্রতিটি ধারা বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ ভূমিকা রাখবে।

সংশোধনী প্রস্তাবে দুর্বল ব্যাংকের সংজ্ঞায়ন করে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত পরিমাণে-হারে-পন্থায় তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন সংরক্ষণ এবং আয় অর্জনে পর পর দুই বছর ব্যর্থ হলে সেটিকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এছাড়া যেসব ব্যাংকের জন্য দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে কিংবা অচিরেই অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি বা আশঙ্কা রয়েছে, সেগুলোও দুর্বল ব্যাংকের কাতারে পড়বে।

প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় দুর্বল ব্যাংকের করণীয় সম্পর্কেও বিধিনিষেধ দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন ছাড়া দুর্বল ব্যাংক নতুন কোনো ব্যবসায় নিয়োজিত হতে বা ব্যাংকের সম্প্রসারণ করতে পারবে না। নগদ মুনাফাও বণ্টন করতে পারবে না। তবে ব্যাংক চাইলে স্টক ডিভিডেন্ড বা রাইট শেয়ার ইস্যু করতে পারবে।

অন্যদিকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে বিদ্যমান বিধিবিধান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘনের মাধ্যমে যদি আমানতকারী, শেয়ারহোল্ডার ও অন্যান্য অংশীজনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করা হয়, সেক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের বিধান রাখা হয়েছে সংশোধনীতে।

ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে অতি দুর্বল বা সংকটাপন্ন ব্যাংক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের তারল্য, সম্পদ ও মূলধন পরিস্থিতি ও গভর্ন্যান্স সংকটাপন্ন হলে অনতিবিলম্বে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের আলোকে কোম্পানির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

ব্যাংকের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে ব্যর্থ ব্যাংকের করণীয় সম্পর্কে আদেশ দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব আদেশের মধ্যে থাকবে তারল্য পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার বা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করা, অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ, ব্যাংক কোম্পানির ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম পরিবর্তন, হ্রাস বা বন্ধ করা ইত্যাদি।

দেশের ব্যাংক খাতের ভিত শক্তিশালী করতে একীভূতকরণ-অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের দাবিটি দীর্ঘদিনের। পরিস্থিতির বিচারে ১৯৯১ সালের ব্যাংক-কোম্পানি আইনে আবারো সংশোধনীর উদ্যোগ নেয় সরকার। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ১৭ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়। সংশোধনী প্রস্তাবে আইনটিতে অন্যান্য বিধানের পাশাপাশি ‘ষষ্ঠ-ক’ খণ্ড নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়। ‘দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এ অধ্যায়ে দুর্বল ও সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনরুদ্ধার বা বিলুপ্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান তুলে ধরা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যমান ব্যাংক-কোম্পানি আইনে ব্যাংক অবসায়নের বিষয়ে বিধান থাকলেও মার্জার-অ্যাকুইজিশনের বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান ছিল না। আইনটির সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলে আইনের এ সীমাবদ্ধতা কাটবে। তবে সংশোধনী প্রস্তাব পাস হলেই শুধু হবে না, সেটির বাস্তবায়নও হতে হবে। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা কথা শুনছি। বাজারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ব্যাংক আসছে। আবার নতুন-পুরনো অনেক ব্যাংক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব গ্রাহকদের আমানতের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় যেন না হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, গুরুতর সংকটাপন্ন ব্যাংকের পুনর্গঠন বা একত্রীকরণ কিংবা অধিগ্রহণ অথবা অবসায়ন অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা ও কর্মপন্থার বিষয়ে সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির সুপারিশের আলোকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা, ব্যাংক পুনর্গঠন, অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ, বেইল ইন, অন্য ব্যাংক কোম্পানির কাছে সম্পদ বিক্রি, লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও ব্যাংক-কোম্পানি আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে মার্জার-অ্যাকুইজিশন সংক্রান্ত অধ্যায় সংযুক্তিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, সংশোধনী প্রস্তাবে ‘দুর্বল ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক যে অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে, সেটি ভালো সংযোজন। প্রস্তাবটি আইনে রূপান্তর হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হবে সেটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন। তবে কোনো ব্যাংককেই অবসায়নের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে টেনে ধরা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে অবসায়নের ফলাফল ভালো হয় না। পিপলস লিজিং থেকে সে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। দুর্বল ও সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে ঠিক না হলে প্রশাসক বসিয়ে কিংবা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিয়ে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে।

সূত্র: বনিকবার্তা