১০:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি শতভাগের বেশি

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০১:৩৭:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুন ২০২১
  • / ৪১৮১ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংক সেবা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা বছর সাতেক আগে। শুরু থেকে দ্রুতগতিতেই সম্প্রসারিত হয়েছে গ্রামমুখী ব্যাংক সেবাটি। তবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পালে সবচেয়ে বেশি হওয়া লেগেছে চলমান মহামারীতে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনাকালের এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০৯ শতাংশ। একই সময়ে এজেন্টদের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭১ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৯৯ শতাংশে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি সচল ছিল। এরই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধিতে। পাশাপাশি ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর ঘরের সঞ্চিত অর্থও ব্যাংকে আসতে শুরু করেছে। শহুরে গণ্ডি ভেঙে দিয়ে এজেন্টদের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া দেশের ব্যাংক খাতের বড় সফলতা। এর মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে কয়েক ধাপ এগিয়েছে দেশ।

এখন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি ব্যাংক এজেন্ট নিয়োগ, আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও রেমিট্যান্স আহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এজেন্ট আউটলেট চালুর ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে আছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। আর এজেন্টদের মাধ্যমে হিসাব সংখ্যা চালুর ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে ব্যাংক এশিয়া। এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ইসলামী ব্যাংক। এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষস্থানও দেশের বৃহৎ ব্যাংকটির। তবে এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান ব্র্যাক ব্যাংকের। এজেন্ট নিয়োগ, নতুন নতুন আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলায় একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করছে ব্যাংকগুলোও। সেবাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গিও বেশ উদার।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

কভিডসৃষ্ট দুর্যোগে ২০২০ সালের মার্চের শেষ নাগাদ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ ছিল। এরপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এ মুহূর্তে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চের শেষ দিন পর্যন্ত দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে ২২টি ব্যাংকের এজেন্ট ছিল ৮ হাজার ২৬০টি। চলতি বছরের মার্চে এজেন্টের সংখ্যা ১২ হাজার ৩৪৫-এ দাঁড়িয়েছে। করোনাকালের এক বছরে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৫টি। এ হিসাবে এজেন্টের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এজেন্টের মতোই গত এক বছরে ৪ হাজার ৫৪৬টি আউটলেট বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চ শেষে এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৮৭৫। চলতি বছরের মার্চে আউটলেটের সংখ্যা ১৬ হাজার ৪২১-এ উন্নীত হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে আউটলেট বেড়েছে ৩৮ দশমিক ২৮ শতাংশ।

২০২০ সালের ৩১ মার্চ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চালু করা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫১। করোনাকালের এক বছরে ৪৫ লাখ ২৫ হাজার ১৯৫টি নতুন ব্যাংক খোলা হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এজেন্টদের মাধ্যমে চালু করা ব্যাংক হিসাবের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ২২ হাজার ৬৪৬টি। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক হিসাবের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

করোনাকালের এক বছরে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। কিন্তু এজেন্টদের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানত বেড়েছে ১০৮ শতাংশের বেশি। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। এ আমানতের মধ্যে ১৭ হাজার ৮২২ কোটি টাকা এসেছে এজেন্টদের মাধ্যমে। অথচ ২০২০ সালের ৩১ মার্চ এজেন্টদের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। করোনাকালের এক বছরে এজেন্টদের মাধ্যমে ৯ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার আমানত সংগৃহীত হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে এজেন্টদের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৫০১ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭১ শতাংশেরও বেশি।

চলমান মহামারীতে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অর্জন হলো রেমিট্যান্সের বড় উল্লম্ফন। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অথচ করোনাকালের এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ১৯৯ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫৮ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু এক বছরে এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।

এজেন্ট ব্যাংকিং সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ ব্যাংক সেবার বাইরে ছিল। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যেতে ভয় পেত। কিন্তু এজেন্টরা মানুষের মনের ভয় দূর করতে পেরেছে। করোনাকালের এ সময়ে মানুষের চলাচলে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। এজন্য মানুষ ঘরের পাশে এজেন্টদের কাছে সেবার জন্য গিয়েছে। লেনদেন নিরাপদ হওয়ায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে।

দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার উত্পত্তি লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দ্রুততম সময়ে এ ব্যাংকিংয়ের ধারণা ছড়িয়েছে চিলি, কলম্বিয়া, পেরু ও মেক্সিকোয়। এরপর এর বিস্তার হয় কেনিয়াসহ আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে এ সেবা চালু হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ে নীতিমালা জারি করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম এজেন্ট নিয়োগ দেয় ব্যাংক এশিয়া। এরপর দ্রুততম সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়েছে অন্য ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। এরই মধ্যে সেবাটি চালু করেছে ২৭টি ব্যাংক।

অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে থেকে এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করেছিল ইসলামী ব্যাংক। কিন্তু স্বল্প সময়ে ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার বিপুল বিস্তৃতি হয়েছে। এজেন্ট নিয়োগ ও হিসাব খোলার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে থাকলেও আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সবার শীর্ষে। এরই মধ্যে এজেন্টদের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকে ৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার আমানত জমা হয়েছে, যা এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মোট আমানতের ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির এজেন্টরা আরো বেশি এগিয়ে। গত মার্চ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দেশে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৫৪ দশমিক ৪৬ শতাংশই ইসলামী ব্যাংকের দখলে।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঞ্চয় ব্যাংক খাতে আসতে শুরু করায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে উচ্চপ্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে করেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কিছুটা দেরিতে আমরা এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করেছিলাম। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা প্রায় আড়াই হাজার এজেন্ট নিয়োগ দিতে পেরেছি। লেনদেন বেশি হওয়ায় আমাদের এজেন্টরাও মুনাফায় চলে এসেছে। আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং সবার শীর্ষে। এটি ইসলামী ব্যাংকের প্রতি দেশের গণমানুষের আস্থা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের জন্য আমরা প্লাটফর্ম তৈরি করছি। এটি সম্পন্ন হলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকের বিনিয়োগ পৌঁছানো সম্ভব হবে।

ঢাকা/এনইউ

আরও পড়ুন:

ট্যাগঃ

শেয়ার করুন

x
English Version

করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি শতভাগের বেশি

আপডেট: ০১:৩৭:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুন ২০২১

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংক সেবা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা বছর সাতেক আগে। শুরু থেকে দ্রুতগতিতেই সম্প্রসারিত হয়েছে গ্রামমুখী ব্যাংক সেবাটি। তবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের পালে সবচেয়ে বেশি হওয়া লেগেছে চলমান মহামারীতে। পরিসংখ্যান বলছে, করোনাকালের এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০৯ শতাংশ। একই সময়ে এজেন্টদের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭১ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৯৯ শতাংশে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। ২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি সচল ছিল। এরই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধিতে। পাশাপাশি ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর ঘরের সঞ্চিত অর্থও ব্যাংকে আসতে শুরু করেছে। শহুরে গণ্ডি ভেঙে দিয়ে এজেন্টদের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া দেশের ব্যাংক খাতের বড় সফলতা। এর মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে কয়েক ধাপ এগিয়েছে দেশ।

এখন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ২৮টি ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি ব্যাংক এজেন্ট নিয়োগ, আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও রেমিট্যান্স আহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এজেন্ট আউটলেট চালুর ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে আছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। আর এজেন্টদের মাধ্যমে হিসাব সংখ্যা চালুর ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে রেখেছে ব্যাংক এশিয়া। এজেন্টদের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ইসলামী ব্যাংক। এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহে শীর্ষস্থানও দেশের বৃহৎ ব্যাংকটির। তবে এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান ব্র্যাক ব্যাংকের। এজেন্ট নিয়োগ, নতুন নতুন আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলায় একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করছে ব্যাংকগুলোও। সেবাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গিও বেশ উদার।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

কভিডসৃষ্ট দুর্যোগে ২০২০ সালের মার্চের শেষ নাগাদ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসে। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ ছিল। এরপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এ মুহূর্তে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চের শেষ দিন পর্যন্ত দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে ২২টি ব্যাংকের এজেন্ট ছিল ৮ হাজার ২৬০টি। চলতি বছরের মার্চে এজেন্টের সংখ্যা ১২ হাজার ৩৪৫-এ দাঁড়িয়েছে। করোনাকালের এক বছরে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৫টি। এ হিসাবে এজেন্টের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এজেন্টের মতোই গত এক বছরে ৪ হাজার ৫৪৬টি আউটলেট বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চ শেষে এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৮৭৫। চলতি বছরের মার্চে আউটলেটের সংখ্যা ১৬ হাজার ৪২১-এ উন্নীত হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে আউটলেট বেড়েছে ৩৮ দশমিক ২৮ শতাংশ।

২০২০ সালের ৩১ মার্চ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চালু করা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫১। করোনাকালের এক বছরে ৪৫ লাখ ২৫ হাজার ১৯৫টি নতুন ব্যাংক খোলা হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এজেন্টদের মাধ্যমে চালু করা ব্যাংক হিসাবের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ২২ হাজার ৬৪৬টি। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক হিসাবের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

করোনাকালের এক বছরে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। কিন্তু এজেন্টদের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানত বেড়েছে ১০৮ শতাংশের বেশি। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। এ আমানতের মধ্যে ১৭ হাজার ৮২২ কোটি টাকা এসেছে এজেন্টদের মাধ্যমে। অথচ ২০২০ সালের ৩১ মার্চ এজেন্টদের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। করোনাকালের এক বছরে এজেন্টদের মাধ্যমে ৯ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার আমানত সংগৃহীত হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে এজেন্টদের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৫০১ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭১ শতাংশেরও বেশি।

চলমান মহামারীতে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অর্জন হলো রেমিট্যান্সের বড় উল্লম্ফন। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অথচ করোনাকালের এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ১৯৯ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫৮ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু এক বছরে এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।

এজেন্ট ব্যাংকিং সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ ব্যাংক সেবার বাইরে ছিল। সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যেতে ভয় পেত। কিন্তু এজেন্টরা মানুষের মনের ভয় দূর করতে পেরেছে। করোনাকালের এ সময়ে মানুষের চলাচলে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। এজন্য মানুষ ঘরের পাশে এজেন্টদের কাছে সেবার জন্য গিয়েছে। লেনদেন নিরাপদ হওয়ায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে।

দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার উত্পত্তি লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দ্রুততম সময়ে এ ব্যাংকিংয়ের ধারণা ছড়িয়েছে চিলি, কলম্বিয়া, পেরু ও মেক্সিকোয়। এরপর এর বিস্তার হয় কেনিয়াসহ আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে এ সেবা চালু হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ে নীতিমালা জারি করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম এজেন্ট নিয়োগ দেয় ব্যাংক এশিয়া। এরপর দ্রুততম সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়েছে অন্য ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। এরই মধ্যে সেবাটি চালু করেছে ২৭টি ব্যাংক।

অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশ পিছিয়ে থেকে এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করেছিল ইসলামী ব্যাংক। কিন্তু স্বল্প সময়ে ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার বিপুল বিস্তৃতি হয়েছে। এজেন্ট নিয়োগ ও হিসাব খোলার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে থাকলেও আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সবার শীর্ষে। এরই মধ্যে এজেন্টদের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকে ৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার আমানত জমা হয়েছে, যা এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মোট আমানতের ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির এজেন্টরা আরো বেশি এগিয়ে। গত মার্চ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দেশে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৫৪ দশমিক ৪৬ শতাংশই ইসলামী ব্যাংকের দখলে।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঞ্চয় ব্যাংক খাতে আসতে শুরু করায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে উচ্চপ্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে করেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কিছুটা দেরিতে আমরা এজেন্ট ব্যাংকিং শুরু করেছিলাম। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা প্রায় আড়াই হাজার এজেন্ট নিয়োগ দিতে পেরেছি। লেনদেন বেশি হওয়ায় আমাদের এজেন্টরাও মুনাফায় চলে এসেছে। আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণে আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং সবার শীর্ষে। এটি ইসলামী ব্যাংকের প্রতি দেশের গণমানুষের আস্থা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের জন্য আমরা প্লাটফর্ম তৈরি করছি। এটি সম্পন্ন হলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাংকের বিনিয়োগ পৌঁছানো সম্ভব হবে।

ঢাকা/এনইউ

আরও পড়ুন: