০৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

পুঁজিবাজারে ‘৯৬’ কিংবা ‘২০১০’ আর দেখতে চাইনা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৭:২২:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ৪৪০৫ বার দেখা হয়েছে

বাজার ভালো হলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে, এটা যেমন স্বাভাবিক। আবার একটি মহল নিজেদের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত কারসাজির চেষ্টা করবে, এটাও স্বাভাবিক। তবে তার পরিমাণ কতুটুকু এবং তার কি প্রভাব বাজার তথা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পড়বে- তা পর্যবেক্ষন করার দায়িত্ব্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের।

এটা দিবালোকের মতো সত্য যে, দেশের পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব্য গ্রহণের পর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে তালিকাভূক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের ন্যূণতম শেয়ারধারণের আইন পরিপালনে জোরালো নির্দেশনা, পুরনো আইপিও প্রক্রিয়ার সংস্কার, দূর্বল কোম্পানির পর্ষদ পূণর্গঠন, বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ, পর্যবেক্ষক বসানো ও ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে বিদ্যমান বোর্ড পূনর্গঠন করতে ব্যর্থ হলে বর্তমান পরিচালক ও উদ্যোক্তাদেরকে পুঁজিবাজারে কোন তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে থাকার সুযোগ বন্ধ করেছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এছাড়াও ওটিসির বিনিয়োগকারীদের আটকে থাকা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে ওটিসি মার্কেট ভেঙ্গে এটিবি বা অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত, দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমান থাকা আইপিও আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি এবং মানহীন ও দূর্বল কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া, যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তারা লোকসান দেখিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন এবং বিনিয়োগকারীদেরকে ঠকাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা, প্রত্যান্ত বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে সিকিউরিটিজ হাউজের শাখা অফিস খোলার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের বাইরে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ডিজিটাল বুথ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ অন্যতম। এর ফলে পুঁজিবাজারের ওপর দেশের সব শ্রেনীর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ডিএসইর সূচক এখন সাত হাজার পেরিয়ে। এটা নিসন্দেহে দেশের পুঁজিবাজারের বড় অর্জন, তবে…

অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন এখানে ‘তবে…’ কেন বললাম। অনেকে এটাও বলবেন বর্তমান বাজারে প্রতিদিনই সূচক ও লেনদেনের উন্নতি হচ্ছে, প্রায় সব কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ছে, এখানে নতুন করে প্রশ্ন তোলার কি আছে? সেখানেই আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে- যেখানে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠান আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কোন বিনিয়োগকারীরই আগ্রহ ছিল না এবং যে প্রতিষ্ঠানের কোন ডিভিডেন্ড দেয়ার ইতিহাস না থাকার পাশাপাশি যার ইপিএস বরাবরই ঋণাত্মক, সেই কোম্পাানিটির শেয়ার কিভাবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিগুণ বাড়ে? আপনারা কি জানেন, প্রতিষ্ঠানটির পূঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ কতো? বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পূঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা! আরও কিছু উদাহরণ দেয়া ও এসব বিষয়ে কথা বলার আগে একটু পেছনে যাই।

মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কে ২০২০ মার্চে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেব যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন তারা। ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে আবার লেনদেন চালু হয়। নতুন নেতৃত্বের অধীনে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন হাজার কোটি টাকার ওপরে হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়।

তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে বাজারে। আর করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেলে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ এক প্রকার ধস নামে পুঁজিবাজারে। অবশ্য করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘লকডাউন’ দিলেও পুঁজিবাজার বেশ তেজী হয়ে উঠে। আতঙ্ক কাটিয়ে লকডাউনের মধ্যে হু হু করে বাড়ে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধন। এতে বিনিয়োগকারীদের মুখেও হাসি ফুটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিএসই’র সূচক ৭,২৫৮ এবং গড় লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা।

তবে মহামারির সময়কালে মৌলভিত্তির কোম্পানি খ্যাত ব্যাংকিং খাতের যেসব কোম্পানি ডিভিডেন্ড ও ইপিএসে চমক দেখিয়েছে কিংবা বিগত সময়ের তুলনায় যে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো ইউনিটহোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে সফল হয়েছে, সেসব শেয়ারের কতোটা বেড়েছে? আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক দর বাড়া কোম্পানিগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড দেয় না মিথুন নিটিং। সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটি বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে। অথচ গত চার মাসে এ কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ২০০ শতাংশের বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনে না থাকা এবং বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড না দেয়া আরেক কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল। চার বছর ধরে কোম্পানি কোনো আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে না। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম গত চার মাসে বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।

শুধু মিথুন নিটিং বা সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল নয়, সম্প্রতি অনেক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ফু-ওয়াং সিরামিক, সেলভো কেমিক্যাল, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, জিবিবি পাওয়ার, এমারেল্ড অয়েল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড মিল, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, তমিজুদ্দিন টেক্সটাইল, ঢাকা ডাইং, ফরচুন সুজসহ আরও বেশকিছু কোম্পানি। অথচ ভালো ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরও অনেক প্রতিষ্ঠানের দাম তলানিতে।

একদিকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বাড়া, অন্যদিকে ভালো ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানির শেয়ার দর তলানিতে পড়ে থাকাকে অস্বাভাবিক বলাই যায়। অবশ্য পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যাক্তিবর্গ ও সচেতন বিনিয়োগকারীরাও পুঁজিবাজার অনেকটাই কারসাজি চক্রের দখলে বলে মনে করছেন। কারণ ওইসব কারসাজিকারকেরা যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছে, তার দাম হু হু করে বাড়ছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অধিক লাভের আশায় ওই সব দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন।

কিন্তু এখানে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে- আমাদের দেশের অসংখ্য বিনিয়োগকারী অধিক মুনাফার মোহে পরে পুঁজিবাজারের ইতিহাসও ভূলে গেছেন। তারা এটাও ভূলে গেছেন, দেশের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ভালো সময় ছিল ২০০৯ ও ২০১০ সাল। এই দুই বছরে রমরমা ছিল পুঁজিবাজার। সে সময় পুঁজিবাজার সাধারণ মানুষের কাছে এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, দলে দলে বিনিয়োগকারী ছুটে আসেন। সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষার্থী সবাই দেদারছে বিনিয়োগ করেন পুঁজিবাজারে। ফলে ফুলে ফেঁপে ওঠে পুঁজিবাজার। যার ফলে ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে মহাধস নামে পুঁজিবাজারে। এতে পুঁজি হারান কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী। পুঁজি হারিয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এমনকি পুঁজি হারিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক বাজার বিশ্লেষকের সাথে কথা হয়েছে। তারা মনে করছেন, এখন বাজারে ফান্ডামেন্টাল বলে কিছু নেই। কোন শেয়ারে পার্টি আছে, সবাই এখন তাই দেখছে। এটা কিছুতেই পুঁজিবাজারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। আর এভাবে চলতে থাকলে আমাদেরকে অনিচ্ছা সত্বেও ‘৯৬’ কিংবা ‘২০১০’ এর মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।

ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম না বাড়া এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়া মোটেই শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক আচরণ না। বিনিয়োগকারীরা কীসের ভরসায় এখানে (দুর্বল প্রতিষ্ঠান) বিনিয়োগ করেন তা বোধগগম্য নয়। দুদিন পর যখন অন্য বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারবে এটা টেকসই বিনিয়োগ না তখন তারা বিক্রি শুরু করবে এবং সেসব শেয়ারের দাম পড়ে যাবে। তখন তাদের মূলধন হারাতে হবে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, যেসব বন্ধ ও দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম সম্প্রতি বেড়েছে সেগুলোকে নজরদারিতে নিয়ে আসছে বিএসইসি। এছাড়া বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত একাধিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের দূর্বল ও লোকসানি কোম্পানিতে উচ্চ দরে বিনিয়োগ না করারও আহ্বান জানিয়েছেন। তারমতে, অন্য যেকোন সময়ের চেয়েও বাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। লাভ করার সুযোগও আছে ভালো। ভালোভাবে জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। ঝুঁকি সামলানোর সামর্থ্য যদি না থাকে, তবে দুর্বল মৌলভিত্তির কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ না করে শক্ত মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন। অন্তত দিন শেষে ডিভিডেন্ডটুকু পাওয়া যাবে।

আমরা জানি বাজার উন্নয়নে বর্তমান কমিশন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তবে বাজারে কারা কোন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কিভাবে কারসাজি করছে, তাও এখন ওপেন সিক্রেট। পুঁজিবাজারের সকল স্টেকহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি আমিও একজন সাংবাদিক হিসেবে কারসাজি ও অনিয়মের বিষয়ে বিএসইসির জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তব প্রতিফলণ দেখবো বলে বিশ্বাস করি।

আর যদি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ও এর নিরাপত্তা নিয়ে বলতে গেলে এতোটুকুই বলবো, বিনিয়োগের মূল উদ্দ্যেশ্যই মুনাফা করা। তবে তা হতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ে। এজন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত ও বিশ্লেষনধর্মী বিনিয়োগ। আপনি যেকোন ব্যবসায়ই করেন না কেন- আপনি যদি ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ না করেন তবে আপনাকে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে। আর সেটা যদি হয় পুঁজিবাজার তাহলেতো আর কথায় নেই। বিনিয়োগের জন্য এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি খাত। একটু হের-ফের হলেই আপনি এবং আপনার পুরো পরিবারকে পথে বসতে হতে পারে।

‘কারসাজি’ এই শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এটা কিভাবে হয়, তাও কমবেশ সবাই জানি। পুঁজিবাজারে কারসাজি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে তা মাত্রাতিরিক্ত। হ্যা, এ কথা সত্য যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসির দায়িত্ব্য বাজারকে মনিটরিং করা কিংবা কারসাজিরোধ করা। ঠিক যেমন রোগীকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব্য ডাক্তারের। কিন্তু আপনি যদি স্ব-ইচ্ছায় পচা শামুকে বারবার পা কাটেন সেখানে ডাক্তারের কি করার আছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্তা-ব্যক্তিদের পাশাপাশি পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এমনকি পত্র-পত্রিকাগুলোতেও প্রতিনিয়তই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মৌলভিত্তির শেয়ারে, কিংবা কোম্পানির অবস্থান যাচাই করে বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে। কারণ, এটা কোন জুয়া খেলার ঘর না, কেউ তার জমানো সঞ্চয় বা পুঁজি জুয়ায় লাগাবেন। যদি এমনটাই হয় তাহলে যেসব কোম্পানি বছরের পর বছর উৎপাদনে নেই অথবা লোকসানে রয়েছে অথবা ডিভিডেন্ড দেয় না, সেসব কোম্পানিতে আপনি ঠিক কি কারণে বিনিয়োগ করছেন? যেসব কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ৪ টাকা, সেই কোম্পানির শেয়ার আপনি কি কারণে ৪০ অথবা ৪০০ টাকায় কিনছেন?

হ্যা, একটাই কারণ হতে পারে যে আপনি দুইদিনের মাথায় তা ৮০ অথবা ৮০০ টাকায় বিক্রি করার স্বপ্ন দেখছেন। একবার ভেবে দেখলেনও না যে শেয়ারটির ফেসভ্যালু বা অভিহিতমূল্য ১০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, টানা লোকসানের কারণে যে শেয়ারটির বাজার দর ৪ টাকাও হওয়ার কথা না, সে শেয়ারটি আপনার কাছ থেকে এতো টাকায় কে কিনবে? আপনি বোকা বনেছেন বা লোভে পড়েছেন বলে অন্য কেউ বোকা হবেন বা লোভে পড়বেন-এমনটি নাও হতে পারে। এবং না হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এখন যদি আপনার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে এ ভূলের দায় কে নেবে- এর কি কোন জবাব আপনার কাছে আছে? এখানে আমি একবারও বলছি না যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব্য শতভাগ পালন করেছে। এটাও বলছি না যে, তাদের কোন ভূল নেই। তবে এটাও সত্য পুঁজি আপনার, আর সেটা নিরাপদ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের দায়িত্ব্যটাও আপনার। আপনি দরজা খোলা রেখে ঘুরতে যাবেন, আর কিছু চুরি হলে দোষ দেবেন প্রতিবেশি কিংবা পুলিশের তাতো হতে পারে না।

তালিকাভূক্ত কোম্পানির যেকোন অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়ভার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর। কেউই এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তবে পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়-দায়িত্ব সবার কাঁধেই পড়ে।
মনে রাখতে হবে, পুঁজিটাতো আপনার। সেটার নিরাপদ বিনিয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব্যও আপনারই। আপনার ভূলে যদি তা হারিয়ে যায়, তাহলে তার দায় কারও নয়। আর তাই যেকোন কোম্পানিতে বিনিয়োগের পূর্বে কারও কথায় নয়, বরং ভালো করে যাচাই-বাছাইপূর্বক ভেবে-চিন্তে বিনিয়োগ করুন।

লেখক: হাসান কবির জনি, সাংবাদিক। ইমেইল: [email protected]

 

শেয়ার করুন

x
English Version

পুঁজিবাজারে ‘৯৬’ কিংবা ‘২০১০’ আর দেখতে চাইনা

আপডেট: ০৭:২২:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

বাজার ভালো হলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে, এটা যেমন স্বাভাবিক। আবার একটি মহল নিজেদের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত কারসাজির চেষ্টা করবে, এটাও স্বাভাবিক। তবে তার পরিমাণ কতুটুকু এবং তার কি প্রভাব বাজার তথা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পড়বে- তা পর্যবেক্ষন করার দায়িত্ব্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্টেকহোল্ডারদের।

এটা দিবালোকের মতো সত্য যে, দেশের পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব্য গ্রহণের পর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে তালিকাভূক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের ন্যূণতম শেয়ারধারণের আইন পরিপালনে জোরালো নির্দেশনা, পুরনো আইপিও প্রক্রিয়ার সংস্কার, দূর্বল কোম্পানির পর্ষদ পূণর্গঠন, বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ, পর্যবেক্ষক বসানো ও ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে বিদ্যমান বোর্ড পূনর্গঠন করতে ব্যর্থ হলে বর্তমান পরিচালক ও উদ্যোক্তাদেরকে পুঁজিবাজারে কোন তালিকাভুক্ত কোম্পানি বা মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে থাকার সুযোগ বন্ধ করেছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

এছাড়াও ওটিসির বিনিয়োগকারীদের আটকে থাকা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে ওটিসি মার্কেট ভেঙ্গে এটিবি বা অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত, দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমান থাকা আইপিও আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি এবং মানহীন ও দূর্বল কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া, যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তারা লোকসান দেখিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন এবং বিনিয়োগকারীদেরকে ঠকাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা, প্রত্যান্ত বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে সিকিউরিটিজ হাউজের শাখা অফিস খোলার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের বাইরে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ডিজিটাল বুথ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ অন্যতম। এর ফলে পুঁজিবাজারের ওপর দেশের সব শ্রেনীর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ডিএসইর সূচক এখন সাত হাজার পেরিয়ে। এটা নিসন্দেহে দেশের পুঁজিবাজারের বড় অর্জন, তবে…

অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন এখানে ‘তবে…’ কেন বললাম। অনেকে এটাও বলবেন বর্তমান বাজারে প্রতিদিনই সূচক ও লেনদেনের উন্নতি হচ্ছে, প্রায় সব কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ছে, এখানে নতুন করে প্রশ্ন তোলার কি আছে? সেখানেই আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে- যেখানে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠান আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কোন বিনিয়োগকারীরই আগ্রহ ছিল না এবং যে প্রতিষ্ঠানের কোন ডিভিডেন্ড দেয়ার ইতিহাস না থাকার পাশাপাশি যার ইপিএস বরাবরই ঋণাত্মক, সেই কোম্পাানিটির শেয়ার কিভাবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিগুণ বাড়ে? আপনারা কি জানেন, প্রতিষ্ঠানটির পূঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ কতো? বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পূঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা! আরও কিছু উদাহরণ দেয়া ও এসব বিষয়ে কথা বলার আগে একটু পেছনে যাই।

মহামারি করোনাভাইরাস আতঙ্কে ২০২০ মার্চে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেব যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন তারা। ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে আবার লেনদেন চালু হয়। নতুন নেতৃত্বের অধীনে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন হাজার কোটি টাকার ওপরে হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়।

তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে বাজারে। আর করোনার সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেলে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ এক প্রকার ধস নামে পুঁজিবাজারে। অবশ্য করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘লকডাউন’ দিলেও পুঁজিবাজার বেশ তেজী হয়ে উঠে। আতঙ্ক কাটিয়ে লকডাউনের মধ্যে হু হু করে বাড়ে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধন। এতে বিনিয়োগকারীদের মুখেও হাসি ফুটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ডিএসই’র সূচক ৭,২৫৮ এবং গড় লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা।

তবে মহামারির সময়কালে মৌলভিত্তির কোম্পানি খ্যাত ব্যাংকিং খাতের যেসব কোম্পানি ডিভিডেন্ড ও ইপিএসে চমক দেখিয়েছে কিংবা বিগত সময়ের তুলনায় যে মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো ইউনিটহোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে সফল হয়েছে, সেসব শেয়ারের কতোটা বেড়েছে? আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক দর বাড়া কোম্পানিগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো ডিভিডেন্ড দেয় না মিথুন নিটিং। সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটি বড় ধরনের লোকসানে রয়েছে। অথচ গত চার মাসে এ কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ২০০ শতাংশের বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনে না থাকা এবং বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড না দেয়া আরেক কোম্পানি সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল। চার বছর ধরে কোম্পানি কোনো আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে না। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম গত চার মাসে বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।

শুধু মিথুন নিটিং বা সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল নয়, সম্প্রতি অনেক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ফু-ওয়াং সিরামিক, সেলভো কেমিক্যাল, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, জিবিবি পাওয়ার, এমারেল্ড অয়েল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড মিল, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, তমিজুদ্দিন টেক্সটাইল, ঢাকা ডাইং, ফরচুন সুজসহ আরও বেশকিছু কোম্পানি। অথচ ভালো ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরও অনেক প্রতিষ্ঠানের দাম তলানিতে।

একদিকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বাড়া, অন্যদিকে ভালো ডিভিডেন্ড দেয়া কোম্পানির শেয়ার দর তলানিতে পড়ে থাকাকে অস্বাভাবিক বলাই যায়। অবশ্য পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যাক্তিবর্গ ও সচেতন বিনিয়োগকারীরাও পুঁজিবাজার অনেকটাই কারসাজি চক্রের দখলে বলে মনে করছেন। কারণ ওইসব কারসাজিকারকেরা যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছে, তার দাম হু হু করে বাড়ছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অধিক লাভের আশায় ওই সব দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন।

কিন্তু এখানে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে- আমাদের দেশের অসংখ্য বিনিয়োগকারী অধিক মুনাফার মোহে পরে পুঁজিবাজারের ইতিহাসও ভূলে গেছেন। তারা এটাও ভূলে গেছেন, দেশের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে ভালো সময় ছিল ২০০৯ ও ২০১০ সাল। এই দুই বছরে রমরমা ছিল পুঁজিবাজার। সে সময় পুঁজিবাজার সাধারণ মানুষের কাছে এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, দলে দলে বিনিয়োগকারী ছুটে আসেন। সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষার্থী সবাই দেদারছে বিনিয়োগ করেন পুঁজিবাজারে। ফলে ফুলে ফেঁপে ওঠে পুঁজিবাজার। যার ফলে ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে মহাধস নামে পুঁজিবাজারে। এতে পুঁজি হারান কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী। পুঁজি হারিয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এমনকি পুঁজি হারিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক বাজার বিশ্লেষকের সাথে কথা হয়েছে। তারা মনে করছেন, এখন বাজারে ফান্ডামেন্টাল বলে কিছু নেই। কোন শেয়ারে পার্টি আছে, সবাই এখন তাই দেখছে। এটা কিছুতেই পুঁজিবাজারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। আর এভাবে চলতে থাকলে আমাদেরকে অনিচ্ছা সত্বেও ‘৯৬’ কিংবা ‘২০১০’ এর মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।

ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম না বাড়া এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়া মোটেই শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক আচরণ না। বিনিয়োগকারীরা কীসের ভরসায় এখানে (দুর্বল প্রতিষ্ঠান) বিনিয়োগ করেন তা বোধগগম্য নয়। দুদিন পর যখন অন্য বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারবে এটা টেকসই বিনিয়োগ না তখন তারা বিক্রি শুরু করবে এবং সেসব শেয়ারের দাম পড়ে যাবে। তখন তাদের মূলধন হারাতে হবে।

তবে আশার কথা হচ্ছে, যেসব বন্ধ ও দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম সম্প্রতি বেড়েছে সেগুলোকে নজরদারিতে নিয়ে আসছে বিএসইসি। এছাড়া বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত একাধিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের দূর্বল ও লোকসানি কোম্পানিতে উচ্চ দরে বিনিয়োগ না করারও আহ্বান জানিয়েছেন। তারমতে, অন্য যেকোন সময়ের চেয়েও বাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। লাভ করার সুযোগও আছে ভালো। ভালোভাবে জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। ঝুঁকি সামলানোর সামর্থ্য যদি না থাকে, তবে দুর্বল মৌলভিত্তির কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ না করে শক্ত মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন। অন্তত দিন শেষে ডিভিডেন্ডটুকু পাওয়া যাবে।

আমরা জানি বাজার উন্নয়নে বর্তমান কমিশন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তবে বাজারে কারা কোন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কিভাবে কারসাজি করছে, তাও এখন ওপেন সিক্রেট। পুঁজিবাজারের সকল স্টেকহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি আমিও একজন সাংবাদিক হিসেবে কারসাজি ও অনিয়মের বিষয়ে বিএসইসির জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তব প্রতিফলণ দেখবো বলে বিশ্বাস করি।

আর যদি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ও এর নিরাপত্তা নিয়ে বলতে গেলে এতোটুকুই বলবো, বিনিয়োগের মূল উদ্দ্যেশ্যই মুনাফা করা। তবে তা হতে হবে যৌক্তিক পর্যায়ে। এজন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত ও বিশ্লেষনধর্মী বিনিয়োগ। আপনি যেকোন ব্যবসায়ই করেন না কেন- আপনি যদি ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ না করেন তবে আপনাকে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে। আর সেটা যদি হয় পুঁজিবাজার তাহলেতো আর কথায় নেই। বিনিয়োগের জন্য এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি খাত। একটু হের-ফের হলেই আপনি এবং আপনার পুরো পরিবারকে পথে বসতে হতে পারে।

‘কারসাজি’ এই শব্দটার সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এটা কিভাবে হয়, তাও কমবেশ সবাই জানি। পুঁজিবাজারে কারসাজি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে তা মাত্রাতিরিক্ত। হ্যা, এ কথা সত্য যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসির দায়িত্ব্য বাজারকে মনিটরিং করা কিংবা কারসাজিরোধ করা। ঠিক যেমন রোগীকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব্য ডাক্তারের। কিন্তু আপনি যদি স্ব-ইচ্ছায় পচা শামুকে বারবার পা কাটেন সেখানে ডাক্তারের কি করার আছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্তা-ব্যক্তিদের পাশাপাশি পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এমনকি পত্র-পত্রিকাগুলোতেও প্রতিনিয়তই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মৌলভিত্তির শেয়ারে, কিংবা কোম্পানির অবস্থান যাচাই করে বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে। কারণ, এটা কোন জুয়া খেলার ঘর না, কেউ তার জমানো সঞ্চয় বা পুঁজি জুয়ায় লাগাবেন। যদি এমনটাই হয় তাহলে যেসব কোম্পানি বছরের পর বছর উৎপাদনে নেই অথবা লোকসানে রয়েছে অথবা ডিভিডেন্ড দেয় না, সেসব কোম্পানিতে আপনি ঠিক কি কারণে বিনিয়োগ করছেন? যেসব কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ৪ টাকা, সেই কোম্পানির শেয়ার আপনি কি কারণে ৪০ অথবা ৪০০ টাকায় কিনছেন?

হ্যা, একটাই কারণ হতে পারে যে আপনি দুইদিনের মাথায় তা ৮০ অথবা ৮০০ টাকায় বিক্রি করার স্বপ্ন দেখছেন। একবার ভেবে দেখলেনও না যে শেয়ারটির ফেসভ্যালু বা অভিহিতমূল্য ১০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, টানা লোকসানের কারণে যে শেয়ারটির বাজার দর ৪ টাকাও হওয়ার কথা না, সে শেয়ারটি আপনার কাছ থেকে এতো টাকায় কে কিনবে? আপনি বোকা বনেছেন বা লোভে পড়েছেন বলে অন্য কেউ বোকা হবেন বা লোভে পড়বেন-এমনটি নাও হতে পারে। এবং না হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এখন যদি আপনার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে এ ভূলের দায় কে নেবে- এর কি কোন জবাব আপনার কাছে আছে? এখানে আমি একবারও বলছি না যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব্য শতভাগ পালন করেছে। এটাও বলছি না যে, তাদের কোন ভূল নেই। তবে এটাও সত্য পুঁজি আপনার, আর সেটা নিরাপদ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের দায়িত্ব্যটাও আপনার। আপনি দরজা খোলা রেখে ঘুরতে যাবেন, আর কিছু চুরি হলে দোষ দেবেন প্রতিবেশি কিংবা পুলিশের তাতো হতে পারে না।

তালিকাভূক্ত কোম্পানির যেকোন অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়ভার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর। কেউই এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তবে পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়-দায়িত্ব সবার কাঁধেই পড়ে।
মনে রাখতে হবে, পুঁজিটাতো আপনার। সেটার নিরাপদ বিনিয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্ব্যও আপনারই। আপনার ভূলে যদি তা হারিয়ে যায়, তাহলে তার দায় কারও নয়। আর তাই যেকোন কোম্পানিতে বিনিয়োগের পূর্বে কারও কথায় নয়, বরং ভালো করে যাচাই-বাছাইপূর্বক ভেবে-চিন্তে বিনিয়োগ করুন।

লেখক: হাসান কবির জনি, সাংবাদিক। ইমেইল: [email protected]