ফরমালিন আতঙ্কের শুরুতে সরকারি সাতটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সমন্বয় করে গবেষণা শুরু করেছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। এখনো ফরমালিন নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চলছে। বিএআরসির পরিচালক (পুষ্টি) ড. মো. মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক, বিশেষ করে ফরমালিনের আতঙ্ক বিদ্যমান। কিন্তু শুরু থেকে আমরা এ ভুল ধারণার বিপক্ষে ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘ফলমূল ফাইবার (তন্তু) জাতীয় খাবার। এতে প্রোটিনের উপস্থিতি খুবই কম। এমন খাবারে ফরমালিন কোনো কাজ করে না। ফরমালিন হচ্ছে ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ, যা অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক। এটি মূলত প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে।’ ড. মনিরুল ইসলাম জানান, ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবে ফরমালিন থাকে। গড়ে সেটা প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। কিন্তু এর থেকেও অধিক মাত্রার ফরমালিন মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকারক নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আতঙ্কের ওই সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ফরমালিন পরীক্ষার জন্য ‘জেড-৩০০’ নামের যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তা ফলমূলে ফরমালিন মাপার যন্ত্র ছিল না। বাতাসে ফরমালিনের উপস্থিতি মাপতে পারে ওই যন্ত্র। সে মেশিনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছিল। তাতে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়, যা এখনো কাটেনি। আর সেটা অনেকের অজানা রয়ে গেছে। তারা এখনো কম ফল খান এবং কোনো ফলে খুঁত চোখে পড়লে চেপে বসে ফরমালিন আতঙ্ক।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফলের মধ্যে প্রাকৃতিক ফরমালডিহাইড, নাকি বাইরে থেকে প্রয়োগ করা ফরমালিন রয়েছে তা নির্ণয় করার প্রযুক্তির সহজ যন্ত্র বাংলাদেশে এখনো নেই। এর জন্য ল্যাবে কয়েকটি টেস্ট প্রয়োজন।’ এদিকে ফল পাকাতে ইথোফেনের ব্যবহার নিয়েও রয়েছে জনমনে শঙ্কা। এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফল পাকাতে ইথোফেনের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। যদিও আমাদের দেশে প্রয়োগে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের ইথোফেন চেম্বার নেই; তাই ম্যানুয়ালি প্রয়োগ হয়। তারপরও বড় ক্ষতির কিছু নেই। ইথোফেন উদ্বায়ী বলে সেটা ফলে থেকে যায় না।’
বিএআরসির গবেষণায় বলা হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকানোর জন্য ইথোফেন নামের এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয়। যা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। এটি প্রয়োগের পর তা দ্রুত বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। আর এর অবশেষও ফলের মধ্যে থাকে না। ফলে ইথোফেন দিয়ে পাকানো ফল খেলে তা মানবদেহের জন্য তেমন ক্ষতিকারক নয়।
রোগ প্রতিরোধে বেশি বেশি ফল খাওয়ার প্রচারণা
এদিকে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেশি বেশি ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা। এক্ষেত্রে বিশেষত ভিটামিন সি আছে এমন ফল খাওয়ার কথা বলছেন তারা। সাধারণত কমলা, লেবু, জলপাই, মাল্টা, জাম্বুরা, আমলকি, জাম, পাকা পেঁপে, পেয়ারা, আনারস, তরমুজ, আম, লিচুর মতো মিষ্টি ফলে প্রচুর ভিটামিন সি আছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও সব ভীতি দূর করে বেশি বেশি ফল খাওয়ার বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ফল বা সবজি খাওয়া বা রান্নার আগে প্রবহমান পানিতে চার-পাঁচ মিনিট ধুয়ে নিতে হবে। পচা ও আঘাতপ্রাপ্ত অংশ ফেলে দিয়ে ফল খেলে তা হবে পুরোপুরি স্বাস্থ্যকর। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফরমালিনের আতঙ্ক আগের মতো নেই। তারপরেও আমরা নিয়মিত গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ফরমালিন নেই বলে প্রচার করছি।’
‘এছাড়া রেগুলেটরি সংস্থা হিসেবে আমরা খাদ্য নিরাপদ করতে বিভিন্ন আইন ও বিধি-বিধান তৈরি করেছি। সেসব বাধ্যবাধকতা মানা ছাড়া ব্যবসায়ীদের কোনো উপায় নেই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করে যাচ্ছেন’—বলেন মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ। কার্বাইড আতঙ্কের বিষয়ে মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘ফলমূল ও শাক-সবজিতে আরেকটি বড় ঝুঁকি ছিল ক্ষতিকর কার্বাইড ব্যবহার। আমরা আইন করে কার্বাইড ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছি। ফলে আগের মতো কার্বাইড ব্যবহারের প্রবণতাও নেই।’
ঢাকা/এনইউ
আরও পড়ুন: