০৭:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ মে ২০২৪

ফের টালমাটাল পুঁজিবাজার: মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৬:১৪:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ মার্চ ২০২২
  • / ৪১৪৫ বার দেখা হয়েছে

ফাইল ফটো

১৮ কার্যদিবসের বাজার মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা ১৬ কার্যদিবসে লেনদেন কমেছে ৫৩৫ কোটি টাকা ♦ সূচক ঠেকেছে সাত মাস আগের অবস্থানে ♦ পূর্ণ হচ্ছে না গেইনার তালিকার কোঠা।

এইচ কে জনি: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে আশার আলো দেখতে পেয়েছিলো। সূচক ও লেনদেনের ইতিবাচক উত্থান এবং নতুন কমিশন কর্তৃক গৃহীত বাজার উন্নয়নে তড়িৎ পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীদের মনে গেঁথে যাওয়া এক দশকের ক্ষত শুকাতে শুরু করেছিল। যেই বাজার থেকে সবশ্রেনীর বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, পুরনো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারাই আবার নতুন করে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আশা জাগানিয়ার সেই পুঁজিবাজার যে বিনিয়োগকারীদের মরনফাঁদ হয়ে দাড়াবে- তা কে জানতো!

গত কয়েক সপ্তাহে পুঁজিবাজার ফের তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। মাত্র ১৮ কার্যদিবসের ব্যবধানে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। আর ১৬ কার্যদিবসে লেনদেন কমেছে ৫৩৫ কোটি টাকা। আর সূচক গিয়ে ঠেকেছে সাত মাস আগের অবস্থানে। অবস্থা এতোটাই বেগতিক যে, গেইনারের তালিকায় থাকা ১০ কোম্পানির কোঠাও আজ (০৭ মার্চ ২০২২) পূরণ হয়নি। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে- তার কোন সদুত্তর নেই কারও কাছেই।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪৮ কোটি ৬২ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তবে মাত্র ১৮ কার্যদিবসের ব্যবধানে এর পরিমাণ আজ সোমবার (০৭ মার্চ ২০২২) ৪৫ হাজার ৫১৪ কোটি ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা কমে ৫ লাখ ২১ হাজার ৯৩৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইতে ১ হাজার ২৭৫ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা লেনদেন হলেও মাত্র ১৬ কার্যদিবসের ব্যবধানে আজ ৭ মার্চ এর পরিমাণ ৫৩৫ কোটি ৩৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা কমে ৭৪০ কোটি ২৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

ডিএসই’র প্রধান মূল্য সূচক সাত মাস আগের অবস্থানে নেমে এসেছে। অর্থ্যাৎ ২০২১ সালে ২৯ জুলাই ডিএসইএক্স ৬৪২৫.২৫ পয়েন্ট ছিল। আজ ৭ মার্চ ডিএসইএক্স ১৮২.১২ পয়েন্ট কমে ৬৪৫৬.৫১ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আজ দিন শেষে ডিএসইর গেইনার তালিকায় ১০টি কোম্পানি স্থান করে নেয়ার কথা থাকলেও সেই তালিকা পূর্ণ হয়নি। কারণ দিনশেষে মাত্র সাতটি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে ৩৬৪টি এবং অপরিবর্তিত ছিল আটটির শেয়ার দর।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেনের গতিবিধি অস্বাভাবিক। এখানে কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায় কারসাজি হচ্ছে। যার পরিণতিতে হুট করে বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। বিগত সময়ে যেভাবে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, সেখানে হঠাৎ করে সূচকের পতন অস্বাভাবিক। বিনিয়োগকারীদের ধারণা ছিল, সূচক ৬ হাজার ৯০০-এর মধ্যে থাকবে। কিন্তু সূচক এখন ৬ হাজার ৪০০’র ঘরে নেমে এসেছে। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী হতাশ। এর কিছু কারণও আছে। আগে শেয়ার দর বাড়ার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ট্রেডিং কিংবা সিরিয়াল ট্রেডিং কাজ করেছে। যে কারণে স্থায়ী হয়নি শেয়ারের দাম। অনেক কোম্পানি আইপিওতে আসার পর শেয়ারের দর সাত গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

এছাড়া আইপিওর শেয়ার নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার কিনেছেন। এখন সেই দাম নেই, অনেক কমে গেছে। জোয়ারের মতো কয়েকটি শেয়ারের দর বেড়েছে। আর যখন ভাটা পড়েছে, তখন মাথায় হাত। আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফার লোভে গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে কিছু কোম্পানির শেয়ার কিনছেন। অথচ এসব কোম্পানি সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা নেই। কিছুদিন আগে বিনিয়োগকারীরা বিমা খাতের পেছনে ছুটেছেন। এ খাতের শেয়ারের দর তিন-চার গুণ বেড়েছে। বিমার শেয়ার দর সে জায়গায় এখন আর নেই। তারপর তারা ছুটেছেন মিউচ্যুয়াল ফান্ডে। এ খাতের উত্থানও শেষ পর্যন্ত টিকেনি। তারপর যান আইপিওতে, তখন আইপিওতে আসা প্রায় সবগুলোর শেয়ার দর তিন-চার গুণ বাড়লেও শেষ পর্যন্ত তাও স্থায়ী হয়নি। ওই সময়ে রবির শেয়ার বেড়েছিল সাত গুণ। এছাড়া বর্তমান বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের অভাব রয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

এ বিষয়ে আলাপকালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ বিজনেস জার্নালকে বলেন, বাজারের এমন দুরাবস্থার জন্য ৪-৫টি কারণ রয়েছে। এরমধ্যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি বা মূল্যস্ফীতি অন্যতম। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে বাজার যখন নিম্নমূখী হয় তখন সেল প্রেসার বেড়ে যায়। কারণ বাজার যখন ভালো হয় তখন হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণে উৎসাহিত করে, আর বাজার নিম্নমূখী হলে শুরু হয় অ্যাডজাস্টমেন্ট। আর তখনই ‘বলির পাঠা’ হয় লাভের স্বপ্নে বিভোর থাকা বিনিয়োগকারীরা।

তিনি বলেন, যখন বিমা ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে কারসাজি হচ্ছিল তখন অনেক বলেছি, কেউ আমার কথা শুনেনি। বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে এসব না বলতে বলা হয়েছে। সবকিছু ওপেন সিক্রেট হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই। এছাড়া সুকুক বন্ড ও আইপিওর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এসবে বিনিয়োগে বাধ্য করা হয়েছে। এখন ক্রাইসিস সিচুয়েশনে সেইসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলও নেই। আবার কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগযোগ্য তহবিল থাকা সত্ত্বেও কম দামে শেয়ার হাতিয়ে নিতে নিশ্চুপ বসে আছে। সবমিলিয়ে বাজার কারসাজি চক্রের হাতে জিম্মি বলে তিনি মনে করছেন।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিজনেস জার্নালের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাজার এমন অস্বাভাবিক পতনের দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং গণমাধ্যম- কেউই এড়াতে পারে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যখন বিমার শেয়ার নিয়ে কারসাজি বাজারে ওপেন সিক্রেট ছিল, তখন বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর পক্ষ থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যে কারণে প্রতিটি বিমা কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বেড়েছিল। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে ডে-ট্রেডারের ভূমিকায় রয়েছে। বিশেষ করে আইসিবি ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী প্রফিট টেকিংয়ের মনোভাব বাজারের আজকের দুরাবস্থার জন্য দায়ী।

বাজারের এমন পতনে বিনিয়োগকারী ও গণমাধ্যমের দায় কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম কমানো এবং উচ্চ দামে বিক্রি করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রফিট টেকিং নামক কারসাজির প্রক্রিয়াটি কারোরই অজানা নয়। তবুও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেন সূচক অথবা কোম্পানির শেয়ার দর একটু বাড়তি দেখলে কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে? আবার কেনই বা সূচক বা শেয়ার দর একটু কমতে দেখলে লোকসানেই থাকুক আর লাভেই থাকুক- কোন যাচাই-বাছাই না করেই বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে যায়। আর সেই সুযোগটুকুই নেয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামধারী কারসাজি চক্রের হোতারা। কোন তথ্য যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার কেনা বা লোকসানে বিক্রি করে দিলে বাজারে তার নেগেটিভ প্রভাব পড়বে-এটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে বাজারের আজকের পরিস্থিতির দায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এড়াতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে করা কিছু সংবাদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, নেগেটিভ ইক্যুইটি সমন্বয়ের ডেডলাইন ২০২৩ সাল থাকলেও কিছু সংবাদমাধ্যমে তা চলতি বছরের ডিসেম্বরের কথা বলে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। যার বিরুপ প্রভাব পড়েছিল পুঁজিবাজারে। যদিও পরে কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিস্কার করা হলে সেই ভূল ভেঙ্গে যায়। তবে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তাই স্পর্শকাতর খ্যাত পুঁজিবাজার সম্পর্কে ভেবে-চিন্তে এবং যাচাই করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে অনুরোধ করেন।

বিজনেস জার্নাল/ঢাকা

শেয়ার করুন

x

ফের টালমাটাল পুঁজিবাজার: মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা

আপডেট: ০৬:১৪:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ মার্চ ২০২২

১৮ কার্যদিবসের বাজার মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা ১৬ কার্যদিবসে লেনদেন কমেছে ৫৩৫ কোটি টাকা ♦ সূচক ঠেকেছে সাত মাস আগের অবস্থানে ♦ পূর্ণ হচ্ছে না গেইনার তালিকার কোঠা।

এইচ কে জনি: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে আশার আলো দেখতে পেয়েছিলো। সূচক ও লেনদেনের ইতিবাচক উত্থান এবং নতুন কমিশন কর্তৃক গৃহীত বাজার উন্নয়নে তড়িৎ পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীদের মনে গেঁথে যাওয়া এক দশকের ক্ষত শুকাতে শুরু করেছিল। যেই বাজার থেকে সবশ্রেনীর বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, পুরনো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারাই আবার নতুন করে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আশা জাগানিয়ার সেই পুঁজিবাজার যে বিনিয়োগকারীদের মরনফাঁদ হয়ে দাড়াবে- তা কে জানতো!

গত কয়েক সপ্তাহে পুঁজিবাজার ফের তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। মাত্র ১৮ কার্যদিবসের ব্যবধানে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ৪৫ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। আর ১৬ কার্যদিবসে লেনদেন কমেছে ৫৩৫ কোটি টাকা। আর সূচক গিয়ে ঠেকেছে সাত মাস আগের অবস্থানে। অবস্থা এতোটাই বেগতিক যে, গেইনারের তালিকায় থাকা ১০ কোম্পানির কোঠাও আজ (০৭ মার্চ ২০২২) পূরণ হয়নি। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে- তার কোন সদুত্তর নেই কারও কাছেই।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

ডিএসই’র তথ্য বিশ্লেষনে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪৮ কোটি ৬২ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তবে মাত্র ১৮ কার্যদিবসের ব্যবধানে এর পরিমাণ আজ সোমবার (০৭ মার্চ ২০২২) ৪৫ হাজার ৫১৪ কোটি ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা কমে ৫ লাখ ২১ হাজার ৯৩৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

১৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইতে ১ হাজার ২৭৫ কোটি ৬৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা লেনদেন হলেও মাত্র ১৬ কার্যদিবসের ব্যবধানে আজ ৭ মার্চ এর পরিমাণ ৫৩৫ কোটি ৩৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা কমে ৭৪০ কোটি ২৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

ডিএসই’র প্রধান মূল্য সূচক সাত মাস আগের অবস্থানে নেমে এসেছে। অর্থ্যাৎ ২০২১ সালে ২৯ জুলাই ডিএসইএক্স ৬৪২৫.২৫ পয়েন্ট ছিল। আজ ৭ মার্চ ডিএসইএক্স ১৮২.১২ পয়েন্ট কমে ৬৪৫৬.৫১ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আজ দিন শেষে ডিএসইর গেইনার তালিকায় ১০টি কোম্পানি স্থান করে নেয়ার কথা থাকলেও সেই তালিকা পূর্ণ হয়নি। কারণ দিনশেষে মাত্র সাতটি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে ৩৬৪টি এবং অপরিবর্তিত ছিল আটটির শেয়ার দর।

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেনের গতিবিধি অস্বাভাবিক। এখানে কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায় কারসাজি হচ্ছে। যার পরিণতিতে হুট করে বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। বিগত সময়ে যেভাবে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, সেখানে হঠাৎ করে সূচকের পতন অস্বাভাবিক। বিনিয়োগকারীদের ধারণা ছিল, সূচক ৬ হাজার ৯০০-এর মধ্যে থাকবে। কিন্তু সূচক এখন ৬ হাজার ৪০০’র ঘরে নেমে এসেছে। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী হতাশ। এর কিছু কারণও আছে। আগে শেয়ার দর বাড়ার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ট্রেডিং কিংবা সিরিয়াল ট্রেডিং কাজ করেছে। যে কারণে স্থায়ী হয়নি শেয়ারের দাম। অনেক কোম্পানি আইপিওতে আসার পর শেয়ারের দর সাত গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

এছাড়া আইপিওর শেয়ার নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার কিনেছেন। এখন সেই দাম নেই, অনেক কমে গেছে। জোয়ারের মতো কয়েকটি শেয়ারের দর বেড়েছে। আর যখন ভাটা পড়েছে, তখন মাথায় হাত। আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দ্রুত মুনাফার লোভে গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে কিছু কোম্পানির শেয়ার কিনছেন। অথচ এসব কোম্পানি সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা নেই। কিছুদিন আগে বিনিয়োগকারীরা বিমা খাতের পেছনে ছুটেছেন। এ খাতের শেয়ারের দর তিন-চার গুণ বেড়েছে। বিমার শেয়ার দর সে জায়গায় এখন আর নেই। তারপর তারা ছুটেছেন মিউচ্যুয়াল ফান্ডে। এ খাতের উত্থানও শেষ পর্যন্ত টিকেনি। তারপর যান আইপিওতে, তখন আইপিওতে আসা প্রায় সবগুলোর শেয়ার দর তিন-চার গুণ বাড়লেও শেষ পর্যন্ত তাও স্থায়ী হয়নি। ওই সময়ে রবির শেয়ার বেড়েছিল সাত গুণ। এছাড়া বর্তমান বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের অভাব রয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

এ বিষয়ে আলাপকালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ বিজনেস জার্নালকে বলেন, বাজারের এমন দুরাবস্থার জন্য ৪-৫টি কারণ রয়েছে। এরমধ্যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি বা মূল্যস্ফীতি অন্যতম। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের মনোস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে বাজার যখন নিম্নমূখী হয় তখন সেল প্রেসার বেড়ে যায়। কারণ বাজার যখন ভালো হয় তখন হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণে উৎসাহিত করে, আর বাজার নিম্নমূখী হলে শুরু হয় অ্যাডজাস্টমেন্ট। আর তখনই ‘বলির পাঠা’ হয় লাভের স্বপ্নে বিভোর থাকা বিনিয়োগকারীরা।

তিনি বলেন, যখন বিমা ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড নিয়ে কারসাজি হচ্ছিল তখন অনেক বলেছি, কেউ আমার কথা শুনেনি। বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে এসব না বলতে বলা হয়েছে। সবকিছু ওপেন সিক্রেট হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নাই। এছাড়া সুকুক বন্ড ও আইপিওর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে বের হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এসবে বিনিয়োগে বাধ্য করা হয়েছে। এখন ক্রাইসিস সিচুয়েশনে সেইসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলও নেই। আবার কিছু কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগযোগ্য তহবিল থাকা সত্ত্বেও কম দামে শেয়ার হাতিয়ে নিতে নিশ্চুপ বসে আছে। সবমিলিয়ে বাজার কারসাজি চক্রের হাতে জিম্মি বলে তিনি মনে করছেন।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিজনেস জার্নালের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাজার এমন অস্বাভাবিক পতনের দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং গণমাধ্যম- কেউই এড়াতে পারে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যখন বিমার শেয়ার নিয়ে কারসাজি বাজারে ওপেন সিক্রেট ছিল, তখন বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর পক্ষ থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যে কারণে প্রতিটি বিমা কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বেড়েছিল। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে ডে-ট্রেডারের ভূমিকায় রয়েছে। বিশেষ করে আইসিবি ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী প্রফিট টেকিংয়ের মনোভাব বাজারের আজকের দুরাবস্থার জন্য দায়ী।

বাজারের এমন পতনে বিনিয়োগকারী ও গণমাধ্যমের দায় কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম কমানো এবং উচ্চ দামে বিক্রি করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রফিট টেকিং নামক কারসাজির প্রক্রিয়াটি কারোরই অজানা নয়। তবুও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেন সূচক অথবা কোম্পানির শেয়ার দর একটু বাড়তি দেখলে কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে? আবার কেনই বা সূচক বা শেয়ার দর একটু কমতে দেখলে লোকসানেই থাকুক আর লাভেই থাকুক- কোন যাচাই-বাছাই না করেই বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে যায়। আর সেই সুযোগটুকুই নেয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামধারী কারসাজি চক্রের হোতারা। কোন তথ্য যাচাই-বাছাই না করে শেয়ার কেনা বা লোকসানে বিক্রি করে দিলে বাজারে তার নেগেটিভ প্রভাব পড়বে-এটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে বাজারের আজকের পরিস্থিতির দায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও এড়াতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে করা কিছু সংবাদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, নেগেটিভ ইক্যুইটি সমন্বয়ের ডেডলাইন ২০২৩ সাল থাকলেও কিছু সংবাদমাধ্যমে তা চলতি বছরের ডিসেম্বরের কথা বলে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। যার বিরুপ প্রভাব পড়েছিল পুঁজিবাজারে। যদিও পরে কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিস্কার করা হলে সেই ভূল ভেঙ্গে যায়। তবে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তাই স্পর্শকাতর খ্যাত পুঁজিবাজার সম্পর্কে ভেবে-চিন্তে এবং যাচাই করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে অনুরোধ করেন।

বিজনেস জার্নাল/ঢাকা