০৪:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪

বদলে গেছে জীবন: আমরা খুব ভালো আছি, তোমরাও দ্রুত চলে এসো

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০২:১৬:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ৪১৫৩ বার দেখা হয়েছে

ভাসানচরের ৭ ও ৮ নম্বর ক্লাস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে গতকাল শনিবার সকালে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভিডিওকলে কথা বলছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। তখন তার কোলে একটি শিশু। তার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ছোট-বড় তিন-চারজনের ছবি ভেসে উঠছিল। পারভীন আক্তার নামের ওই নারী রোহিঙ্গা হলেও তার ভাষা বুঝতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না। নতুন পরিবেশে তার চোখে নতুন স্বপ্ন। তিনি যা বলছিলেন তার প্রমিত বাংলা দাঁড়ায় এ রকম- ‘কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচর অনেক ভালো। এখানে পাকা ঘর। সবকিছু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। বাচ্চাদের খেলার মাঠ আছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও অনেক ভালো। রান্নার জন্যও সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। আমরা ভালো আছি। তোমরাও দ্রুত চলে আসো। এখানে এলে দিন বদলে যাবে।’

ওই রোহিঙ্গা নারী সমকালকে জানান, কক্সবাজারের লেদা ক্যাম্পে থাকা তার খালা সকিনাকে ভাসানচরের অবস্থা সম্পর্কে ফোনে জানাচ্ছিলেন। ভিডিওকলে থাকার ঘরসহ আশপাশের সব স্থাপনা এরই মধ্যে খালাকে দেখিয়েছেন তিনি। এমনকি কক্সবাজারে থাকা স্বামীকেও ভিডিওকল করে ভাসানচর সম্পর্কে অবহিত করেছেন।

শুক্রবার এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গার সঙ্গে পারভীনও কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে এসেছেন। প্রথম রাত নতুন আবাসে কাটানোর পর ভাসানচর সম্পর্কে পারভীনের অভিব্যক্তি হলো, ‘ভাসানচর সম্পর্কে এত দিন যা শুনেছি, এখানে এসে দেখি সার্বিক ব্যবস্থাপনা তার চেয়েও ভালো। কক্সবাজারের ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধা আকাশ-পাতাল ফারাক। এখানে আমাদের জন্য যে এত কিছু করে রাখা হয়েছে, তা আগে ভাবতেও পারিনি। যারা এখনও কক্সবাজারে রয়েছে, তারা দ্রুতই ভাসানচরে চলে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’

প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের যে দলটি ভাসানচরে এসে অবস্থান করছে, তাদের অভিব্যক্তি জানতে অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় সমকালের এই প্রতিনিধির। তাদের সবার বক্তব্য মোটামুটি এ রকম- কক্সবাজারের তুলনায় ভাসানচর তাদের কাছে স্বর্গ। খোলামেলা জায়গা। বাচ্চারা এক শেল্টার হাউস থেকে অন্য শেল্টার হাউসে দৌড়াদৌড়ি করতে পারছে। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, মাঠসহ কী নেই এখানে! এ ছাড়া পাকা ঘর। ঝড়-বাদলায় ঘরের মধ্যে পানি ওঠার কোনো আশঙ্কা নেই। ভাসানচরের নতুন বসতিতে এসে নতুন এক জীবনের স্বাদ পাচ্ছেন তারা।

রোহিঙ্গা যুবক আমির হোসেন। নিজের ঘরের বারান্দায় সন্তানদের নিয়ে গতকাল সকালে গল্প করছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর আমির হোসেন বললেন, ‘বাংলাদেশ সরকার আমাগো লইগ্যা এত বড় জায়গা দিল। গোডা এলাকায় বিল্ডিং বানাইয়্যা দিল। আমি সরকারের প্রতি খুবই খুশি। বলতে গেলে কক্সবাজারে জঙ্গলে বাস করতাম। এখানকার পরিবেশ পুরো শহরের মতো। এখন অনেক অনেক ভালো আছি, ভাই। অনেক নিরাপদে আছি।’

আমির হোসেন আরও জানান, তিন মেয়ে, চার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাসানচরে এসেছেন তিনি। কক্সবাজারে এখনও তার শ্বশুর, স্ত্রীর বড় বোনসহ পরিবারের ৫০ সদস্য রয়েছেন। তারা ভাসানচর সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। এ জন্য প্রথম দফায় আসেননি। এখানে আসার পর ফোন করে ভাসানচরের সুন্দর পরিবেশ সম্পর্কে তাদের জানিয়েছি। এখন তারা আফসোস করছেন। এখানে আসতে চাচ্ছেন। কক্সবাজারের ক্যাম্পে নানা ঝুট-ঝামেলা লেগেই থাকত। ভাসানচরে এমন কিছু নেই। এটা দেখে ভালো লাগছে।

সমকালের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় আমিরের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আমির বেশ উচ্চ স্বরেই কক্সবাজারে থাকা স্বজনদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘ঘর থেকে বের হওয়ার পর ভাসানচর আসা পর্যন্ত এক পয়সাও খরচ লাগবে না। পথে নানা ধরনের খাবার দিয়েছে। আসার পর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে যা যা দরকার, সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করতে পারবি। আরামে ঘুমাতে পারবি। আমিরের পাশে দাঁড়ানো কিশোরী জয়নবাও বলছিল যে তারা সবাই খুব ভালো আছে। খোলা মাঠে খেলাধুলাও করা যাচ্ছে।

ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউসে কথা হয় আরেক রোহিঙ্গা কিশোরী সকিনা বেগমের সঙ্গে। বৃদ্ধ নানি নজিবা খাতুনকে নিয়ে নিজের ঘরটা ধোয়ামোছা করছিলেন সকিনা। এই কিশোরীর জীবনের গল্প আসলেই করুণ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাবা জামাল হোসেন ও মা সকিলা বেগমকে হারিয়েছেন তিনি। এরপর আত্মীয়দের সঙ্গে সকিনা, তার বড় বোন ও এক ভাই বাংলাদেশে চলে আসেন। সকিনার বড় বোনকে দেখভাল করছেন তাদের খালা শওকত আরা। তিনিও একই ক্লাস্টার হাউসের একটিতে উঠেছেন। সকিনার ভাই তখন বাসায় ছিলেন না। কক্সবাজার থেকে আলাদা জাহাজে করে আসা পরিবারের মালপত্রের বাক্স বুঝে নিতে গেছেন সকিনার ভাই। পিতা-মাতা হারানোর কারণে সকিনা ও তার ভাইবোনের প্রতি আলাদা দরদ অনুভব করেন প্রতিবেশীরা। সকিনা বললেন, কক্সবাজারের ক্যাম্পের পরিবেশ ছিল ঘিঞ্জি। অনেক গরম ছিল। ভাসানচরে প্রশস্ত ঘর। আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এখন এখানে পড়াশোনাটা বেশ ভালোভাবে করতে চান সকিনা।

গতকাল সকালে ভাসানচর ঘুরে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শিশুরা মনের আনন্দে খোলা মাঠে খেলাধুলায় ব্যস্ত। ১০ বছরের রোহিঙ্গা শিশু জাকির হোসেন তার ছোট্ট ভাই ইব্রাহিমকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে ভাসানচর ঘুরে দেখছিল। এ রকম আরও অনেককে দেখা গেল ঘুরে ঘুরে নতুন এই এলাকা দেখছে। তাদের চোখে-মুখে যেন নতুন আশা। নতুন স্বপ্ন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নির্যাতিত-নিপীড়িত বাস্তুহারা এই মানুষগুলো নতুন করে জীবনকে সাজাতে চান।

ভাসানচরে হাঁটতে হাঁটতেই নূর উদ্দিন নামের আরেক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক-১-এ স্ত্রী, শ্যালিকা ও ছোট্ট শিশুসন্তানকে নিয়ে এসেছেন তিনি। নূর উদ্দিন জানান, তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। মাত্র চার দিন আগে ফুটফুটে আরও এক মেয়ের বাবা হয়েছেন তিনি। ছোট্ট মেয়েকে নিয়েই ডাক্তারের কাছে এসেছেন তারা।

ভাসানচরে এরই মধ্যে চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নোয়াখালীর সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের একটি টিম ভাসানচরে রয়েছে। গণস্বাস্থ্যও কাজ করছে। ভাসানচরে দায়িত্ব পালন করছেন গণস্বাস্থ্যের ডা. আরফিন রহমান। তিনি সমকালকে বলেন, দু-এক দিন পার হলে জানা যাবে, ভাসানচরে কী ধরনের রোগী বেশি। শীতে অবশ্য অনেক বাচ্চার সর্দি-জ্বর হয়। সর্দি-জ্বরে আক্রান্তরা ওষুধ নিতে আসছেন।

ভাসানচরে স্থানান্তর হওয়া রোহিঙ্গার মধ্যে খাবার সামগ্রী সরবরাহ, চিকিৎসা এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ২২টি এনজিও। প্রতিটি এনজিওর একাধিক প্রতিনিধি ভাসানচরে অবস্থান করছেন।

সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা স্কাসের চেয়ারপারসন জেসমিন প্রেমা বলেন, রান্না করা খাবার, শীতবস্ত্র, চাল-ডালসহ ২৭টি আইটেম আমরা রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরবরাহ করছি। তার মধ্যে টুথপেস্ট ও নখ কাটার মেশিনও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের নিরাপদ জীবনের কথা চিন্তা করে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাব।

আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীসহ একটি ক্লিনিক ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে। গতকাল একাধিক এনজিও প্রতিনিধি জানান, রোহিঙ্গাদের খাবারদাবারসহ সব ধরনের সহায়তার জন্য তারা প্রস্তুত। আগামীতে এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে। আরও যারা আসবে, তাদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন

x
English Version

বদলে গেছে জীবন: আমরা খুব ভালো আছি, তোমরাও দ্রুত চলে এসো

আপডেট: ০২:১৬:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২০

ভাসানচরের ৭ ও ৮ নম্বর ক্লাস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে গতকাল শনিবার সকালে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভিডিওকলে কথা বলছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। তখন তার কোলে একটি শিশু। তার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ছোট-বড় তিন-চারজনের ছবি ভেসে উঠছিল। পারভীন আক্তার নামের ওই নারী রোহিঙ্গা হলেও তার ভাষা বুঝতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না। নতুন পরিবেশে তার চোখে নতুন স্বপ্ন। তিনি যা বলছিলেন তার প্রমিত বাংলা দাঁড়ায় এ রকম- ‘কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচর অনেক ভালো। এখানে পাকা ঘর। সবকিছু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। বাচ্চাদের খেলার মাঠ আছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও অনেক ভালো। রান্নার জন্যও সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। আমরা ভালো আছি। তোমরাও দ্রুত চলে আসো। এখানে এলে দিন বদলে যাবে।’

ওই রোহিঙ্গা নারী সমকালকে জানান, কক্সবাজারের লেদা ক্যাম্পে থাকা তার খালা সকিনাকে ভাসানচরের অবস্থা সম্পর্কে ফোনে জানাচ্ছিলেন। ভিডিওকলে থাকার ঘরসহ আশপাশের সব স্থাপনা এরই মধ্যে খালাকে দেখিয়েছেন তিনি। এমনকি কক্সবাজারে থাকা স্বামীকেও ভিডিওকল করে ভাসানচর সম্পর্কে অবহিত করেছেন।

শুক্রবার এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গার সঙ্গে পারভীনও কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে এসেছেন। প্রথম রাত নতুন আবাসে কাটানোর পর ভাসানচর সম্পর্কে পারভীনের অভিব্যক্তি হলো, ‘ভাসানচর সম্পর্কে এত দিন যা শুনেছি, এখানে এসে দেখি সার্বিক ব্যবস্থাপনা তার চেয়েও ভালো। কক্সবাজারের ক্যাম্পের তুলনায় ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধা আকাশ-পাতাল ফারাক। এখানে আমাদের জন্য যে এত কিছু করে রাখা হয়েছে, তা আগে ভাবতেও পারিনি। যারা এখনও কক্সবাজারে রয়েছে, তারা দ্রুতই ভাসানচরে চলে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।’

প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের যে দলটি ভাসানচরে এসে অবস্থান করছে, তাদের অভিব্যক্তি জানতে অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় সমকালের এই প্রতিনিধির। তাদের সবার বক্তব্য মোটামুটি এ রকম- কক্সবাজারের তুলনায় ভাসানচর তাদের কাছে স্বর্গ। খোলামেলা জায়গা। বাচ্চারা এক শেল্টার হাউস থেকে অন্য শেল্টার হাউসে দৌড়াদৌড়ি করতে পারছে। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, মাঠসহ কী নেই এখানে! এ ছাড়া পাকা ঘর। ঝড়-বাদলায় ঘরের মধ্যে পানি ওঠার কোনো আশঙ্কা নেই। ভাসানচরের নতুন বসতিতে এসে নতুন এক জীবনের স্বাদ পাচ্ছেন তারা।

রোহিঙ্গা যুবক আমির হোসেন। নিজের ঘরের বারান্দায় সন্তানদের নিয়ে গতকাল সকালে গল্প করছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর আমির হোসেন বললেন, ‘বাংলাদেশ সরকার আমাগো লইগ্যা এত বড় জায়গা দিল। গোডা এলাকায় বিল্ডিং বানাইয়্যা দিল। আমি সরকারের প্রতি খুবই খুশি। বলতে গেলে কক্সবাজারে জঙ্গলে বাস করতাম। এখানকার পরিবেশ পুরো শহরের মতো। এখন অনেক অনেক ভালো আছি, ভাই। অনেক নিরাপদে আছি।’

আমির হোসেন আরও জানান, তিন মেয়ে, চার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাসানচরে এসেছেন তিনি। কক্সবাজারে এখনও তার শ্বশুর, স্ত্রীর বড় বোনসহ পরিবারের ৫০ সদস্য রয়েছেন। তারা ভাসানচর সম্পর্কে খুব বেশি জানতেন না। এ জন্য প্রথম দফায় আসেননি। এখানে আসার পর ফোন করে ভাসানচরের সুন্দর পরিবেশ সম্পর্কে তাদের জানিয়েছি। এখন তারা আফসোস করছেন। এখানে আসতে চাচ্ছেন। কক্সবাজারের ক্যাম্পে নানা ঝুট-ঝামেলা লেগেই থাকত। ভাসানচরে এমন কিছু নেই। এটা দেখে ভালো লাগছে।

সমকালের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় আমিরের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আমির বেশ উচ্চ স্বরেই কক্সবাজারে থাকা স্বজনদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘ঘর থেকে বের হওয়ার পর ভাসানচর আসা পর্যন্ত এক পয়সাও খরচ লাগবে না। পথে নানা ধরনের খাবার দিয়েছে। আসার পর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে যা যা দরকার, সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করতে পারবি। আরামে ঘুমাতে পারবি। আমিরের পাশে দাঁড়ানো কিশোরী জয়নবাও বলছিল যে তারা সবাই খুব ভালো আছে। খোলা মাঠে খেলাধুলাও করা যাচ্ছে।

ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউসে কথা হয় আরেক রোহিঙ্গা কিশোরী সকিনা বেগমের সঙ্গে। বৃদ্ধ নানি নজিবা খাতুনকে নিয়ে নিজের ঘরটা ধোয়ামোছা করছিলেন সকিনা। এই কিশোরীর জীবনের গল্প আসলেই করুণ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে বাবা জামাল হোসেন ও মা সকিলা বেগমকে হারিয়েছেন তিনি। এরপর আত্মীয়দের সঙ্গে সকিনা, তার বড় বোন ও এক ভাই বাংলাদেশে চলে আসেন। সকিনার বড় বোনকে দেখভাল করছেন তাদের খালা শওকত আরা। তিনিও একই ক্লাস্টার হাউসের একটিতে উঠেছেন। সকিনার ভাই তখন বাসায় ছিলেন না। কক্সবাজার থেকে আলাদা জাহাজে করে আসা পরিবারের মালপত্রের বাক্স বুঝে নিতে গেছেন সকিনার ভাই। পিতা-মাতা হারানোর কারণে সকিনা ও তার ভাইবোনের প্রতি আলাদা দরদ অনুভব করেন প্রতিবেশীরা। সকিনা বললেন, কক্সবাজারের ক্যাম্পের পরিবেশ ছিল ঘিঞ্জি। অনেক গরম ছিল। ভাসানচরে প্রশস্ত ঘর। আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এখন এখানে পড়াশোনাটা বেশ ভালোভাবে করতে চান সকিনা।

গতকাল সকালে ভাসানচর ঘুরে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শিশুরা মনের আনন্দে খোলা মাঠে খেলাধুলায় ব্যস্ত। ১০ বছরের রোহিঙ্গা শিশু জাকির হোসেন তার ছোট্ট ভাই ইব্রাহিমকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে ভাসানচর ঘুরে দেখছিল। এ রকম আরও অনেককে দেখা গেল ঘুরে ঘুরে নতুন এই এলাকা দেখছে। তাদের চোখে-মুখে যেন নতুন আশা। নতুন স্বপ্ন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নির্যাতিত-নিপীড়িত বাস্তুহারা এই মানুষগুলো নতুন করে জীবনকে সাজাতে চান।

ভাসানচরে হাঁটতে হাঁটতেই নূর উদ্দিন নামের আরেক রোহিঙ্গা যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক-১-এ স্ত্রী, শ্যালিকা ও ছোট্ট শিশুসন্তানকে নিয়ে এসেছেন তিনি। নূর উদ্দিন জানান, তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। মাত্র চার দিন আগে ফুটফুটে আরও এক মেয়ের বাবা হয়েছেন তিনি। ছোট্ট মেয়েকে নিয়েই ডাক্তারের কাছে এসেছেন তারা।

ভাসানচরে এরই মধ্যে চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নোয়াখালীর সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের একটি টিম ভাসানচরে রয়েছে। গণস্বাস্থ্যও কাজ করছে। ভাসানচরে দায়িত্ব পালন করছেন গণস্বাস্থ্যের ডা. আরফিন রহমান। তিনি সমকালকে বলেন, দু-এক দিন পার হলে জানা যাবে, ভাসানচরে কী ধরনের রোগী বেশি। শীতে অবশ্য অনেক বাচ্চার সর্দি-জ্বর হয়। সর্দি-জ্বরে আক্রান্তরা ওষুধ নিতে আসছেন।

ভাসানচরে স্থানান্তর হওয়া রোহিঙ্গার মধ্যে খাবার সামগ্রী সরবরাহ, চিকিৎসা এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ২২টি এনজিও। প্রতিটি এনজিওর একাধিক প্রতিনিধি ভাসানচরে অবস্থান করছেন।

সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা স্কাসের চেয়ারপারসন জেসমিন প্রেমা বলেন, রান্না করা খাবার, শীতবস্ত্র, চাল-ডালসহ ২৭টি আইটেম আমরা রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরবরাহ করছি। তার মধ্যে টুথপেস্ট ও নখ কাটার মেশিনও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের নিরাপদ জীবনের কথা চিন্তা করে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাব।

আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীসহ একটি ক্লিনিক ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে। গতকাল একাধিক এনজিও প্রতিনিধি জানান, রোহিঙ্গাদের খাবারদাবারসহ সব ধরনের সহায়তার জন্য তারা প্রস্তুত। আগামীতে এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে। আরও যারা আসবে, তাদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।