মার্জিন ঋণ প্রাপ্তিতে ৫০ লাখ টাকার বিনিয়োগ থাকা উচিত: আহমেদ রশিদ লালী

- আপডেট: ০৫:৫৭:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
- / ১০৭১৭ বার দেখা হয়েছে
ব্রোকারেজ হাউজ রশিদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ রশিদ লালী, যিনি একসময় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতিও ছিলেন তিনি। পুঁজিবাজার নিয়ে তাঁর রয়েছে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। সম্প্রতি তিনি এই বাজারের উত্থান-পতনসহ নানা দিক নিয়ে বিজনেস জার্নালের সাথে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ তারেকুজ্জামান। পাঠকদের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুক–টুইটার–লিংকডইন–ইন্সটাগ্রাম–ইউটিউব
বিজনেস জার্নাল: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অবস্থাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাজারের পতনের প্রধান কারণগুলো কী?
আহমেদ রশিদ লালী: পুঁজিবাজার যেভাবে চলছে, সেটাকে কোনোভাবেই ভালো বলা যায় না। বাজার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উপদান প্রয়োজন। যেগুলোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যথেষ্ট আস্থাহীনতা রয়েছে। ২০২১-২০২২ সালের ঘটনাগুলো বর্তমানে এনে সেগুলোতে জরিমানা করা হচ্ছে। বাজারে বড় বড় বিনিয়োগকারী ছিল। যারা বাজারকে সাপোর্ট দিতো। কিন্তু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান কমিশন নিয়োগ পাওয়ার পর, বড় বড় অনেক বিনিয়োগকারীকে বিভিন্ন কারণে জরিমানা করে। এতে করে এসব বিনিয়োগকারী সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নতুন করে তারা বাজারে বিনিয়োগ করতে পারছে না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।
বিজনেস জার্নাল: বর্তমান বাজারে শেয়ারের মূল্যায়ন কি সঠিকভাবে হচ্ছে, নাকি আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যা বেশি?
আহমেদ রশিদ: বর্তমানে আন্ডারভ্যালু শেয়ারের সংখ্যাই বেশি। এর মূল কারণ ফোর্সড সেল। অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী মার্জিন লোন নিয়ে বিভিন্ন শেয়ারে বিনিযোগ করে থাকেন। শেয়ারের দাম যখন কমতে শুরু করে, তখন ব্রোকারেজ হাউজগুলো সেগুলো ফোর্সড সেল করে মার্জিন লোন এডজাস্ট করে। এতে করে এসমস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী লোকসানে পড়ে যান। যেসমস্ত মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজগুলো মার্জিন লোন দেন, তারাও লোকসানে পড়ে যান। তাই মার্জিন লোনের অ্যাক্টটি আরও রিভিউ করা প্রয়োজন। বর্তমান পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স কমিটি মার্জিন লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম করেছে, যেমস্ত বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ১০ লাখ রয়েছে তারাই কেবল মার্জিন লোন পাবেন। কিন্তু আমি এই নিয়মের সাথে একমত নই। কমপক্ষে যাদের বিনিয়োগ ৫০ লাখ টাকা রয়েছে, কেবল তাদেরেই মার্জিন লোন পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
বিজনেস জার্নাল: সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী, এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আহমেদ রশিদ: কোম্পানিগুলো থেকে যেসমস্ত তথ্য প্রকাশ হয়, সেগুলা সবাই একসঙ্গে পায় না। কেউ আগে পায়, আবার কেউ পড়ে পায়। এতে করে গ্যাম্বলাররা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে শেয়ার দরের কারসাজি করে থাকে। তাই কোম্পানিগুলো থেকে যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সকলেই এক সাথে তথ্য পায়, সেব্যাপারে রেগুলেটরকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: বিএসইসির নতুন কমিশন বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজার উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতার ভূমিকা রাখতে পারছে কী? কোনো নীতিগত পরিবর্তন প্রয়োজন কী?
আহমেদ রশিদ: বাজার উন্নয়নে বর্তমান কমিশনের ভূমিকায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তারা আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারতো। এর আগের কমিশন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জর (ডিএসই) অনেক ক্ষমতা নিয়ে গেছে। এতে করে ডিএসই ক্ষমতায়নে দুর্বল হয়েছে। ডিএসইকে দুর্বল করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। কমিশনের অনেক ক্ষমতা ডিরেগুলেট করা উচিত। ডিএসই’র ক্ষমতাগুলো ফিরিয়ে আনা উচিত, মার্কেটের উন্নয়নের স্বার্থে।
তিনি আরও বলেন, বিএসইসি ও ডিএসইতে যে সার্ভিল্যান্স টিম রয়েছে, তারা ২৪ ঘন্টার মধ্যে শেয়ার কারসাজির বিষয়টি প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেটি তারা করতে পারছে না। কারণ সেই ক্ষমতা তাদেরকে দেওয়া হয়নি। ২০২১, ২০২২ সালের কারসাজির ঘটনাগুলোর জরিমানা করা হচ্ছে এখন। অথচ সার্ভিল্যান্স টিমকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হতো, তাহলে তখনই তারা এসমস্ত কারসাজি প্রকাশ করতে পারতো, দোষীদের তখনই শাস্তির আওতায় আনতে পারতো কমিশন।
বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে আস্থার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
আহমেদ রশিদ: পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিযোগকারীদের মধ্যে যথেষ্ট আস্থার ঘাটতি রয়েছে। কমিশন অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিকে জরিমানা করে থাকে, এটা ঠিক না। উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে পারি। অনেকেই আছেন এসপেকুলেশন (অনুমান) করে শেয়ারে বিনিয়োগ করে। সেই শেয়ারের দাম অনেক সময় হু হু করে বেড়ে যায়। কমিশন তখন ম্যানুপুলেটরদের পাশাপাশি যারা এসপেকুলেশন করে শেয়ার কিনেছিল তাদেরকেও শাস্তি দেয়। কমিশনকে ম্যানুপুলেশন ও এসপেকুলেশনের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে হবে, এবং সত্যিকার অর্থে যারা শেয়ার ম্যানুপুলেট করেছে, শুধু তাদেরকেই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট কতটুকু কাজে এসেছে? ডিএসই, সিএসই ও বাজারের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইনটি কি রিভিউ করা উচিত?
আহমেদ রশিদ: ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন অ্যাক্ট খুব একটা কাজে আসেনি। এই অ্যাক্টকে রিভিউ করা উচিত। চাইনিজদেরকে ডিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হযেছে, এবং তাদের একজন পরিচালক স্থায়ীভাবে ডিএসইর বোর্ডে থাকে। আবার যখন ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের ভোট হয়, সেখানে চাইনিজ পরিচালক ভোট দেয়। সাধারণ যে ব্যক্তি চাইনিজদের অনুকূলে কাজ করবে তাকেই তারা ভোট দেয়। এতে করে পরিচালনা পর্ষদে চাইনিজদের আধিপত্য বেশি থাকে। এবিষয়গুলো রিভিউ করা উচিত।
বিজনেস জার্নাল: বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর ব্যবসায়িক অবস্থা কেমন? ইদানিং শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু সিকিউরিটিজ হাউসে কর্মী ছাটাই হচ্ছে, এর কারণ কী?
আহমেদ রশিদ: বর্তমানে অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউজ বিপদে আছে। তারা শেয়ার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে যে আয় করে, তা দিয়ে কর্মীদের বেতন-বোনাস ও অফিসের যাবতীয় খরচের ৫০ শতাংশও মিটাতে পারে না। এমন অবস্থায় অনেক ব্রোকারেজ হাউজের ব্র্যাঞ্চ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্মী ছাটাই হচ্ছে। তাই প্রত্যেকটা ট্রেডিংয়ের বিপরীতে যে এআইটি কাটা হয় তা বর্তমানে ০.০৫ শতাংশ। এটা সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটা হওয়া উচিত ০.০০১ শতাংশ। পাশাপাশি খুব দ্রুত লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যেতে হবে। এসব করা গেলে ব্রোরেজ হাউজগুলো ভালো অবস্থায় যাবে।
বিজনেস জার্নাল: সাম্প্রতিক আইপিওগুলো বাজারে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে? বিনিযোগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিযোগের ঝুঁকি ও সুযোগ কী?
আহমেদ রশিদ: গত এক বছর ধরে পুঁজিবাজারে খুব একটা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আসেনি। এটা মার্কেটের জন্য মোটেই ভালো না। বাজার উন্নয়নে আইপিওর সাপ্লাইটা (সরবরাহ) ঠিক রাখতে হবে। আর আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি খুব একটা নাই। এখানে লাভবান হয়ে, আবার তারা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারেন।
বিজনেস জার্নাল: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কতটা আকর্ষনীয়? তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
আহমেদ রশিদ: বাজারে ভালো মানের শেয়ার ২০টাও হবে কিনা সন্দেহ আছে। হাতে গোনো ৮ থেকে ১০টি শেয়ার ভালো আছে। যেখানে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে পারে। তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হলে, ভালো মানের শেয়ারের লিস্টিং (তালিকাভুক্তি) বাড়াতে হবে। আমাদের দেশের ডলারের রেটটা স্থিতিশীল না। যেকারণে তারা বিনিয়োগ করতে চায় না। তাই ডলারের রেটটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আনতে হবে। পাশাপাশি বিদেশিরা আমাদের জুডিশিয়াল সিস্টেমটা দেখে। জুডিশিয়াল সিস্টেম ভালো না হলে তারা বিনিয়োগ করতে চায় না। তাই এই জুডিশিয়াল সিস্টেমকেও ভালৈা করতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি কিভাবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করছে?
আহমেদ রশিদ: ইনফ্লেশন বা মূল্যস্ফীতি অনেক দেশেই আছে। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইনফ্লেশনের কারণে নতুন নতুন বাজার খোঁজে। এই ইনফ্লেশন কারো জন্য ভালো হয়। আবার কারো জন্য খারাপ হয়।
বিজনেস জার্নাল: নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই বাজারে প্রবেশের উপযুক্ত সময় কী? এবং তাদের কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?
আহমেদ রশিদ: নতুন বিনিয়োগকারীরা যেকোনো সময় বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে সঠিক শেয়ার বাছাই করে বিনিয়োগ করতে হবে। সঠিক শেয়ারে বিনিয়োগ করলে, যেকোনো সময় যেকেউ বিনিয়োগ করতে পারেন। যেসব কোম্পানির পিই রেশিও ভালো অবস্থায় রয়েছে, ডিভিডেন্ড ভালো দেয় ও বোর্ডেও ভালো, অভিজ্ঞ লোক রয়েছে, সেসব কোম্পনিতে বিনিয়োগ করা উচিত।
আরও পড়ুন: বিএসইসিতে শুদ্ধি অভিযান নাকি প্রশাসনিক দূর্বলতা!
বিজনেস জার্নাল: দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বর্তমান বাজারে কী সম্ভাবনা রয়েছে? বিনিয়োগারীরা কীভাবে একটি স্থায়ী কৌশল তৈরি করতে পারে?
আহমেদ রশিদ: দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের এখনই মোক্ষম সময়। এখন যদি কেউ দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে, তবে তিনি অনেক ভালো রেজাল্ট পাবেন, যা অতিতে তিনি পাননি।
তিনি বলেন, স্থায়ী কৌশল বলে কিছু নেই। পুঁজিবাজারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কিছু পরিবর্তন হয়। বিনিয়োগকারীদের কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করে বিনিয়োগ করতে হবে।
তিনি বাজার সম্পর্কে আরও বলেন, যেসব বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) একাউন্ট ফ্রিজ হয়েছে, সেগুলোর একটা সমাধান হওয়া দরকার। আমাদের সেভিংসগুলো সিন্দুকের মধ্যে রয়েছে। এসব সেভিংসগুলো পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেসব কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেও তা দেয়নি, তাদের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।
আহমেদ রশিদ: বিনিয়োগকারীরা যেন মার্জিন লোনে বিনিয়োগ না করে। কোম্পানির পিই রেশিও, উদ্যোক্তাদের দেখে বিনিয়োগ করতে হবে।
বিজনেস জার্নাল: পাঠক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য বিজনেস জার্নালকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আহমেদ রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
ঢাকা/টিএ