০৭:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রাম বন্দরের ভ্যাট ফাঁকি ৪৬২ কোটি টাকা

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:৫১:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর ২০২০
  • / ৪১৬০ বার দেখা হয়েছে

সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন সেবা আয়ের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর প্রায় ৪৬২ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো সরকারি সংস্থার এমন বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকিতে এনবিআর কর্মকর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে এ বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেবার বিপরীতে যে ভ্যাট আদায় হয়, তা সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান, দাখিলপত্র ও ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি দিতে পোর্ট অথরিটিকে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কাগজপত্র দেয়। পরে চাহিদামতো আরও কাগজপত্র দিতে একই বছরের ১৯ নভেম্বর আবার চিঠি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় দলিলাদি দাখিল করে।

নিরীক্ষা দল বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি, দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) প্রভৃতি পর্যালোচনা করে। এছাড়া ২৪ আগস্ট বন্দর কর্তৃপক্ষের শুনানি নেওয়া হয়। পরে আড়াআড়ি যাচাই করে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত পর্যালোচনা করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। চলতি ৩ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা দল চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ১৯৯১ ও একই আইনের বিধিমালা অনুযায়ী মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি (মূসক চালান-১১, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র) সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সেবা প্রদানের বিপরীতে বিক্রয় হিসাব পুস্তক সংরক্ষণ করে না, যা মূসক আইনের ধারা ৩১ ও বিধি ২২ লঙ্ঘন।

প্রতিষ্ঠানের খরচের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রায় ৬৯ ধরনের সেবা গ্রহণ করেছে, যার বিপরীতে ৫, ৯ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে প্রযোজ্য উৎসে ভ্যাট ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৬ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৬৫ লাখ ২৪ হাজার ৬১৯ টাকা বেশি কর্তন করেছে। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১০ কোটি ৯৮ লাখ ১২ হাজার ৪২২ টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২১ কোটি ৭৭ লাখ ৯২ হাজার ৩২৮ টাকা বেশি কর্তন করেছে। অর্থাৎ তিন অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি মোট ৩৬ কোটি ৪১ লাখ ২৯ হাজার ৩৬৮ টাকার অতিরিক্ত কর্তন করেছে। অতিরিক্ত কর্তনের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যয়ের খাতের মূল্যকে মূসকসহ মূল্য ধরে তা থেকে মূসক আরোপযোগ্য মূল্য বের করে তা থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বের করা হয়েছে। সে কারণে এ টাকা বেশি। কিন্তু উৎসে কর্তন করা ভ্যাট প্রতিষ্ঠানের সেবা মূল্যের বিপরীতে পরিশোধিত কোনো মূল্য সংযোজন কর নয়। উৎসে কর্তন করা মূসক মূলত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা গ্রহণের বিপরীতে জোগানদারের কাছ থেকে উৎসে কর্তন করে রাখা ভ্যাট। ফলে এ ভ্যাট ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চবক-এর হ্যান্ডলিং ঠিকাদার ও বার্থ অপারেটরদের বিল থেকে জোগানদার হিসেবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। এ নিয়ে ২০০৮ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট হয়। সে রিট অনুযায়ী চবক বোর্ড সভায় ১২ হ্যান্ডলিং ঠিকাদার ও বার্থ অপারেটরদের থেকে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে চার শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন সময় এ মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১০ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়। রিট পিটিশনের কারণে কিছু খাতে বর্তমান নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত প্রযোজ্য ভ্যাট ২৯ কোটি ৫১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩০ টাকা। আদর্শ হারে (১৫ শতাংশ) প্রযোজ্য ভ্যাট ৮০ কোটি ৬৫ হাজার ৩৩২ টাকা। সে হিসেবে বকেয়া ভ্যাট ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬০২ টাকা। ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, রিট নিষ্পত্তি হলে বন্দরকে এ ভ্যাট আদায় করতে হবে।

প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র পর্যালোচনা করে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৫-১৬ অর্থবছর সেবা প্রদানের বিপরীতে ২১০ কোটি ৩০ লাখ পাঁচ হাজার ২৮১ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। একই অর্থবছর প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা খরচের উপর ৪০ কোটি ৬৩ হাজার ৪২৫ টাকার উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেছে। অপরদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর সেবা প্রদানের বিপরীতে ২৫৪ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ৮৪৯ টাকা ভ্যাট ও ৫৩ কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার ৩০৯ টাকা উৎসে ভ্যাট এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৭২ কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার ৭০ টাকা ভ্যাট ও ৭৭ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯০ টাকা উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেছে। তিন অর্থবছর সেবা ও প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের বিপরীতে মোট ৯০৮ কোটি ৭৬ লাখ ৯২ হাজার ৫২৩ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেছে। ভ্যাট পরিশোধ করলেও তা সেবা বিক্রয়ের তথ্য দাখিলপত্রে উল্লেখ না করায় মূসক আইন লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বন্দরের রপ্তানি পণ্য চালানের বিপরীতের বিভিন্ন হ্যান্ডলিং চার্জ, বন্দর চার্জ ও কন্টেইনার ভাড়ার সেবামূল্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করা হয়, যাতে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবা বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর ভ্যাট হিসাব করা হয়, যাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বন্দরের আয় হিসেবে দেখা যায়, বার্থ হেয়ার চার্জ, ক্রেন চার্জ, গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জ, পোর্ট ডিউ অন ব্যাসেল, পোর্ট ডিউ অব কান্ট্রি ক্র্যাপ্ট, হেয়ার অন মোরিং, ব্রেদিং চার্জসহ প্রায় ৪০ ধরনের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। ওই অর্থবছর ৪০ ধরনের সেবার উপর প্রযোজ্য ভ্যাট ২৯৮ কোটি ৭৭ লাখ তিন হাজার ৫৯১ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২১০ কোটি ৩০ লাখ পাঁচ হাজার ২৮১ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করলেও ৮৮ কোটি ৪৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩১০ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি।

একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর একই সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৩৫১ কোটি ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫১১ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২৫৪ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ৮৪৯ টাকা পরিশোধ করলেও ৯৭ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬২ টাকা পরিশোধ করেনি। ২০১৭-১৮ অর্থবছর প্রযোজ্য ভ্যাট ৩৯১ কোটি ৭৮ লাখ ৮২ হাজার ৬১৪ টাকা। ২৭২ কোটি ২৪ লাখ ৬১ হাজার ৭০ টাকা পরিশোধ করলেও ১১৯ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৫ টাকা পরিশোধ করেনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর অর্থাৎ তিন অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রযোজ্য ভ্যাট এক হাজার ৪১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭১৬ টাকার মধ্যে ৩০৪ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ৫১৬ টাকা পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।

মূসক আইন অনুযায়ী অপরিশোধিত ভ্যাটের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য। ফলে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদ ১৫৭ কোটি ২৯ লাখ তিন হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সুদসহ চবক-এর অপরিশোধিত ভ্যাট ৪৬২ কোটি ২৮ লাখ ৩২ হাজার ১০০ টাকা। এ ভ্যাট আদায়ে ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে যাতে সঠিকভাবে ভ্যাট পরিশোধ করে তা নজরদারি করতে সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে হ্যান্ডেলিং ও বার্থ অপারেটরদের বকেয়া ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬০২ টাকাসহ হিসেব করলে মোট ভ্যাট ফাঁকি দাঁড়ায় ৫১২ কোটি ৭৭ লাখ ২৫ হাজার ৭০২ টাকা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা মামলার কোনো কাগজ এখনও পাইনি। পেলে আমাদের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট রয়েছে তারা দেখবে।’ ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে ফাঁকির কোনো বিষয় না। এটা তো কোনো ব্যক্তি না। সরকারি টু সরকারি প্রতিষ্ঠান। কোনো কারণে হিসাবে ভুল হয়ে থাকলে তা বন্দর কর্তৃপক্ষ দেখবে।’

সূত্র: শেয়ারবিজ

 

পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির সর্বশেষ সবাদ পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ‘বিজনেস জার্নাল

ও ফেসবুক গ্রুপ ‘ডিএসই-সিএসই আপডেট’ এর সাথে সংযুক্ত থাকুন।

ট্যাগঃ

শেয়ার করুন

x
English Version

চট্টগ্রাম বন্দরের ভ্যাট ফাঁকি ৪৬২ কোটি টাকা

আপডেট: ১১:৫১:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর ২০২০

সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন সেবা আয়ের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর প্রায় ৪৬২ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো সরকারি সংস্থার এমন বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকিতে এনবিআর কর্মকর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, দেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে এ বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেবার বিপরীতে যে ভ্যাট আদায় হয়, তা সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান, দাখিলপত্র ও ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি দিতে পোর্ট অথরিটিকে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কাগজপত্র দেয়। পরে চাহিদামতো আরও কাগজপত্র দিতে একই বছরের ১৯ নভেম্বর আবার চিঠি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় দলিলাদি দাখিল করে।

নিরীক্ষা দল বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি, দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) প্রভৃতি পর্যালোচনা করে। এছাড়া ২৪ আগস্ট বন্দর কর্তৃপক্ষের শুনানি নেওয়া হয়। পরে আড়াআড়ি যাচাই করে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত পর্যালোচনা করে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়। চলতি ৩ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা দল চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ১৯৯১ ও একই আইনের বিধিমালা অনুযায়ী মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি (মূসক চালান-১১, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র) সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সেবা প্রদানের বিপরীতে বিক্রয় হিসাব পুস্তক সংরক্ষণ করে না, যা মূসক আইনের ধারা ৩১ ও বিধি ২২ লঙ্ঘন।

প্রতিষ্ঠানের খরচের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রায় ৬৯ ধরনের সেবা গ্রহণ করেছে, যার বিপরীতে ৫, ৯ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে প্রযোজ্য উৎসে ভ্যাট ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৬ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৬৫ লাখ ২৪ হাজার ৬১৯ টাকা বেশি কর্তন করেছে। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১০ কোটি ৯৮ লাখ ১২ হাজার ৪২২ টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২১ কোটি ৭৭ লাখ ৯২ হাজার ৩২৮ টাকা বেশি কর্তন করেছে। অর্থাৎ তিন অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি মোট ৩৬ কোটি ৪১ লাখ ২৯ হাজার ৩৬৮ টাকার অতিরিক্ত কর্তন করেছে। অতিরিক্ত কর্তনের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যয়ের খাতের মূল্যকে মূসকসহ মূল্য ধরে তা থেকে মূসক আরোপযোগ্য মূল্য বের করে তা থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বের করা হয়েছে। সে কারণে এ টাকা বেশি। কিন্তু উৎসে কর্তন করা ভ্যাট প্রতিষ্ঠানের সেবা মূল্যের বিপরীতে পরিশোধিত কোনো মূল্য সংযোজন কর নয়। উৎসে কর্তন করা মূসক মূলত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা গ্রহণের বিপরীতে জোগানদারের কাছ থেকে উৎসে কর্তন করে রাখা ভ্যাট। ফলে এ ভ্যাট ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চবক-এর হ্যান্ডলিং ঠিকাদার ও বার্থ অপারেটরদের বিল থেকে জোগানদার হিসেবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। এ নিয়ে ২০০৮ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট হয়। সে রিট অনুযায়ী চবক বোর্ড সভায় ১২ হ্যান্ডলিং ঠিকাদার ও বার্থ অপারেটরদের থেকে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে চার শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন সময় এ মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১০ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়। রিট পিটিশনের কারণে কিছু খাতে বর্তমান নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত প্রযোজ্য ভ্যাট ২৯ কোটি ৫১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩০ টাকা। আদর্শ হারে (১৫ শতাংশ) প্রযোজ্য ভ্যাট ৮০ কোটি ৬৫ হাজার ৩৩২ টাকা। সে হিসেবে বকেয়া ভ্যাট ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬০২ টাকা। ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, রিট নিষ্পত্তি হলে বন্দরকে এ ভ্যাট আদায় করতে হবে।

প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র পর্যালোচনা করে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৫-১৬ অর্থবছর সেবা প্রদানের বিপরীতে ২১০ কোটি ৩০ লাখ পাঁচ হাজার ২৮১ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। একই অর্থবছর প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা খরচের উপর ৪০ কোটি ৬৩ হাজার ৪২৫ টাকার উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেছে। অপরদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর সেবা প্রদানের বিপরীতে ২৫৪ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ৮৪৯ টাকা ভ্যাট ও ৫৩ কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার ৩০৯ টাকা উৎসে ভ্যাট এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৭২ কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার ৭০ টাকা ভ্যাট ও ৭৭ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯০ টাকা উৎসে ভ্যাট পরিশোধ করেছে। তিন অর্থবছর সেবা ও প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের বিপরীতে মোট ৯০৮ কোটি ৭৬ লাখ ৯২ হাজার ৫২৩ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেছে। ভ্যাট পরিশোধ করলেও তা সেবা বিক্রয়ের তথ্য দাখিলপত্রে উল্লেখ না করায় মূসক আইন লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বন্দরের রপ্তানি পণ্য চালানের বিপরীতের বিভিন্ন হ্যান্ডলিং চার্জ, বন্দর চার্জ ও কন্টেইনার ভাড়ার সেবামূল্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করা হয়, যাতে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবা বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর ভ্যাট হিসাব করা হয়, যাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বন্দরের আয় হিসেবে দেখা যায়, বার্থ হেয়ার চার্জ, ক্রেন চার্জ, গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জ, পোর্ট ডিউ অন ব্যাসেল, পোর্ট ডিউ অব কান্ট্রি ক্র্যাপ্ট, হেয়ার অন মোরিং, ব্রেদিং চার্জসহ প্রায় ৪০ ধরনের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। ওই অর্থবছর ৪০ ধরনের সেবার উপর প্রযোজ্য ভ্যাট ২৯৮ কোটি ৭৭ লাখ তিন হাজার ৫৯১ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২১০ কোটি ৩০ লাখ পাঁচ হাজার ২৮১ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করলেও ৮৮ কোটি ৪৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩১০ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি।

একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর একই সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৩৫১ কোটি ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫১১ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ২৫৪ কোটি ২০ লাখ ২০ হাজার ৮৪৯ টাকা পরিশোধ করলেও ৯৭ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬২ টাকা পরিশোধ করেনি। ২০১৭-১৮ অর্থবছর প্রযোজ্য ভ্যাট ৩৯১ কোটি ৭৮ লাখ ৮২ হাজার ৬১৪ টাকা। ২৭২ কোটি ২৪ লাখ ৬১ হাজার ৭০ টাকা পরিশোধ করলেও ১১৯ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৫ টাকা পরিশোধ করেনি। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর অর্থাৎ তিন অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রযোজ্য ভ্যাট এক হাজার ৪১ কোটি ৯৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭১৬ টাকার মধ্যে ৩০৪ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ৫১৬ টাকা পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।

মূসক আইন অনুযায়ী অপরিশোধিত ভ্যাটের ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য। ফলে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদ ১৫৭ কোটি ২৯ লাখ তিন হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। সুদসহ চবক-এর অপরিশোধিত ভ্যাট ৪৬২ কোটি ২৮ লাখ ৩২ হাজার ১০০ টাকা। এ ভ্যাট আদায়ে ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে যাতে সঠিকভাবে ভ্যাট পরিশোধ করে তা নজরদারি করতে সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে হ্যান্ডেলিং ও বার্থ অপারেটরদের বকেয়া ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬০২ টাকাসহ হিসেব করলে মোট ভ্যাট ফাঁকি দাঁড়ায় ৫১২ কোটি ৭৭ লাখ ২৫ হাজার ৭০২ টাকা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা মামলার কোনো কাগজ এখনও পাইনি। পেলে আমাদের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট রয়েছে তারা দেখবে।’ ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে ফাঁকির কোনো বিষয় না। এটা তো কোনো ব্যক্তি না। সরকারি টু সরকারি প্রতিষ্ঠান। কোনো কারণে হিসাবে ভুল হয়ে থাকলে তা বন্দর কর্তৃপক্ষ দেখবে।’

সূত্র: শেয়ারবিজ

 

পুঁজিবাজার ও অর্থনীতির সর্বশেষ সবাদ পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজ ‘বিজনেস জার্নাল

ও ফেসবুক গ্রুপ ‘ডিএসই-সিএসই আপডেট’ এর সাথে সংযুক্ত থাকুন।