০২:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চুপিসারে দায়মুক্তি পেলেন পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০৫:৪১:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ ২০২১
  • / ৪২০৮ বার দেখা হয়েছে

হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) নাম। এই প্রতিষ্ঠানে এক সময় চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মােয়াজ্জেম হােসেন, তাকে পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবেও ধরা হয়। অনেকটা চুপিসারে গেল মাসে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে সেই মোয়াজ্জেমকে অব্যাহতি দিয়েছে দুদক। 

এম মোয়াজ্জেম হোসেন কেবল পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবেই পরিচিত নয়, আলোচিত এই কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা হিসেবেও তার নাম আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটে মােয়াজ্জেম হােসেনের নাম উঠে এসেছে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর জবানবন্দিতে। উজ্জ্বল কুমারের দাবি পিপলস লিজিং থেকে ক্যাপ্টেম মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকরা বিভিন্নভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

অথচ সেই মেয়াজ্জেমকে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনেকটা চুপিসারে মোয়াজ্জেমসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্ত করেছে দুদক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণের নামে গ্রাহকের কয়েক শত কোটি টাকা আত্মসাত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ছিল এম মােয়াজ্জেম হােসেনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এমন একটি অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর সই করা এমন একটি আদেশের কপি ঢাকা পোস্টের হাতে রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে,  পিপলস লিজিংয়ের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও পরিচালক ক্যাপ্টেন এম মােয়াজ্জেম হােসেন ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত না হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তা পরিসমাপ্ত করা হয়েছে। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইদ মাহাবুব খানের স্বাক্ষরে এমন আদেশ দেওয়া হয়। যার নথি নং-০০.০১.০০০০.৪১১.০১.০০৫.১৯।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কী কারণে ওই অভিযোগ পরিসমাপ্ত হয়েছে এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া মানে এই নয় যে তিনি পুরোপুরি মুক্ত। পিপলস লিজিং সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চলমান, সেখানে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পিপলস লিজিংয়ের সর্বশেষ চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেখানে পিপলস লিজিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেন, পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আমিসহ বর্তমান পর্ষদ একাই দায়ী নয়। আগের পর্ষদও দায়ী। পিপলস লিজিং থেকে সাবেক পর্ষদের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেম মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকরা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া মানে এই নয় যে তিনি পুরোপুরি মুক্ত। পিপলস লিজিং সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চলমান, সেখানে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক

২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিপল লিজিংয়ে লিজ, ঋণ ও অ্যাডভান্স খাতের আর্থিক বিবরণীতে ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয় উল্লেখ করে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ভুয়া ও অস্তিত্বহীন লিজ ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ১৯১ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টার্ম লোন ২০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছিল। ২৫ কোটি টাকার ট্রেজারি লোন আর্থিক বিবরণী থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। কল লোন ও ওভার ড্রাফট ৭৪ কোটি টাকা কম দেখানো হয়েছিল। সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটে পিপলস লিজিং থেকে ৫ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে ট্রানজেকশন হলে এ ফাইলটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।

উজ্জ্বল কুমার আদালতে বলেন, জেনিথ অ্যান্ড জেফার মূলত কাগুজে প্রতিষ্ঠান; যা ছিল সামসুল আলামিন গ্রুপের এবং এর পক্ষে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ছিল ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের। গ্রীন রোডের ৬৬ কাঠা জমি ক্রয়ের জন্য আগাম হিসেবে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ২০১০ সালের দিকে পিপলস লিজিং থেকে ১২৩ কোটি টাকা গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা দিয়ে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম এবং সামসুল আলামিন তাদের পিপলস লিজিংয়ের ঋণগুলো অ্যাডজাস্ট করেন। মূলত জমি ক্রয়ে দালালি করে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ১২ কোটি টাকা এবং সামসুল আলামিন ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনও উল্লেখ রয়েছে। 

পিপলস লিজিংয়ের বিষয়ে জবানবন্দিতে আরও বলা হয়, ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে নিজেরা ভাগ বাটোয়ারা করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ পরিচালকরা। ফলে এ সময়ে সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা এবং দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গর্ভনর, জিএম শাহ আলমসহ অন্যদের ১ কোটি টাকা করে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়া ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্বিক কার্যক্রম নিরীক্ষা করে হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং। ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী পিপলস লিজিংয়ের ২০১৪ সালে পর্ষদের ২৭২তম বৈঠকে সর্বোচ্চ ৩৩ লাখ ২৭ হাজার ১২৮ টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য উঠে আসে। যে সময়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন।

এরই মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রায় ১৬০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলায় শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের পরিচালক শামসুল আরেফিন আলামিন, তার স্ত্রী ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক নাসরিন আরেফিন আলম, শামসুল আরেফিন আলামিনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক হুমায়রা আলামিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হলেও সেখানে নাম নেই মোয়াজ্জেমের।

এর আগে ২৫ জানুয়ারি পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ৫টি মামলা করে দুদক। 

পি কে হালদার ইস্যুতে এখন পর্যন্ত সহযোগী হিসেবে ৬২ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদার পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে ৩৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। গেল ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল। এ কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গ্রেফতার হয়েছেন ৭ জন। যাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছাড়াও পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী ও রাশেদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০১৯ সালে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার 
অর্থ পাচারের মামলা মাথায় নিয়ে ২০১৯ সালে বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার; যদিও পি কে হালদার যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন সে অনুরোধ জানিয়ে  পুলিশের বিশেষ শাখাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তবে চিঠি পৌঁছানোর দুই ঘণ্টা ৯ মিনিট আগেই ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন পি কে হালদার। ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে এ তথ্য জানিয়েছে। 

 

আরও পড়ুন:

শেয়ার করুন

x
English Version

চুপিসারে দায়মুক্তি পেলেন পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান

আপডেট: ০৫:৪১:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ ২০২১

হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযুক্ত পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) নাম। এই প্রতিষ্ঠানে এক সময় চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মােয়াজ্জেম হােসেন, তাকে পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবেও ধরা হয়। অনেকটা চুপিসারে গেল মাসে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে সেই মোয়াজ্জেমকে অব্যাহতি দিয়েছে দুদক। 

এম মোয়াজ্জেম হোসেন কেবল পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবেই পরিচিত নয়, আলোচিত এই কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা হিসেবেও তার নাম আছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটে মােয়াজ্জেম হােসেনের নাম উঠে এসেছে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর জবানবন্দিতে। উজ্জ্বল কুমারের দাবি পিপলস লিজিং থেকে ক্যাপ্টেম মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকরা বিভিন্নভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

অথচ সেই মেয়াজ্জেমকে দুর্নীতির একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনেকটা চুপিসারে মোয়াজ্জেমসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ পরিসমাপ্তি বা নথিভুক্ত করেছে দুদক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণের নামে গ্রাহকের কয়েক শত কোটি টাকা আত্মসাত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ছিল এম মােয়াজ্জেম হােসেনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এমন একটি অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর সই করা এমন একটি আদেশের কপি ঢাকা পোস্টের হাতে রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে,  পিপলস লিজিংয়ের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও পরিচালক ক্যাপ্টেন এম মােয়াজ্জেম হােসেন ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত না হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তা পরিসমাপ্ত করা হয়েছে। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইদ মাহাবুব খানের স্বাক্ষরে এমন আদেশ দেওয়া হয়। যার নথি নং-০০.০১.০০০০.৪১১.০১.০০৫.১৯।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কী কারণে ওই অভিযোগ পরিসমাপ্ত হয়েছে এ মুহূর্তে মনে নেই। তবে একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া মানে এই নয় যে তিনি পুরোপুরি মুক্ত। পিপলস লিজিং সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চলমান, সেখানে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পিপলস লিজিংয়ের সর্বশেষ চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেখানে পিপলস লিজিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেন, পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আমিসহ বর্তমান পর্ষদ একাই দায়ী নয়। আগের পর্ষদও দায়ী। পিপলস লিজিং থেকে সাবেক পর্ষদের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেম মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকরা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন।

একটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া মানে এই নয় যে তিনি পুরোপুরি মুক্ত। পিপলস লিজিং সংক্রান্ত আরও অনুসন্ধান চলমান, সেখানে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক

২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিপল লিজিংয়ে লিজ, ঋণ ও অ্যাডভান্স খাতের আর্থিক বিবরণীতে ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয় উল্লেখ করে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ভুয়া ও অস্তিত্বহীন লিজ ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ১৯১ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টার্ম লোন ২০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছিল। ২৫ কোটি টাকার ট্রেজারি লোন আর্থিক বিবরণী থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। কল লোন ও ওভার ড্রাফট ৭৪ কোটি টাকা কম দেখানো হয়েছিল। সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটে পিপলস লিজিং থেকে ৫ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে ট্রানজেকশন হলে এ ফাইলটি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে।

উজ্জ্বল কুমার আদালতে বলেন, জেনিথ অ্যান্ড জেফার মূলত কাগুজে প্রতিষ্ঠান; যা ছিল সামসুল আলামিন গ্রুপের এবং এর পক্ষে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ছিল ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের। গ্রীন রোডের ৬৬ কাঠা জমি ক্রয়ের জন্য আগাম হিসেবে পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ২০১০ সালের দিকে পিপলস লিজিং থেকে ১২৩ কোটি টাকা গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা দিয়ে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম এবং সামসুল আলামিন তাদের পিপলস লিজিংয়ের ঋণগুলো অ্যাডজাস্ট করেন। মূলত জমি ক্রয়ে দালালি করে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ১২ কোটি টাকা এবং সামসুল আলামিন ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনও উল্লেখ রয়েছে। 

পিপলস লিজিংয়ের বিষয়ে জবানবন্দিতে আরও বলা হয়, ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে নিজেরা ভাগ বাটোয়ারা করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ পরিচালকরা। ফলে এ সময়ে সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা এবং দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গর্ভনর, জিএম শাহ আলমসহ অন্যদের ১ কোটি টাকা করে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়া ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্বিক কার্যক্রম নিরীক্ষা করে হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং। ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী পিপলস লিজিংয়ের ২০১৪ সালে পর্ষদের ২৭২তম বৈঠকে সর্বোচ্চ ৩৩ লাখ ২৭ হাজার ১২৮ টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য উঠে আসে। যে সময়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন।

এরই মধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রায় ১৬০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলায় শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের পরিচালক শামসুল আরেফিন আলামিন, তার স্ত্রী ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক নাসরিন আরেফিন আলম, শামসুল আরেফিন আলামিনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও লিজিংয়ের সাবেক পরিচালক হুমায়রা আলামিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হলেও সেখানে নাম নেই মোয়াজ্জেমের।

এর আগে ২৫ জানুয়ারি পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ৫টি মামলা করে দুদক। 

পি কে হালদার ইস্যুতে এখন পর্যন্ত সহযোগী হিসেবে ৬২ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদার পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে ৩৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। গেল ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল। এ কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গ্রেফতার হয়েছেন ৭ জন। যাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছাড়াও পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী ও রাশেদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০১৯ সালে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার 
অর্থ পাচারের মামলা মাথায় নিয়ে ২০১৯ সালে বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার; যদিও পি কে হালদার যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন সে অনুরোধ জানিয়ে  পুলিশের বিশেষ শাখাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তবে চিঠি পৌঁছানোর দুই ঘণ্টা ৯ মিনিট আগেই ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন পি কে হালদার। ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে এ তথ্য জানিয়েছে। 

 

আরও পড়ুন: