০৩:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
আড়াই বছর আগের অবস্থানে পুঁজিবাজার

বাজার উন্নয়নে বিএসইসির উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা

এইচ কে জনি:
  • আপডেট: ০৬:২৪:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৪৫১৭ বার দেখা হয়েছে

পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। বরং দিনের পর দিন পুঁজিবাজারের লেনদেন এর আগের সময়ের তুলনায় তলানিতেই নামছে। শুধু তাই নয়, বাজার উন্নয়নে বিএসইসির বর্তমান কমিশনের নানামূখী পদক্ষেপের পরও আজ সোমবার পুঁজিবাজার ফিরে গেছে প্রায় আড়াই বছর আগের অবস্থানে। পরিণতিতে বিএসইসির নতুন কমিশনের কর্তা-ব্যাক্তিদের আশ্বাসে যেসব বিনিয়োগকারী বুক ভরা আশা নিয়ে নতুন করে কষ্টার্জিত পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা আজ সব হারিয়ে নি:স্ব হওয়ার পথে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

তবে পরিতাপের বিষয় বাজার নিয়ে যারা এতোদিন নানা মাইলফলক অর্জনের গাল-গপ্প করেছিলেন, বাজারের করুন পরিস্থিতিতে তাদের আজ খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর সংগঠন ঢাকা ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) অন্য সব স্টেকহোল্ডাররা বাজারের এ ক্রান্তিলগ্নে রয়েছেন  নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকায়। বিষয়টি এমন হয়েছে যে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার কোন লোকই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ডিএসইর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রোববার বড়দিনের ছুটির পর সোমবার প্রথম কর্মদিবসে সূচক পতনের সঙ্গে লেনদেন নামল ২০০ কোটির নিচে। এর আগে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ২২৭ কোটি ৭৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকার শেয়ার। সেটি ছিল ২০২০ সালের ১৬ জুলাইয়ের পর সর্বনিম্ন লেনদেন।

আরও পড়ুন: শতাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ৬০ কোটি টাকা জরিমানা

তলানিতে নামলেও গত দুই বছরে লেনদেন ২০০ কোটির নিচে নামেনি, কিন্তু সোমবার হাতবদল হয় ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, যা চলতি বছরের তো বটেই, গত ২ বছর ৫ মাসে সর্বনিম্ন।

এর চেয়ে কমল লেনদেন হয়েছিল ২০২০ সালের ৭ জুলাই। ওই দিন হাতবদল হয়েছিল ১৩৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

অর্ধেকের কিছু বেশি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত আসার দিন বুধবার লেনদেন ছিল ৩৩৩ কোটি ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। বৃহস্পতিবার লেনদেন কমে ১০৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার টাকা বা ৩১.৭২ শতাংশ। সোমবার সেটি কমল ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ৫ হাজার টাকা বা ১২.৭০ শতাংশ।

অথচ, বাজারের স্থিতিশীলতায় নতুন কমিশনের পদক্ষেপও কম ছিল না।  বিশেষ করে চলতি বছরের বিএসইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ফ্লোর প্রাইস আরোপ। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারের দাম কমানো ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এ ধরনের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের পুঁজিবাজারে না থাকলেও দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বহাল রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন: আইপিও ইস্যুতে ধীরে চলো নীতিতে বিএসইসি: কমেছে অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ

এতোসব পদক্ষেপের সুফল কি পেয়েছে দেশের পুঁজিবাজার তথা বিনিয়োগকারীরা- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস জার্নালকে জানান, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব্য নেয়ার পর থেকে বিভিন্ন আইনের সংশোধন, রোডশো, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন, ‘আইপিও প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনসহ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে যে এসব পদক্ষেপের সুফল পুঁজিবাজার পেয়েছে কি না! তবে হ্যা বর্তমান সময়ে বাজার অবনতির কারণ হিসেবে যেসব বিষয়গুলোকে সামনে আনা হচ্ছে যেমন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সঙ্কট কিংবা মূল্যস্ফীতি এগুলোকে একপাশে রেখেও যদি বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এসব সঙ্কটের মধ্যেওতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ব্যাংকক কিংবা অন্যান্য পুঁজিবাজার ভালো করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ মাত্র ১৯৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। বহুবছর আগেও লেনদেনের এমন করুন অবস্থা ছিল না। অথচ এ সময়ে মুলধন বাড়ানোর নামে নতুন করে ৬০টির মতো ট্রেক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কি লাভ হয়েছে? তবে আশা করছি বাজারের সঙ্কট উত্তোরণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অবশ্যই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিবেন।’

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিবিএ’র ভূমিকা কি জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক এ পরিচালক বলেন, ‘বাজারে কিংবা ব্রোকারদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ডিবিএর বর্তমান পর্ষদ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ন দাবি-দাওয়া নিয়েও কমিশনের সাথে বসেছেন। অনেকগুলোর প্রত্যাশিত রেজাল্ট পেয়েছেন, আবার অনেকগুলোর পাননি। তবে ডিবিএ বাজার উন্নয়নে যথেষ্ঠ আন্তরিক।’

তবে বর্তমান সময়ে ফ্লোর প্রাইজকে বাজারের জন্য গলার কাটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইজ বহাল রেখে বাজারের জন্য ভালো কিছু আশা করা সম্ভব না।’

আরও পড়ুন: ৯ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে ২২ কোম্পানি

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস জার্নালকে বলেন, ‘বাজার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর সুফল কখনো কখনো স্বল্পমেয়াদে আবার কখনও দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায়। অদূর ভবিষ্যতে দেশের পুঁজিবাজারও এর সুফল পাবে।’

বাজারে বর্তমানে তারল্য সঙ্কট রয়েছে উল্লেখ করে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, ‘বাজারের তারল্য প্রবাহ বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সহযোগীতা ছাড়া শুধুমাত্র সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দিয়ে এ সঙ্কট দূর করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কমিশন তাদেরকে যদি কোন পলিসিগত সাপোর্ট দিয়ে বিনিয়োগে ফেরানো যায়, তবে বিএসইসি সেটাও করবে।’

আরও পড়ুন: বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রকট আকার ধারণ করছে সঙ্কট

তবে কি বাজারের বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, ‘ঠিক নিষ্ক্রিয় আছে- তা নয়। চলতি বছর শেষ হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। আপনি জানেন যে, এ সময়ে অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্লোজিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এছাড়াও সমাপ্ত বছরে তাদের আন রিয়েলাইজ্ড গেইনের ওপর প্রভিশনিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলো শেষ করতে হয়। হয়তো সে কারনেই তাদের বিনিয়োগটা আর আগের মতো নেই। তবে নতুন বছরের শুরুতেই তারা বিনিয়োগে ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র পুঁজিবাজারই নয়, দেশের অর্থনীতির সবগুলো সূচকসহ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতেই মন্দা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সঙ্কট, মূল্যস্ফীতিসহ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বাজারের এ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই বিনিয়োগকারীদেরকে প্যানিকড না হয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও ধৈর্য্যশীল হতে হবে। বিশেষ করে বাজারের এমন ক্রান্তিকালে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে আশা উচিত’- বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এছাড়া সবার জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) শেয়ার নিশ্চিত করার  লটারি প্রথা বাতিল, ব্যাংকের বিনিয়োগ-সীমার গণনা শেয়ারের বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করার দাবি বাস্তবায়ন, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বেশ কিছু কোম্পানিতে পুনরায় উৎপাদন শুরু, যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোকে ডি লিস্টিং করিয়ে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ, কোম্পানিগুলোকে স্টক ডিভিডেন্ডের বদলে ক্যাশ ডিভিডেন্ডে দিতে অনুপ্রাণিত করা, সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেন ও বন্ড মার্কেট উন্নয়নেও কমিশনের ভূমিকা রয়েছে।

পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বাজারে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে বছরজুড়েই কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে ছিল বিএসইসি। সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কারণে বিভিন্ন কারসাজি চক্রের সদস্যদের মোটা অঙ্কের জরিমানা ও পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে কমিশন।

আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা

বিএসইসির উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হচ্ছে- চলতি বছরের বিএসইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ফ্লোর প্রাইস আরোপ। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারের দাম কমানো ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এ ধরনের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের পুঁজিবাজারে না থাকলেও দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বহাল রাখা হয়েছে।

এছাড়া বছরজুড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা, জাপানে ভার্চুয়ালি রোড শো আয়োজন করা, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পুরস্কার- ২০২২ প্রদান, বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ পুনর্বহাল রাখা; এসএমই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহজ করা, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনে সহায়তা, সিএসইর স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবিজিকে অনুমোদন, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট ফান্ড (ইটিএফ) ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠনে আইন প্রণয়ন, বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) মাধ্যমে ফেরত প্রদান, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনার সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব বা ভীতি ছড়ানো কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ, শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করা ও বোনাস শেয়ার অনুমোদনের ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি।

শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে বিএসইসি একাধিক দেশে রোডশো’ও করেছে।

বিজনেস জার্নাল/ঢাকা/এইচকে

শেয়ার করুন

x
English Version

আড়াই বছর আগের অবস্থানে পুঁজিবাজার

বাজার উন্নয়নে বিএসইসির উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা

আপডেট: ০৬:২৪:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২

পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। বরং দিনের পর দিন পুঁজিবাজারের লেনদেন এর আগের সময়ের তুলনায় তলানিতেই নামছে। শুধু তাই নয়, বাজার উন্নয়নে বিএসইসির বর্তমান কমিশনের নানামূখী পদক্ষেপের পরও আজ সোমবার পুঁজিবাজার ফিরে গেছে প্রায় আড়াই বছর আগের অবস্থানে। পরিণতিতে বিএসইসির নতুন কমিশনের কর্তা-ব্যাক্তিদের আশ্বাসে যেসব বিনিয়োগকারী বুক ভরা আশা নিয়ে নতুন করে কষ্টার্জিত পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা আজ সব হারিয়ে নি:স্ব হওয়ার পথে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

তবে পরিতাপের বিষয় বাজার নিয়ে যারা এতোদিন নানা মাইলফলক অর্জনের গাল-গপ্প করেছিলেন, বাজারের করুন পরিস্থিতিতে তাদের আজ খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর সংগঠন ঢাকা ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) অন্য সব স্টেকহোল্ডাররা বাজারের এ ক্রান্তিলগ্নে রয়েছেন  নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকায়। বিষয়টি এমন হয়েছে যে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার কোন লোকই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ডিএসইর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রোববার বড়দিনের ছুটির পর সোমবার প্রথম কর্মদিবসে সূচক পতনের সঙ্গে লেনদেন নামল ২০০ কোটির নিচে। এর আগে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ২২৭ কোটি ৭৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকার শেয়ার। সেটি ছিল ২০২০ সালের ১৬ জুলাইয়ের পর সর্বনিম্ন লেনদেন।

আরও পড়ুন: শতাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ৬০ কোটি টাকা জরিমানা

তলানিতে নামলেও গত দুই বছরে লেনদেন ২০০ কোটির নিচে নামেনি, কিন্তু সোমবার হাতবদল হয় ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, যা চলতি বছরের তো বটেই, গত ২ বছর ৫ মাসে সর্বনিম্ন।

এর চেয়ে কমল লেনদেন হয়েছিল ২০২০ সালের ৭ জুলাই। ওই দিন হাতবদল হয়েছিল ১৩৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

অর্ধেকের কিছু বেশি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত আসার দিন বুধবার লেনদেন ছিল ৩৩৩ কোটি ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। বৃহস্পতিবার লেনদেন কমে ১০৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার টাকা বা ৩১.৭২ শতাংশ। সোমবার সেটি কমল ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ৫ হাজার টাকা বা ১২.৭০ শতাংশ।

অথচ, বাজারের স্থিতিশীলতায় নতুন কমিশনের পদক্ষেপও কম ছিল না।  বিশেষ করে চলতি বছরের বিএসইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ফ্লোর প্রাইস আরোপ। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারের দাম কমানো ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এ ধরনের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের পুঁজিবাজারে না থাকলেও দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বহাল রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন: আইপিও ইস্যুতে ধীরে চলো নীতিতে বিএসইসি: কমেছে অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ

এতোসব পদক্ষেপের সুফল কি পেয়েছে দেশের পুঁজিবাজার তথা বিনিয়োগকারীরা- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস জার্নালকে জানান, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব্য নেয়ার পর থেকে বিভিন্ন আইনের সংশোধন, রোডশো, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন, ‘আইপিও প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনসহ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে যে এসব পদক্ষেপের সুফল পুঁজিবাজার পেয়েছে কি না! তবে হ্যা বর্তমান সময়ে বাজার অবনতির কারণ হিসেবে যেসব বিষয়গুলোকে সামনে আনা হচ্ছে যেমন: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সঙ্কট কিংবা মূল্যস্ফীতি এগুলোকে একপাশে রেখেও যদি বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ এসব সঙ্কটের মধ্যেওতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ব্যাংকক কিংবা অন্যান্য পুঁজিবাজার ভালো করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ মাত্র ১৯৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। বহুবছর আগেও লেনদেনের এমন করুন অবস্থা ছিল না। অথচ এ সময়ে মুলধন বাড়ানোর নামে নতুন করে ৬০টির মতো ট্রেক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কি লাভ হয়েছে? তবে আশা করছি বাজারের সঙ্কট উত্তোরণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অবশ্যই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিবেন।’

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিবিএ’র ভূমিকা কি জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক এ পরিচালক বলেন, ‘বাজারে কিংবা ব্রোকারদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ডিবিএর বর্তমান পর্ষদ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ন দাবি-দাওয়া নিয়েও কমিশনের সাথে বসেছেন। অনেকগুলোর প্রত্যাশিত রেজাল্ট পেয়েছেন, আবার অনেকগুলোর পাননি। তবে ডিবিএ বাজার উন্নয়নে যথেষ্ঠ আন্তরিক।’

তবে বর্তমান সময়ে ফ্লোর প্রাইজকে বাজারের জন্য গলার কাটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইজ বহাল রেখে বাজারের জন্য ভালো কিছু আশা করা সম্ভব না।’

আরও পড়ুন: ৯ হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পেয়েছে ২২ কোম্পানি

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস জার্নালকে বলেন, ‘বাজার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর সুফল কখনো কখনো স্বল্পমেয়াদে আবার কখনও দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায়। অদূর ভবিষ্যতে দেশের পুঁজিবাজারও এর সুফল পাবে।’

বাজারে বর্তমানে তারল্য সঙ্কট রয়েছে উল্লেখ করে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, ‘বাজারের তারল্য প্রবাহ বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সহযোগীতা ছাড়া শুধুমাত্র সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দিয়ে এ সঙ্কট দূর করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কমিশন তাদেরকে যদি কোন পলিসিগত সাপোর্ট দিয়ে বিনিয়োগে ফেরানো যায়, তবে বিএসইসি সেটাও করবে।’

আরও পড়ুন: বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রকট আকার ধারণ করছে সঙ্কট

তবে কি বাজারের বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, ‘ঠিক নিষ্ক্রিয় আছে- তা নয়। চলতি বছর শেষ হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। আপনি জানেন যে, এ সময়ে অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্লোজিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এছাড়াও সমাপ্ত বছরে তাদের আন রিয়েলাইজ্ড গেইনের ওপর প্রভিশনিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলো শেষ করতে হয়। হয়তো সে কারনেই তাদের বিনিয়োগটা আর আগের মতো নেই। তবে নতুন বছরের শুরুতেই তারা বিনিয়োগে ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করছি।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র পুঁজিবাজারই নয়, দেশের অর্থনীতির সবগুলো সূচকসহ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতেই মন্দা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সঙ্কট, মূল্যস্ফীতিসহ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বাজারের এ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই বিনিয়োগকারীদেরকে প্যানিকড না হয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও ধৈর্য্যশীল হতে হবে। বিশেষ করে বাজারের এমন ক্রান্তিকালে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে আশা উচিত’- বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এছাড়া সবার জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) শেয়ার নিশ্চিত করার  লটারি প্রথা বাতিল, ব্যাংকের বিনিয়োগ-সীমার গণনা শেয়ারের বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করার দাবি বাস্তবায়ন, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বেশ কিছু কোম্পানিতে পুনরায় উৎপাদন শুরু, যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোকে ডি লিস্টিং করিয়ে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ, কোম্পানিগুলোকে স্টক ডিভিডেন্ডের বদলে ক্যাশ ডিভিডেন্ডে দিতে অনুপ্রাণিত করা, সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেন ও বন্ড মার্কেট উন্নয়নেও কমিশনের ভূমিকা রয়েছে।

পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বাজারে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে বছরজুড়েই কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে ছিল বিএসইসি। সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কারণে বিভিন্ন কারসাজি চক্রের সদস্যদের মোটা অঙ্কের জরিমানা ও পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে কমিশন।

আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা

বিএসইসির উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হচ্ছে- চলতি বছরের বিএসইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ফ্লোর প্রাইস আরোপ। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারের দাম কমানো ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এ ধরনের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের পুঁজিবাজারে না থাকলেও দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বহাল রাখা হয়েছে।

এছাড়া বছরজুড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা, জাপানে ভার্চুয়ালি রোড শো আয়োজন করা, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পুরস্কার- ২০২২ প্রদান, বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ পুনর্বহাল রাখা; এসএমই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহজ করা, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনে সহায়তা, সিএসইর স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবিজিকে অনুমোদন, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট ফান্ড (ইটিএফ) ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠনে আইন প্রণয়ন, বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) মাধ্যমে ফেরত প্রদান, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনার সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব বা ভীতি ছড়ানো কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ, শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করা ও বোনাস শেয়ার অনুমোদনের ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি।

শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে বিএসইসি একাধিক দেশে রোডশো’ও করেছে।

বিজনেস জার্নাল/ঢাকা/এইচকে