০১:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

ম্যারাডোনা চলে গেলেন না ফেরার দেশে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ১১:০১:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০
  • / ৪১৪৬ বার দেখা হয়েছে

জীবনের খেলা শেষ! পার্থিব সব বন্ধন কাটিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনা। রেখে গেলেন এক মহাকাব্যিক ইতিহাস। যাবার বেলায় কাঁদিয়ে গেলেন কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থককে। ম্যারাডোনা শুধু ‘আর্জেন্টিনা’ বা ‘বিশ্বকাপজয়ী’ ফুটবলারের নাম ছিল না। কোনো দেশ বা সীমানায় আটকে ছিল না তার আবির্ভাব। তিনি ছিলেন মনোমুগ্ধকারী এক বিশ্বব্রহ্মচারী।

জীবনে উৎসবের দিন, আয়োজনের দিন নির্ধারণ সম্ভব। কিন্তু অনিবার্য আঘাতের নয়। সেই আঘাতই এলো গতকাল রাতে আর্জেন্টিনার তিগ্রে থেকে। নিজের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে চিরবিদায় নিয়ে গেলেন ফুটবলের অমর জাদুকর। তিনি ছিলেন ফুটবল আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। আবার ব্যক্তি মানুষ হিসেবে অনন্য এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। অসাধারণ হয়েও তিনি হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ অতি প্রিয়জন। যার সঙ্গে তাকে জীবনভর তুলনা করে গেছেন সবাই, সেই পেলে তার পরম বন্ধুর মৃত্যুতে চোখ মুছলেন- টুইটারে লিখলেন- ‘একদিন আকাশে ফুটবল খেলব আমরা।’ সেখানেও কি সেই তর্কটা চলবে? ফুটবল ইতিহাসে কে সেরা- ফুটবলের রাজপুত্র পেলে, নাকি ফুটবলের ঈশ্বর ‘ম্যারাডোনা’?

বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার লোক তো তিনি নন। মনের জোরে ভেতরের অসুস্থতা চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। তারপরও পরিবার থেকে বুয়েন্স আয়ার্সের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল তার মস্তিস্কে। একটু সুস্থ হতেই ফের বাড়ি ফেরার বায়না। আট দিন হাসপাতালে কাটিয়ে অ্যালকোহলের আসক্তি দূর করতে রিহ্যাবেও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ম্যারাডোনা। ফুটবল পায়ে দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ে জীবনে কত ডিফেন্ডারকে কাটিয়েছেন, ডি-বক্সে প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে কতশত গোল করেছেন! কিন্তু এবার আর পারলেন না মৃত্যুকে ঠেকাতে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তিনি মনোমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে, যার ছোঁয়া লেগেছিল এই বাংলাদেশেও। মূলত ওই বিশ্বকাপ থেকেই, ওই প্রজন্ম থেকেই এ দেশে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পতাকা ওঠে ছাদে। ম্যারাডোনার ওই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটি আইকনিক হয়ে ওঠে। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও তিনি আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু সেরা হতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর কোচিং শুরু করেছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মেসিদেরও কোচ ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফি জেতাতে পারেননি।

আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস এক প্রতিবেদনে জানায়, বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন ম্যারাডোনা। এই অসুস্থতা থেকে আর ফিরতে পারেননি তিনি। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যম কারিনও এই কিংবদন্তির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ক্লাদিও তাপিয়া শোকবার্তায় বলেছেন, আমাদের কিংবদন্তির মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা- সব সময় তুমি আমাদের হৃদয়ে থাকবে।

আর দেখা যাবে না চিরচেনা হাসিমুখ কিংবা কোনো ডাগআউট আর ফুটবলের মিলনমেলায়। চলে গেলেন পরপারে, রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি আর অর্জন। যে খাতা উল্টেপাল্টে দেখেও শেষ করা যাবে না। কখনও ক্লাব, কখনও নিজ দেশ আবার কখনও কোচ হয়ে- তিন অঙ্গনে ছিল তার সমান বিচরণ। জিতেছেন, জিতিয়েছেন; লিখেছেন কত রূপকথার কাব্য! এমন দিনে সেসবে চোখ দিলে হয়তো মনেও হবে না, এই ধরায় নেই আর ফুটবল ঈশ্বর।

রাতের আকাশে তাকালে আমরা যে তারাগুলো দেখতে পাই, তাদের অনেকেরই জীবন ফুরিয়ে গেছে বহু বছর আগে। আমাদের থেকে তারাগুলো এতই দূরে যে, তাদের কারও কারও আলো আমাদের এই গ্রহে এসে পৌঁছতে লেগে যায় কয়েক হাজার বছর। তাই নিভে যাওয়ার মুহূর্তেই তার শরীর থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে, সে আলো কয়েক হাজার বছর নেবে আমাদের এই পৃথিবীতে এসে পড়তে। ভাবলে অবাকই লাগে, হয়তো এমন অনেক মৃত তারাদের আলোতেই আজও সেজে ওঠে আমাদের গ্রহের আকাশ। তাদের মৃত্যুর পরও তাদের আলো ছুটতে থাকে মহাকাশের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে। তাই মৃত্যু মানেই অনস্তিত্ব নয়, মৃত্যু মানেই অনুপস্থিতি নয়। অন্তত নক্ষত্রদের বেলায় তো তা নয়ই। ম্যারাডোনা ফুটবলেরই তেমনই এক নক্ষত্র, যিনি সশরীরে সরে গেলেও তার আলো এসে আমাদের কাছে পৌঁছবে আরও অগণন বছর ধরে।

আর্জেন্টিনার হয়ে

দীর্ঘ ক্যারিয়ার; সেই শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, এরপর ধীরে ধীরে আরও পরিণত হওয়া। সবই যে তার ফুটবল ঘিরেই। তার মধ্যে দেশের জার্সিতে সবচেয়ে বর্ণিল সময়টা ছিল তার ১৯৮৬। ম্যাজিক্যাল একটা বছর- যে বছরটা ইতিহাসে লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। শুধু এই ম্যারাডোনার জন্যই। হয়তো রয়েছে নানা কথা, নানা বিতর্ক। কিন্তু দিন শেষে এই ‘৮৬-এর মধ্য দিয়েই আর্জেন্টিনাকে তিনি উপহার দেন বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা। বড় এই প্রাপ্তির সঙ্গে তার জীবনের বাঁকও বদলে যায়। যে ম্যারাডোনাকে নির্দিষ্ট একটা অঞ্চল বা একটা অংশ চিনেছিল, সেদিনের পর থেকে সারাবিশ্বের মানুষের মনে গেঁথে যায় তার নাম।

ক্লাবের জার্সিতে

ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি লম্বা সময় ছিলেন ন্যাপোলি আর বার্সেলোনায়। এ দুই ক্লাব ছাড়াও বোকা জুনিয়র্স, ওল্ড বয়েজ ও সেভিয়ার হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন তিনি। তবে প্রাপ্তির মালা খুব একটা পরা হয়নি এই অঙ্গনে এসে। ন্যাপোলির হয়ে জিতেছেন দু’বার লিগ শিরোপা, একবার করে ইতালিয়ান কাপ, ইতালিয়ান সুপার কাপ আর উয়েফা কাপ। বার্সার হয়ে একটি করে স্প্যানিশ কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও স্প্যানিশ লিগ কাপ জিতেছেন তিনি।

কোচ হিসেবে

বুটজোড়া তুলে রাখার পর ম্যারাডোনা মন দেন কোচিংয়ে। এখানটায়ও খুব একটা সফলতা পাননি। তবে অল্পদিনে বেশ কয়েকটি ক্লাবে তার পা পড়ে। যার মধ্যে ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল অবধি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে শূন্যহাতে বিদায় নিয়ে যোগ দেন আমিরাতের ক্লাবে; সেখানেও আলো ছড়াতে ব্যর্থ হন ম্যারাডোনা। অল্পদিনের মাথায় নতুন ঠিকানা আর্জেন্টিনার ক্লাব দেপোর্তিভোর সহকারী কোচ হিসেবে। ভালো লাগেনি তার আরেকজনের অধীনে থাকতে। ছেড়ে চলে যান মেক্সিকোতে। সেখাকার নামকরা ক্লাব দোরাদোসের কোচ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু মনের মতো দল সাজাতে না পেরে ২০১৯ সালের দিকে আবারও দেশে ফেরেন। এবার স্বদেশি ক্লাব জিমনেশিয়ার হয়ে কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে দলকে সেভাবে সাফল্য এনে দিতে না পারলেও সময়ের সঙ্গে পালল্গা দিয়ে বাড়তে থাকে তার সুনাম। ক্লাবের মালিকও তাকে আপন করে নেন। তবে শরীরটা যেন আর এগোতে চায় না। যত দিন যায়, তত বাড়ে নানা ব্যাধি। সর্বশেষ মস্তিস্কের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে সফল অস্ত্রোপচারও হয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে আর প্রাণের ক্লাব জিমনেশিয়ায় ফেরা হয়নি ফুটবল সম্রাটের।

পারিবারিক জীবন

বুয়েন্স আয়ার্সের কাছে ছোট্ট শহর লানুসে ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। গরিব বাবা-মায়ের ঘরে চার মেয়ের পর জন্ম নেন দিয়েগো। মাত্র আট বছর বয়সে একটি ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা থেকে প্রথম ক্লাব এস্তেলা রোজা তাকে বেছে নেয়। তার পর থেকে আর কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। ১৯৮৪ সালের ৭ নভেম্বর ক্লদিয়া ভিলাফানেকে বিয়ে করেন ম্যারাডোনা। তাদের সংসারে দুই কন্যা ডালমা নিরিয়া এবং জিয়ানিয়া দিনরো। কিন্তু ক্লদিয়ার সঙ্গে ২০০৪ সালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার। এরপরই অনিয়ন্ত্রিত জীবন শুরু হয়। ইতালির ন্যাপোলিতে খেলার সময়ই বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময় বান্ধবীর সঙ্গে আদালতেও যেতে হয়েছে তাকে। তবে চার্চে গিয়ে আর কাউকেই কখনও বিয়ের আংটি পরাননি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কোকেনে আসক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে বার্সেলোনায় খেলার সময় প্রথম ড্রাগ নিয়ে ধরা পড়েন। এক সময় ১৩০ কেজি ওজন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে।

রাজনৈতিক দর্শন

আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মিনিমের সঙ্গে সক্ষতা থেকেই বাম রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন ম্যারাডোনা। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তার কাছের বন্ধু। তিনি তার প্রতি এতটাই অনুগত ছিলেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্তও তার বাঁ-হাতে কাস্ত্রো আর ডান হাতে চে গুয়েভারার ট্যাটু অঁহ্নাকা ছিল। সারাবিশ্বের নির্যাতিতদের প্রতি আর একটা আপন ভালোবাসা ছিল। তার এই রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে সে দেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

শেয়ার করুন

x
English Version

ম্যারাডোনা চলে গেলেন না ফেরার দেশে

আপডেট: ১১:০১:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর ২০২০

জীবনের খেলা শেষ! পার্থিব সব বন্ধন কাটিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনা। রেখে গেলেন এক মহাকাব্যিক ইতিহাস। যাবার বেলায় কাঁদিয়ে গেলেন কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থককে। ম্যারাডোনা শুধু ‘আর্জেন্টিনা’ বা ‘বিশ্বকাপজয়ী’ ফুটবলারের নাম ছিল না। কোনো দেশ বা সীমানায় আটকে ছিল না তার আবির্ভাব। তিনি ছিলেন মনোমুগ্ধকারী এক বিশ্বব্রহ্মচারী।

জীবনে উৎসবের দিন, আয়োজনের দিন নির্ধারণ সম্ভব। কিন্তু অনিবার্য আঘাতের নয়। সেই আঘাতই এলো গতকাল রাতে আর্জেন্টিনার তিগ্রে থেকে। নিজের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে চিরবিদায় নিয়ে গেলেন ফুটবলের অমর জাদুকর। তিনি ছিলেন ফুটবল আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। আবার ব্যক্তি মানুষ হিসেবে অনন্য এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। অসাধারণ হয়েও তিনি হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ অতি প্রিয়জন। যার সঙ্গে তাকে জীবনভর তুলনা করে গেছেন সবাই, সেই পেলে তার পরম বন্ধুর মৃত্যুতে চোখ মুছলেন- টুইটারে লিখলেন- ‘একদিন আকাশে ফুটবল খেলব আমরা।’ সেখানেও কি সেই তর্কটা চলবে? ফুটবল ইতিহাসে কে সেরা- ফুটবলের রাজপুত্র পেলে, নাকি ফুটবলের ঈশ্বর ‘ম্যারাডোনা’?

বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার লোক তো তিনি নন। মনের জোরে ভেতরের অসুস্থতা চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। তারপরও পরিবার থেকে বুয়েন্স আয়ার্সের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল তার মস্তিস্কে। একটু সুস্থ হতেই ফের বাড়ি ফেরার বায়না। আট দিন হাসপাতালে কাটিয়ে অ্যালকোহলের আসক্তি দূর করতে রিহ্যাবেও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ম্যারাডোনা। ফুটবল পায়ে দুর্দান্ত ড্রিবলিংয়ে জীবনে কত ডিফেন্ডারকে কাটিয়েছেন, ডি-বক্সে প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে কতশত গোল করেছেন! কিন্তু এবার আর পারলেন না মৃত্যুকে ঠেকাতে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তিনি মনোমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে, যার ছোঁয়া লেগেছিল এই বাংলাদেশেও। মূলত ওই বিশ্বকাপ থেকেই, ওই প্রজন্ম থেকেই এ দেশে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পতাকা ওঠে ছাদে। ম্যারাডোনার ওই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটি আইকনিক হয়ে ওঠে। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও তিনি আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু সেরা হতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর কোচিং শুরু করেছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মেসিদেরও কোচ ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফি জেতাতে পারেননি।

আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস এক প্রতিবেদনে জানায়, বুধবার স্থানীয় সময় বিকেলে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন ম্যারাডোনা। এই অসুস্থতা থেকে আর ফিরতে পারেননি তিনি। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যম কারিনও এই কিংবদন্তির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ক্লাদিও তাপিয়া শোকবার্তায় বলেছেন, আমাদের কিংবদন্তির মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা- সব সময় তুমি আমাদের হৃদয়ে থাকবে।

আর দেখা যাবে না চিরচেনা হাসিমুখ কিংবা কোনো ডাগআউট আর ফুটবলের মিলনমেলায়। চলে গেলেন পরপারে, রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি আর অর্জন। যে খাতা উল্টেপাল্টে দেখেও শেষ করা যাবে না। কখনও ক্লাব, কখনও নিজ দেশ আবার কখনও কোচ হয়ে- তিন অঙ্গনে ছিল তার সমান বিচরণ। জিতেছেন, জিতিয়েছেন; লিখেছেন কত রূপকথার কাব্য! এমন দিনে সেসবে চোখ দিলে হয়তো মনেও হবে না, এই ধরায় নেই আর ফুটবল ঈশ্বর।

রাতের আকাশে তাকালে আমরা যে তারাগুলো দেখতে পাই, তাদের অনেকেরই জীবন ফুরিয়ে গেছে বহু বছর আগে। আমাদের থেকে তারাগুলো এতই দূরে যে, তাদের কারও কারও আলো আমাদের এই গ্রহে এসে পৌঁছতে লেগে যায় কয়েক হাজার বছর। তাই নিভে যাওয়ার মুহূর্তেই তার শরীর থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে, সে আলো কয়েক হাজার বছর নেবে আমাদের এই পৃথিবীতে এসে পড়তে। ভাবলে অবাকই লাগে, হয়তো এমন অনেক মৃত তারাদের আলোতেই আজও সেজে ওঠে আমাদের গ্রহের আকাশ। তাদের মৃত্যুর পরও তাদের আলো ছুটতে থাকে মহাকাশের দীর্ঘ রাস্তা পেরিয়ে। তাই মৃত্যু মানেই অনস্তিত্ব নয়, মৃত্যু মানেই অনুপস্থিতি নয়। অন্তত নক্ষত্রদের বেলায় তো তা নয়ই। ম্যারাডোনা ফুটবলেরই তেমনই এক নক্ষত্র, যিনি সশরীরে সরে গেলেও তার আলো এসে আমাদের কাছে পৌঁছবে আরও অগণন বছর ধরে।

আর্জেন্টিনার হয়ে

দীর্ঘ ক্যারিয়ার; সেই শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, এরপর ধীরে ধীরে আরও পরিণত হওয়া। সবই যে তার ফুটবল ঘিরেই। তার মধ্যে দেশের জার্সিতে সবচেয়ে বর্ণিল সময়টা ছিল তার ১৯৮৬। ম্যাজিক্যাল একটা বছর- যে বছরটা ইতিহাসে লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। শুধু এই ম্যারাডোনার জন্যই। হয়তো রয়েছে নানা কথা, নানা বিতর্ক। কিন্তু দিন শেষে এই ‘৮৬-এর মধ্য দিয়েই আর্জেন্টিনাকে তিনি উপহার দেন বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা। বড় এই প্রাপ্তির সঙ্গে তার জীবনের বাঁকও বদলে যায়। যে ম্যারাডোনাকে নির্দিষ্ট একটা অঞ্চল বা একটা অংশ চিনেছিল, সেদিনের পর থেকে সারাবিশ্বের মানুষের মনে গেঁথে যায় তার নাম।

ক্লাবের জার্সিতে

ক্লাব ক্যারিয়ারে তিনি লম্বা সময় ছিলেন ন্যাপোলি আর বার্সেলোনায়। এ দুই ক্লাব ছাড়াও বোকা জুনিয়র্স, ওল্ড বয়েজ ও সেভিয়ার হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন তিনি। তবে প্রাপ্তির মালা খুব একটা পরা হয়নি এই অঙ্গনে এসে। ন্যাপোলির হয়ে জিতেছেন দু’বার লিগ শিরোপা, একবার করে ইতালিয়ান কাপ, ইতালিয়ান সুপার কাপ আর উয়েফা কাপ। বার্সার হয়ে একটি করে স্প্যানিশ কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও স্প্যানিশ লিগ কাপ জিতেছেন তিনি।

কোচ হিসেবে

বুটজোড়া তুলে রাখার পর ম্যারাডোনা মন দেন কোচিংয়ে। এখানটায়ও খুব একটা সফলতা পাননি। তবে অল্পদিনে বেশ কয়েকটি ক্লাবে তার পা পড়ে। যার মধ্যে ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল অবধি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে শূন্যহাতে বিদায় নিয়ে যোগ দেন আমিরাতের ক্লাবে; সেখানেও আলো ছড়াতে ব্যর্থ হন ম্যারাডোনা। অল্পদিনের মাথায় নতুন ঠিকানা আর্জেন্টিনার ক্লাব দেপোর্তিভোর সহকারী কোচ হিসেবে। ভালো লাগেনি তার আরেকজনের অধীনে থাকতে। ছেড়ে চলে যান মেক্সিকোতে। সেখাকার নামকরা ক্লাব দোরাদোসের কোচ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু মনের মতো দল সাজাতে না পেরে ২০১৯ সালের দিকে আবারও দেশে ফেরেন। এবার স্বদেশি ক্লাব জিমনেশিয়ার হয়ে কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে দলকে সেভাবে সাফল্য এনে দিতে না পারলেও সময়ের সঙ্গে পালল্গা দিয়ে বাড়তে থাকে তার সুনাম। ক্লাবের মালিকও তাকে আপন করে নেন। তবে শরীরটা যেন আর এগোতে চায় না। যত দিন যায়, তত বাড়ে নানা ব্যাধি। সর্বশেষ মস্তিস্কের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে সফল অস্ত্রোপচারও হয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে আর প্রাণের ক্লাব জিমনেশিয়ায় ফেরা হয়নি ফুটবল সম্রাটের।

পারিবারিক জীবন

বুয়েন্স আয়ার্সের কাছে ছোট্ট শহর লানুসে ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। গরিব বাবা-মায়ের ঘরে চার মেয়ের পর জন্ম নেন দিয়েগো। মাত্র আট বছর বয়সে একটি ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা থেকে প্রথম ক্লাব এস্তেলা রোজা তাকে বেছে নেয়। তার পর থেকে আর কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। ১৯৮৪ সালের ৭ নভেম্বর ক্লদিয়া ভিলাফানেকে বিয়ে করেন ম্যারাডোনা। তাদের সংসারে দুই কন্যা ডালমা নিরিয়া এবং জিয়ানিয়া দিনরো। কিন্তু ক্লদিয়ার সঙ্গে ২০০৪ সালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার। এরপরই অনিয়ন্ত্রিত জীবন শুরু হয়। ইতালির ন্যাপোলিতে খেলার সময়ই বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময় বান্ধবীর সঙ্গে আদালতেও যেতে হয়েছে তাকে। তবে চার্চে গিয়ে আর কাউকেই কখনও বিয়ের আংটি পরাননি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কোকেনে আসক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে বার্সেলোনায় খেলার সময় প্রথম ড্রাগ নিয়ে ধরা পড়েন। এক সময় ১৩০ কেজি ওজন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে।

রাজনৈতিক দর্শন

আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মিনিমের সঙ্গে সক্ষতা থেকেই বাম রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন ম্যারাডোনা। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তার কাছের বন্ধু। তিনি তার প্রতি এতটাই অনুগত ছিলেন, মৃত্যুর আগে পর্যন্তও তার বাঁ-হাতে কাস্ত্রো আর ডান হাতে চে গুয়েভারার ট্যাটু অঁহ্নাকা ছিল। সারাবিশ্বের নির্যাতিতদের প্রতি আর একটা আপন ভালোবাসা ছিল। তার এই রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে সে দেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।