০১:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

অর্থাভাবে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি বন্ধ পেট্রোবাংলার

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০১:১৫:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২
  • / ৪১৭৫ বার দেখা হয়েছে

ফাইল ফটো

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: দুই সপ্তাহ ধরে আবারো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম এখন ৪০ ডলার ছুঁইছুঁই। তবে শুধু পণ্যটির উচ্চমূল্যই নয়, স্পট থেকে এলএনজি কিনতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তারও যোগাড় করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এ পরিস্থিতিতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে এসেছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি পণ্যটির দাম না কমা পর্যন্ত দেশীয় উৎস থেকেই চাহিদা পূরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অস্বাভাবিক হারে এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আগস্ট থেকে স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি না করার সাময়িক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রিডে যে পরিমাণ গ্যাস ঘাটতি হবে তা দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে জোগান দেয়ার চেষ্টা করা হবে। এজন্য বেশ কয়েকটি কূপে ওয়ার্কওভার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

স্পট মার্কেট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম কার্গো আমদানি করে বাংলাদেশ। সেই সময় প্রতি এমএমবিটিইউ ৪-৫ ডলার দামে কেনা হয়। সে সময় এক কার্গো এলএনজি কিনতে ৩০০-৩৫০ কোটি টাকা খরচ হতো। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে এক কার্গো এলএনজি কিনতে তিন-চার গুণ বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে। স্পট মার্কেটে জ্বালানি পণ্যটির দামের অস্থিতিশীলতা প্রভাব ফেলেছে পেট্রোবাংলার ওপরও। পণ্যটি কিনতে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান করতে পারছে না সংস্থাটি। এক বছর ধরে এলএনজির দাম পরিশোধে অর্থ বিভাগের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে সংস্থাটি। চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বিভাগ টাকাও দিতে পারছে না পেট্রোবাংলাকে। সর্বশেষ গত মে মাসে অর্থ বিভাগ গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে এলএনজি কেনার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে পেট্রোবাংলাকে। শর্ত সাপেক্ষে পেট্রোবাংলাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ অর্থ দেয়া হয়েছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এলএলজির দামে যে অস্থিরতা তাতে স্পট থেকে পণ্যটি আমদানির সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। যতটুকু আমদানি না করলেই নয়, সেই পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হবে। আগামীতে বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাস পেলে এলএনজির আমদানি বাড়ানো যাবে। গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য স্পট থেকে যে পরিমাণ এলএনজি আমরা আমদানি করছি, সেই পরিমাণ গ্যাস দেশীয় উৎস থেকে পূরণের চেষ্টা করছি। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এরই মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং কয়েকটি কূপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি কয়েকটি কূপ থেকে স্বল্পমেয়াদে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস অনুসন্ধানেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

মহামারীর অভিঘাত-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদার কারণে গত বছরের শেষার্ধে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বাড়তে থাকে। স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে সে সময় পেট্রোবাংলার ব্যয় হয় প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্ট করে। একপর্যায়ে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ৫৫ ডলারের ওপরে উঠে যায়। জ্বালানি পণ্যটির দাম পরবর্তী সময়ে ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। স্পট মার্কেটে এলএনজির দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বজায় ছিল। এরপর দুই মাস ধরে জ্বালানি পণ্যটির দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যদিও সর্বশেষ দুই সপ্তাহে এলএনজির দাম আবারো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে।

এশিয়ার স্পট মার্কেটে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির গড় মূল্য ছিল ২২ ডলার ৪০ সেন্ট করে। জ্বালানির বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এশিয়ার বাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ ডলারে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়েও জ্বালানি পণ্যটি ২৩ ডলারের কাছাকাছি দামে বিক্রি হয়েছিল। বাজারের এ অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে জ্বালানি পণ্যটির দাম আরো বেড়ে যাবে বলে আভাস দিচ্ছে এসঅ্যান্ডপি।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির পর এলএনজির দাম কমতে থাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কার্গো কেনে পেট্রোবাংলা। এ সময় দামের পতন হওয়ায় পর পর কয়েক মাস এলএনজি ক্রয়ে সাশ্রয়ীও হয় পেট্রোবাংলা। তবে জুনের শেষ সপ্তাহে স্পট মার্কেটে ফের ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। এ অবস্থায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি বিভাগ।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আমদানিনির্ভর দেশগুলো পড়েছে চরম বিপাকে। ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ, দামে অস্থিরতার কারণে আমদানিকারক দেশগুলো বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আগামীতে জ্বালানির বাজার অস্থিরতা আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতায় ক্রমেই চাপ তৈরি হচ্ছে দেশের জ্বালানি খাতেও। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে ডিজেল ও অকটেন বিক্রিতে দৈনিক ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অন্যদিকে, এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী স্পট মার্কেট থেকে কেনা যাচ্ছে না এলএনজি। তার প্রভাবও পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে।

দেশের গ্যাসের সংকট থাকায় প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিষয়টি এড়িয়ে যায়নি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (বিপিডিবি)। গত ২৮ জুন গ্যাস সরবরাহ সংকট থাকায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সামাল দিচ্ছে সংস্থাটি।

বিপিডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এটি কখনো কমবেশিও হচ্ছে। যে পরিমাণ গ্যাস সংকট থাকছে তা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বেশি হলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু করার নেই।

পেট্রোবাংলা দৈনিক গ্যাস উৎপাদন প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছে। গত ২৯ জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জাতীয় গ্রিডে মোট ২৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে। এর মধ্যে ৬১ কোটি ঘনফুট এলএনজি।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার পরেও আরো অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সংকট থাকছে। এর জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই সঙ্গে শিল্প-কারখানায়ও রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় যদি জাতীয় গ্রিডে স্পট এলএনজি সরবরাহ কমে যায় সেই সংকট কীভাবে সামাল দেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই পেট্রোবাংলার কাছে।

পেট্রোবাংলার সাময়িক পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্পট এলএনজির সংকট সামাল দিতে দেশীয় গ্যাসকূপের ওয়ার্কওভার করা হবে দ্রুত। একই সঙ্গে আগামী নভেম্বরে শেভরনের বেশ কয়েকটি কূপে ওয়ার্কওভার করার কথা রয়েছে। এসব মিলিয়ে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়ানো যাবে বলে প্রত্যাশা পেট্রোবাংলার। একই সঙ্গে বর্তমানে রাত ১০টার পর দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধের ঘোষণা থাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহার কিছুটা কমেছে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ কম ব্যবহার হচ্ছে তার জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে।

ঢাকা/এসএ

শেয়ার করুন

x
English Version

অর্থাভাবে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি বন্ধ পেট্রোবাংলার

আপডেট: ০১:১৫:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ জুলাই ২০২২

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: দুই সপ্তাহ ধরে আবারো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম এখন ৪০ ডলার ছুঁইছুঁই। তবে শুধু পণ্যটির উচ্চমূল্যই নয়, স্পট থেকে এলএনজি কিনতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তারও যোগাড় করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এ পরিস্থিতিতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে এসেছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি পণ্যটির দাম না কমা পর্যন্ত দেশীয় উৎস থেকেই চাহিদা পূরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অস্বাভাবিক হারে এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আগস্ট থেকে স্পট মার্কেটের এলএনজি আমদানি না করার সাময়িক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রিডে যে পরিমাণ গ্যাস ঘাটতি হবে তা দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে জোগান দেয়ার চেষ্টা করা হবে। এজন্য বেশ কয়েকটি কূপে ওয়ার্কওভার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

স্পট মার্কেট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম কার্গো আমদানি করে বাংলাদেশ। সেই সময় প্রতি এমএমবিটিইউ ৪-৫ ডলার দামে কেনা হয়। সে সময় এক কার্গো এলএনজি কিনতে ৩০০-৩৫০ কোটি টাকা খরচ হতো। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে এলএনজির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে এক কার্গো এলএনজি কিনতে তিন-চার গুণ বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে। স্পট মার্কেটে জ্বালানি পণ্যটির দামের অস্থিতিশীলতা প্রভাব ফেলেছে পেট্রোবাংলার ওপরও। পণ্যটি কিনতে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান করতে পারছে না সংস্থাটি। এক বছর ধরে এলএনজির দাম পরিশোধে অর্থ বিভাগের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে সংস্থাটি। চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বিভাগ টাকাও দিতে পারছে না পেট্রোবাংলাকে। সর্বশেষ গত মে মাসে অর্থ বিভাগ গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে এলএনজি কেনার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে পেট্রোবাংলাকে। শর্ত সাপেক্ষে পেট্রোবাংলাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ অর্থ দেয়া হয়েছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এলএলজির দামে যে অস্থিরতা তাতে স্পট থেকে পণ্যটি আমদানির সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। যতটুকু আমদানি না করলেই নয়, সেই পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হবে। আগামীতে বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাস পেলে এলএনজির আমদানি বাড়ানো যাবে। গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য স্পট থেকে যে পরিমাণ এলএনজি আমরা আমদানি করছি, সেই পরিমাণ গ্যাস দেশীয় উৎস থেকে পূরণের চেষ্টা করছি। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এরই মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং কয়েকটি কূপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি কয়েকটি কূপ থেকে স্বল্পমেয়াদে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস অনুসন্ধানেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

মহামারীর অভিঘাত-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদার কারণে গত বছরের শেষার্ধে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বাড়তে থাকে। স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে সে সময় পেট্রোবাংলার ব্যয় হয় প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্ট করে। একপর্যায়ে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ৫৫ ডলারের ওপরে উঠে যায়। জ্বালানি পণ্যটির দাম পরবর্তী সময়ে ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। স্পট মার্কেটে এলএনজির দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বজায় ছিল। এরপর দুই মাস ধরে জ্বালানি পণ্যটির দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যদিও সর্বশেষ দুই সপ্তাহে এলএনজির দাম আবারো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে।

এশিয়ার স্পট মার্কেটে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির গড় মূল্য ছিল ২২ ডলার ৪০ সেন্ট করে। জ্বালানির বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এশিয়ার বাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ ডলারে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়েও জ্বালানি পণ্যটি ২৩ ডলারের কাছাকাছি দামে বিক্রি হয়েছিল। বাজারের এ অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে জ্বালানি পণ্যটির দাম আরো বেড়ে যাবে বলে আভাস দিচ্ছে এসঅ্যান্ডপি।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির পর এলএনজির দাম কমতে থাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কার্গো কেনে পেট্রোবাংলা। এ সময় দামের পতন হওয়ায় পর পর কয়েক মাস এলএনজি ক্রয়ে সাশ্রয়ীও হয় পেট্রোবাংলা। তবে জুনের শেষ সপ্তাহে স্পট মার্কেটে ফের ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। এ অবস্থায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি বিভাগ।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আমদানিনির্ভর দেশগুলো পড়েছে চরম বিপাকে। ঠিকমতো পণ্য সরবরাহ, দামে অস্থিরতার কারণে আমদানিকারক দেশগুলো বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আগামীতে জ্বালানির বাজার অস্থিরতা আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতায় ক্রমেই চাপ তৈরি হচ্ছে দেশের জ্বালানি খাতেও। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে ডিজেল ও অকটেন বিক্রিতে দৈনিক ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অন্যদিকে, এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী স্পট মার্কেট থেকে কেনা যাচ্ছে না এলএনজি। তার প্রভাবও পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে।

দেশের গ্যাসের সংকট থাকায় প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিষয়টি এড়িয়ে যায়নি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (বিপিডিবি)। গত ২৮ জুন গ্যাস সরবরাহ সংকট থাকায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সামাল দিচ্ছে সংস্থাটি।

বিপিডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এটি কখনো কমবেশিও হচ্ছে। যে পরিমাণ গ্যাস সংকট থাকছে তা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বেশি হলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু করার নেই।

পেট্রোবাংলা দৈনিক গ্যাস উৎপাদন প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছে। গত ২৯ জুনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জাতীয় গ্রিডে মোট ২৯৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে। এর মধ্যে ৬১ কোটি ঘনফুট এলএনজি।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার পরেও আরো অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সংকট থাকছে। এর জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই সঙ্গে শিল্প-কারখানায়ও রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় যদি জাতীয় গ্রিডে স্পট এলএনজি সরবরাহ কমে যায় সেই সংকট কীভাবে সামাল দেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই পেট্রোবাংলার কাছে।

পেট্রোবাংলার সাময়িক পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্পট এলএনজির সংকট সামাল দিতে দেশীয় গ্যাসকূপের ওয়ার্কওভার করা হবে দ্রুত। একই সঙ্গে আগামী নভেম্বরে শেভরনের বেশ কয়েকটি কূপে ওয়ার্কওভার করার কথা রয়েছে। এসব মিলিয়ে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়ানো যাবে বলে প্রত্যাশা পেট্রোবাংলার। একই সঙ্গে বর্তমানে রাত ১০টার পর দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধের ঘোষণা থাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহার কিছুটা কমেছে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ কম ব্যবহার হচ্ছে তার জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে।

ঢাকা/এসএ