০৯:৩৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক পুনর্গঠনে বিএসইসি’র উদ্যোগ

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক:
  • আপডেট: ০১:১১:৫৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জুন ২০২২
  • / ৪৩১৬ বার দেখা হয়েছে

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের পাশাপাশি আর্থিক পরিস্থিতি উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরই অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটির পর্ষদে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংকটির ঋণ আদায় কার্যক্রমসহ ব্যবসায়িক অবস্থা উন্নয়নের বিষয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হবে।

সম্প্রতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ কথা জানান বিএসইসির কর্মকর্তারা। এর আগে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিলেও তা সফলতা পায়নি।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেয়ায় গতকাল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদ, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ও কোম্পানি সচিবকে কমিশনে তলব করা হয়েছিল। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামসহ সংস্থাটির কর্মকর্তারা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আইনি জটিলতার কারণে ব্যাংকে নতুন মূলধন জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এটির পুনর্গঠন কার্যক্রমও গতি পাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি ব্যবসায়িক ও আর্থিক দিক দিয়ে সমস্যার মধ্যে রয়েছে তাদের অবস্থার উন্নয়নে কমিশন নিয়মিত এ ধরনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সঙ্গেও কমিশনের আলোচনা হয়েছে। এ সময় কমিশনের পক্ষ থেকে কীভাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করা যায়, তহবিল পুনরুদ্ধার করা যায়, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র পরিচালকসহ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হলে যদি তা ব্যাংকের অবস্থা পরিবর্তনে সহায়ক হয় তাহলে সে উদ্যোগ নেয়ার বিষয়েও কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আশা করছি এতে ব্যাংকটির অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।

বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১৪ হাজার ৬৬৫ জন বিনিয়োগকারী রয়েছেন। শেয়ারধারণের দিক দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ ধারণ করলে সংখ্যায় তারাই সবচেয়ে বেশি। একটি থেকে ৫০ হাজার শেয়ার রয়েছে এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৪ হাজার ১৬৫। দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ না দেয়ার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিএসইসির কাছে অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির অবস্থা পরিবর্তনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতাও নেয়া হবে।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বতর্মানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হিসেবে আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির প্রতিনিধি যারা রয়েছেন তারা ব্যাংকটির অবস্থার উন্নয়নে আন্তরিক। কিন্তু বিদেশী হওয়ার কারণে তারা দেশের আর্থিক খাতের খুঁটিনাটি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে তাদের সহায়তার জন্য স্থানীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হলে ব্যাংকটির সমস্যার জট খোলাটা সহজতর হবে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এভাবে বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেবে না, এটা হতে পারে না। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির অবস্থার পরিবর্তনে কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুসারে, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ২০২১ সাল শেষে ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ব্যাংকটির ঋণাত্মক ইকুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ২০২১ সাল শেষে ঋণাত্মক ১৩৭ দশমিক ৪১ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২০ সালে ছিল ঋণাত্মক ১৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। ব্যাসেল ৩ অনুসারে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ থাকার কথা। মুনাফা দিতে হয় এমন আমানতের পরিমাণ ২০২১ সাল শেষে ৮৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৭৪৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মুনাফা হয় এমন বিনিয়োগের পরিমাণ ২০২১ সালে ১৬১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ১৮৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগের ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি হয়ে গেছে, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এসব কারণে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে ব্যাংকটির নিরীক্ষক এমজে আবেদীন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস।

নিরীক্ষকের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটি বলছে, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আগের পরিচালকরা তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেছেন। এটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুকূলে আসবে, যা ব্যাংকটিতে নতুন মূলধন জোগানের পথ খুলে দেবে। ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন পণ্য চালুর মাধ্যমে ব্যাংক ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করছে। চলতি মূলধন ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প ও পরিকল্পনা বিবেচনা করছে। গত বছরের ২১ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটিকে অনাদায়ী আমানত পরিশোধের অনুমোদন দিয়েছে। বিলম্বে দেনা পরিশোধের জন্য গত বছরের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকটি।

১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বর্তমান অনুমোদিত মূলধন দেড় হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৬৬ কোটি ৪৭ লাখ ২ হাজার ৩৩০। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, দশমিক ১৭ শতাংশ সরকার, ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বাকি ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ৬৫০ কোটি টাকার আর্থিক জালিয়াতির কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কতিপয় শেয়ারহোল্ডার বিধি লঙ্ঘন করে ১০ শতাংশের বেশি এবং বেনামে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের শেয়ার ধারণ করছিল। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৪(ক) ধারা লঙ্ঘন করায় শেয়ারধারীদের ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে, যার অভিহিত মূল্য ছিল ৪৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে এতে প্রশাসক বসায়। ব্যাংকটি থেকে আমানতকারীরা তখন টাকা তুলতে গেলে তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। এরপর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে সাড়ে ছয় বছর সময় দিয়ে ২০০৭ সালে একটি স্কিম বা কর্মসূচি চালু করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা ওই স্কিমের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নতুন স্কিমে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ধরা হয় ৭০০ কোটি টাকা। এর ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির কাছে বিক্রি করা হয়। পুনর্গঠনের পর ব্যাংকটির নামকরণ হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড।

ঢাকা/এইচকে

শেয়ার করুন

x
English Version

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক পুনর্গঠনে বিএসইসি’র উদ্যোগ

আপডেট: ০১:১১:৫৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ জুন ২০২২

বিজনেস জার্নাল প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের পাশাপাশি আর্থিক পরিস্থিতি উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরই অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটির পর্ষদে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংকটির ঋণ আদায় কার্যক্রমসহ ব্যবসায়িক অবস্থা উন্নয়নের বিষয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হবে।

সম্প্রতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ কথা জানান বিএসইসির কর্মকর্তারা। এর আগে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিলেও তা সফলতা পায়নি।

অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারের গুরুত্বপূর্ন সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন: ফেসবুকটুইটারলিংকডইনইন্সটাগ্রামইউটিউব

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেয়ায় গতকাল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদ, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ও কোম্পানি সচিবকে কমিশনে তলব করা হয়েছিল। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামসহ সংস্থাটির কর্মকর্তারা আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আইনি জটিলতার কারণে ব্যাংকে নতুন মূলধন জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এটির পুনর্গঠন কার্যক্রমও গতি পাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি ব্যবসায়িক ও আর্থিক দিক দিয়ে সমস্যার মধ্যে রয়েছে তাদের অবস্থার উন্নয়নে কমিশন নিয়মিত এ ধরনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সঙ্গেও কমিশনের আলোচনা হয়েছে। এ সময় কমিশনের পক্ষ থেকে কীভাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায় করা যায়, তহবিল পুনরুদ্ধার করা যায়, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র পরিচালকসহ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হলে যদি তা ব্যাংকের অবস্থা পরিবর্তনে সহায়ক হয় তাহলে সে উদ্যোগ নেয়ার বিষয়েও কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আশা করছি এতে ব্যাংকটির অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।

বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১৪ হাজার ৬৬৫ জন বিনিয়োগকারী রয়েছেন। শেয়ারধারণের দিক দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ ধারণ করলে সংখ্যায় তারাই সবচেয়ে বেশি। একটি থেকে ৫০ হাজার শেয়ার রয়েছে এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৪ হাজার ১৬৫। দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ না দেয়ার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিএসইসির কাছে অসংখ্য অভিযোগ জমা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির অবস্থা পরিবর্তনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতাও নেয়া হবে।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বতর্মানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হিসেবে আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির প্রতিনিধি যারা রয়েছেন তারা ব্যাংকটির অবস্থার উন্নয়নে আন্তরিক। কিন্তু বিদেশী হওয়ার কারণে তারা দেশের আর্থিক খাতের খুঁটিনাটি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে তাদের সহায়তার জন্য স্থানীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হলে ব্যাংকটির সমস্যার জট খোলাটা সহজতর হবে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এভাবে বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেবে না, এটা হতে পারে না। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটির অবস্থার পরিবর্তনে কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুসারে, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ২০২১ সাল শেষে ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ব্যাংকটির ঋণাত্মক ইকুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ২০২১ সাল শেষে ঋণাত্মক ১৩৭ দশমিক ৪১ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২০ সালে ছিল ঋণাত্মক ১৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। ব্যাসেল ৩ অনুসারে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ থাকার কথা। মুনাফা দিতে হয় এমন আমানতের পরিমাণ ২০২১ সাল শেষে ৮৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৭৪৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মুনাফা হয় এমন বিনিয়োগের পরিমাণ ২০২১ সালে ১৬১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ১৮৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট বিনিয়োগের ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি হয়ে গেছে, যা ২০২০ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এসব কারণে ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে ব্যাংকটির নিরীক্ষক এমজে আবেদীন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস।

নিরীক্ষকের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটি বলছে, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আগের পরিচালকরা তাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেছেন। এটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুকূলে আসবে, যা ব্যাংকটিতে নতুন মূলধন জোগানের পথ খুলে দেবে। ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন পণ্য চালুর মাধ্যমে ব্যাংক ব্যয় নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করছে। চলতি মূলধন ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প ও পরিকল্পনা বিবেচনা করছে। গত বছরের ২১ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটিকে অনাদায়ী আমানত পরিশোধের অনুমোদন দিয়েছে। বিলম্বে দেনা পরিশোধের জন্য গত বছরের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকটি।

১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বর্তমান অনুমোদিত মূলধন দেড় হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৬৬ কোটি ৪৭ লাখ ২ হাজার ৩৩০। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৭৬ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, দশমিক ১৭ শতাংশ সরকার, ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বাকি ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ৬৫০ কোটি টাকার আর্থিক জালিয়াতির কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কতিপয় শেয়ারহোল্ডার বিধি লঙ্ঘন করে ১০ শতাংশের বেশি এবং বেনামে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের শেয়ার ধারণ করছিল। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৪(ক) ধারা লঙ্ঘন করায় শেয়ারধারীদের ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে, যার অভিহিত মূল্য ছিল ৪৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে এতে প্রশাসক বসায়। ব্যাংকটি থেকে আমানতকারীরা তখন টাকা তুলতে গেলে তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। এরপর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে সাড়ে ছয় বছর সময় দিয়ে ২০০৭ সালে একটি স্কিম বা কর্মসূচি চালু করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা ওই স্কিমের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নতুন স্কিমে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ধরা হয় ৭০০ কোটি টাকা। এর ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির কাছে বিক্রি করা হয়। পুনর্গঠনের পর ব্যাংকটির নামকরণ হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড।

ঢাকা/এইচকে